নামাজ আদায়সহ কুরআন স্পর্শ, তাওয়াফ, ইত্যাদি বহু আমলের পূর্বশর্ত হিসেবে ওযুকে ফরজ করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো — কোন কোন কারণে অজু করতে হয়? ওযু কয় প্রকার?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ওযুর বিভিন্ন প্রকার এবং ফিকহের চারটি প্রধান মাযহাব — হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি ও হাম্বলি — কোন কোন কারণে অজু করতে হয়? ওযু কয় প্রকার?
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করব:
- কখন ওযু ফরজ, কখন ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব বা মাকরূহ হয়
- কোন কোন ক্ষেত্রে ওযু করা বরং নিষিদ্ধ (হারাম) হতে পারে
- হানাফি ওযুর শ্রেণিবিভাগ
মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে— এক দিকে ইলমের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত আমলে সতর্কতা ও ভারসাম্য বজায় রাখা। কেননা ইবাদতের ভিত্তি বিশুদ্ধতা; আর বিশুদ্ধতার প্রথম ধাপ— সঠিক ওযু।
হানাফিরা ওযুকে ৫ প্রকারে বিভক্ত করেছেন
প্রথম — ফরজ ওযু
ক) যে ব্যক্তি অযু ভঙ্গ করেছে, তার জন্য ওযু করা ফরজ —
যখন সে নামাজে দাঁড়াতে চায়, তা ফরজ হোক কিংবা নফল, পূর্ণাঙ্গ হোক অথবা অসম্পূর্ণ —
যেমন জানাজার নামাজ কিংবা তিলাওয়াতের সেজদা।
এর প্রমাণ: আল্লাহ তায়ালার বাণী:
“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা নামাজের জন্য প্রস্তুত হও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল… ধুয়ে নাও” [সূরা মায়েদা: ৫:৬]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“তোমাদের কেউ যখন অযু ভঙ্গ করে, তখন পর্যন্ত আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না যতক্ষণ না সে অযু করে।” [সহিহ বুখারি, মুসলিম]
আরও বলেন:
“অযু ছাড়া নামাজ কবুল হয় না, এবং খিয়ানতের মাল থেকে সদকা গ্রহণ করা হয় না।” [সহিহ মুসলিম]
খ) যদি কেউ কুরআন স্পর্শ করতে চায় — একটি আয়াত হলেও, তা যদি কাগজে লেখা থাকে, দেয়ালে লেখা হয় কিংবা মুদ্রার উপর থাকে — তাহলেও ওযু করা ফরজ।
এর প্রমাণ: আল্লাহ বলেন:
“তাকে স্পর্শ করে না, কিন্তু পবিত্ররা” [সূরা ওয়াকিয়া: ৫৬:৭৯]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“পবিত্র না হলে কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না।” [মুয়াত্তা মালিক]
দ্বিতীয় — ওয়াজিব ওযু
কাঅবা শরীফ তাওয়াফ করার জন্য।
অধিকাংশ ইমাম (অহানাফি) বলেন:
এটি ফরজ।
প্রমাণ: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“তাওয়াফ হলো নামাজের মতো; তবে আল্লাহ তাতে কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন, অতএব কেউ যদি তাতে কথা বলে, সে যেন শুধু ভালো কথা বলে।” [তিরমিজি]
তবে হানাফিরা বলেন: তাওয়াফ নামাজের মতো হলেও তা প্রকৃত নামাজ নয়। তাই এর জন্য অযু করা ওয়াজিব, ফরজ নয়।
সুতরাং,
- যদি ফরজ তাওয়াফ অযু ছাড়া হয় — তাহলে একটি উট কুরবানি দিতে হয়।
- ওয়াজিব তাওয়াফে — একটি ছাগল বা ভেড়া কুরবানি (দম)।
- নফল তাওয়াফে — কেবল সদকা দিতে হয়।
এই সকল কারণে বা সময়ে ওজু করা সুন্নত।
তৃতীয় প্রকার ওযু: মুস্তাহাব
ক) প্রতিটি নামাজের জন্য নতুন ওযু করা
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আমার উম্মতের উপর কষ্ট না হতো, তবে আমি তাদেরকে প্রতিটি নামাজের সময় ওযু করার এবং প্রতিটি ওযুর সাথে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।” [আহমদ, হাকিম]
🔹 পূর্ববর্তী ওযু থাকলেও নতুন করে ওযু করা মুস্তাহাব —
যেহেতু এটি “নূরের উপর নূর”। তবে যদি ওযু করেও কোনো ইবাদত না করা হয়, তাহলে তা অপচয় (ইসরাফ) হিসেবে গণ্য হয়।
আরও হাদীস:
“যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় আবার ওযু করে, তার জন্য দশটি নেকি লেখা হয়।” [আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ]
🔹 নিয়মিত ওযু অবস্থায় থাকা মুস্তাহাব —
কারণ,
“তোমরা সোজা থেকো, যদিও পুরোপুরি পারবে না। জেনে রেখো, তোমাদের সেরা কাজ হলো নামাজ, আর ওযু রক্ষা করে কেবল মুমিনই।” [ইবনু মাজাহ, হাকিম, আহমদ, বায়হাকি]
খ) ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কিত কিতাব স্পর্শ করা
যেমন: তাফসির, হাদীস, আকিদা, ফিকহ ইত্যাদি কিতাব। তবে যদি কোনো কিতাবে কুরআনের আয়াত বেশি থাকে, তাহলে ওযু ছাড়া তা স্পর্শ করা হারাম।
গ) পবিত্র অবস্থায় ঘুমানো এবং ঘুম থেকে জেগে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ওযু করা
হাদীস: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“যখন তুমি ঘুমাতে যাও, তখন নামাজের মতো করে ওযু করো, তারপর তোমার ডান পাশে শুয়ে পড়ো, এবং বলো:
اللَّهُمَّ إني أسلمتُ نفسي إليك، ووجهتُ وجهي إليك، وفوضتُ أمري إليك، وألجأتُ ظهري إليك، لا ملجأ ولا منجى منك إلا إليك، آمنتُ بكتابك الذي أنزلتَ، وبنبيك الذي أرسلتَ
‘হে আল্লাহ! আমি আমার প্রাণ তোমার কাছে সমর্পণ করলাম, আমার মুখ তোমার দিকে ফিরালাম, আমার সবকিছু তোমার কাছে সঁপে দিলাম, আমার পিঠ তোমার উপর নির্ভর করালাম। তোমার কাছ ছাড়া আর কোনো আশ্রয় বা পরিত্রাণ নেই। আমি তোমার নাযিলকৃত কিতাব এবং প্রেরিত নবীর প্রতি ঈমান আনলাম।’” [বুখারি, মুসলিম]
ঘ) গোসলের পূর্বে ওযু করা এবং কিছু বিশেষ অবস্থায় অযু করা
- গোসলের পূর্বে ওযু করা মুস্তাহাব।
- যৌন মিলনের পর, কেউ যদি খাওয়া, পান করা, ঘুমানো বা দ্বিতীয়বার সহবাস করতে চায়, তাহলেও ওযু করা মুস্তাহাব।
হাদীসসমূহ:
- আয়েশা (রা.) বলেন: “নবী ﷺ যখন অপবিত্র থাকতেন এবং খেতে বা ঘুমাতে চাইতেন, তখন ওযু করে নিতেন।” [মুসলিম]
- আবার তিনি বলেন: “যখন তিনি (ﷺ) অপবিত্র অবস্থায় ঘুমাতে চাইতেন, তখন প্রথমে তার গোপনাঙ্গ ধুয়ে নিতেন এবং নামাজের মতো ওযু করতেন।” [বুখারি, মুসলিম]
- আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন: “তোমাদের কেউ যখন স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, তারপর আবার করতে চায়, সে যেন ওযু করে নেয়।” [মুসলিম]
ঙ) রাগের পর ওযু করা
কারণ, ওযু রাগের আগুনকে নিভিয়ে দেয়।
হাদীস:
“তোমাদের কেউ যদি রাগান্বিত হয়, তাহলে সে যেন ওযু করে।” [মুসনাদ আহমদ]
চ) কুরআন তিলাওয়াত, হাদীস অধ্যয়ন ও পড়ানোর সময় ওযু করা
- কুরআন তিলাওয়াতের সময়, হাদীস পাঠ ও বর্ণনার সময়, বা যেকোনো শরঈ ইলম অধ্যয়নের সময় ওযু করা মুস্তাহাব — যেন তা যথাযোগ্য সম্মান পায়।
- মালিক ইবনে আনাস (রহ.) হাদীস বর্ণনার সময় ওযু করতেন, সম্মানের কারণে।
ছ) আযান, ইকামত, খুৎবা প্রদান, এমনকি বিয়ের খুৎবা, নবী ﷺ এর যিয়ারত, আরাফাতে অবস্থান, এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করার সময় ওযু করা
কারণ এগুলো ইবাদতের স্থান ও সময়, তাই ওযু করে যাওয়াই উত্তম।
জ) কোনো গুনাহ করার পর ওযু করা
যেমন:
- গীবত
- মিথ্যা
- চোগলখুরি
ইত্যাদি।
কারণ,
নেক কাজ গুনাহকে মুছে দেয়।
হাদীস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজ বলব, যার দ্বারা আল্লাহ গুনাহ মুছে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন?”
সাহাবারা বললেন: “জি, অবশ্যই বলুন।” তিনি বললেন: “কঠিন অবস্থায় পরিপূর্ণ ওযু করা, বেশি করে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া, এবং এক নামাজের পর অন্য নামাজের অপেক্ষায় থাকা —
এটিই হলো রিবাত (সংগ্রাম), এটিই রিবাত।” [মুসলিম]
ঝ) নামাজের বাইরে উচ্চস্বরে হেসে ফেললে (قهقهة) ওযু করা
কারণ এটিকে “স্বরূপের দৃষ্টিতে” হাদস (অপবিত্রতা) ধরা হয়।
ঞ) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া বা বহন করার পর ওযু করা
হাদীস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “যে মৃতকে গোসল দিল, সে যেন গোসল করে; আর যে বহন করল, সে যেন ওযু করে।” [আবু দাউদ]
ট) এমন কিছু কাজ করার পর ওযু করা যা নিয়ে আলিমদের মধ্যে মতভেদ আছে
যেমন:
- স্ত্রী স্পর্শ করা
- নিজের গোপনাঙ্গ হাতের তালু দিয়ে স্পর্শ করা
- উটের মাংস খাওয়া ইত্যাদি
এসব ক্ষেত্রে ওযু করা ভালো — যেন সব ইমামের মতে ইবাদত শুদ্ধ হয় এবং নিজের দ্বীনের জন্য সতর্কতা হয়।
চতুর্থ প্রকার: مكروه (অপছন্দনীয় ওযু)
- পূর্ববর্তী ওযু দ্বারা কোনো নামাজ না পড়ে আবার নতুন করে ওযু করা — এটা মাকরূহ,
- এমনকি নতুন জায়গায় গেলেও, যদি প্রথম ওযু দিয়ে কোনো সালাত আদায় না করা হয়।
পঞ্চম প্রকার: حرام (নিষিদ্ধ ওযু)
হারাম পানি দিয়ে ওযু করা, যেমন:
- জোর করে দখল করা পানি (ماء مغصوب)
- এতিমের সম্পদ থেকে নেয়া পানি
হাদীস:
“যে আমাদের (শরীয়তের) বিধানের বাইরে কোনো কাজ করে, তা প্রত্যাখ্যাত।” [মুসলিম]