মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, আশা-নিরাশা—সবই আসে যায়। এসব মুহূর্তে একজন মু’মিন যাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে, যার দরবারে সবচেয়ে বেশি মাথা নত করে—তিনি হলেন আল্লাহ তাআলা। আর এই আহ্বানের মধ্যে কিছু দোয়া আছে, যেগুলো শুধু মুখের কথা নয়, বরং তা হৃদয়ের গভীরতা থেকে বের হয়, আল্লাহর বিশেষ কিছু নামে—যাদের মধ্যে কিছু নাম এমন, যেগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে বিশেষ রহস্য ও মর্যাদা। এই মহিমান্বিত নামগুলোর মধ্যেই রয়েছে “ইসমে আজম”, অর্থাৎ “আল্লাহর সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত নাম”। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি এই নামে আল্লাহকে ডাকবে—তার দোয়া কবুল হবে, এবং যে কিছু চাইবে—তা দান করা হবে।
এই ব্লগপোস্টে আমরা ইসমে আজম সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদীস, ইসলামি স্কলারদের ব্যাখ্যা, ইসমে আজম দোয়া পড়ার পদ্ধতি, এবং এই দোয়ার মাধ্যমে কীভাবে বান্দা আল্লাহর আরও কাছাকাছি যেতে পারে—সে বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
✦ ইসমে আজম দোয়া: বিস্তারিত ব্যাখ্যা ✦
❖ ইসমে আজম কী?
“ইসমে আজম” অর্থ: সর্বশ্রেষ্ঠ নাম। এটি আল্লাহ তাআলার এমন একটি নাম (বা কিছু নাম), যার মাধ্যমে যদি কেউ আল্লাহর কাছে কিছু চায়, তাহলে তা অবশ্যই কবুল হয়; এবং এই নাম দ্বারা দোয়া করলে তা অগ্রাহ্য হয় না।
❖ ইসমে আজম সংক্রান্ত হাদীস
✅ সাহিহ হাদীস থেকে প্রমাণ
«اسْمُ اللَّهِ الأَعْظَمُ الَّذِي إِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ، فِي ثَلاثِ سُوَرٍ: فِي البَقَرَةِ، وَآلِ عِمْرَانَ، وَط عَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ:
“আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নাম (ইসমে আজম)—যে নাম দ্বারা দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন—তা সূরা বাকারা, সূরা আলে ইমরান এবং সূরা ত্বহা-তে রয়েছে।” 📚 (সুনান ইবনে মাজাহ: ৩৮৫৮)
❖ কোন নামটি ইসমে আজম?
ইসলামী স্কলারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে—ইসমে আজম আসলে কোন নাম। তবে কিছু নামের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন:
১. الحي القيوم (আল-হাইয়্যুল কাইয়ূম)
২. الله لا إله إلا هو
৩. ذو الجلال والإكرام (যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম)
৪. الرحمن الرحيم
৫. اللهم إني أسألك দিয়ে শুরু করা দোয়াগুলো।
✅ আরও একটি হাদীস:
أنس (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ একজন লোককে একটি দোয়া করতে শুনলেন। তিনি বললেন:
«لقد دعا الله باسمه العظيم، الذي إذا دعي به أجاب، وإذا سئل به أعطى»
অর্থ: “সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই আল্লাহকে তাঁর সবচেয়ে বড় নাম (ইসমে আজম) দিয়ে ডাকল। যে নাম দিয়ে দোয়া করলে কবুল হয় এবং কিছু চাইলে তা দান করা হয়।”
📚 (সুনান তিরমিযি: ৩৪৭৫)
❖ ইসমে আজম দোয়ার উদাহরণ
হাদীস অনুসারে কিছু দোয়া নিচে দেওয়া হলো—যেগুলোতে ইসমে আজম আছে বলে স্কলাররা মনে করেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ، لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ، الأَحَدُ الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে চাই, তুমি সেই আল্লাহ, একমাত্র উপাস্য, যিনি এক, যিনি অমুখাপেক্ষী, যিনি জন্ম দেননি, জন্ম নেননি, এবং তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই।”
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমার সেই সব নামের মাধ্যমে তোমার কাছে চাই—যা তুমি নিজেকে দিয়েছ, অথবা তোমার কিতাবে নাজিল করেছ, অথবা তোমার কোনো বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছ, কিংবা তুমি গায়বের জ্ঞানে রেখেছ।”
❖ ইসমে আজম দিয়ে দোয়ার আদব
১. তাওবা করে দোয়া শুরু করা।
২. আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফ পাঠ করে দোয়া করা।
৩. হৃদয়ের গভীরতা থেকে অনুরোধ করা।
৪. নিয়মিত পড়া ও তাওয়াক্কুল রাখা।
❖ ইসমে আজম কিভাবে পড়তে হবে?
১. নিয়ত শুদ্ধ করা
শুরুতেই নিজের নিয়ত ঠিক করুন—আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্যে আপনি এই দোয়া করছেন।
২. তাওবা ও ইসতিগফার দিয়ে শুরু করুন
আপনার দোয়ার শুরুতেই তাওবা করুন এবং “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলে অন্তর পরিষ্কার করুন। গুনাহ মাফ চেয়ে আল্লাহর রহমতের অধিকারী হওয়া দরকার।
৩. আল্লাহর প্রশংসা করুন
যেমন:
الحمد لله رب العالمين، الرحمن الرحيم، مالك يوم الدين…
অথবা নিজ ভাষায় আল্লাহর প্রশংসা করতে পারেন।
৪. দরুদ শরীফ পাঠ করুন
যেমন:
اللهم صل على محمد وعلى آل محمد…
এটি দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত। হাদীস অনুযায়ী, দোয়ার আগে-পরে দরুদ দিলে মাঝখানের দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
৫. ইসমে আজম সংবলিত দোয়া পাঠ করুন
নিম্নোক্ত দোয়াগুলোর যেকোনোটি পড়া যেতে পারে—বিশেষ পরিস্থিতিতে, বা নামাজ শেষে, বা গভীর রাতে একান্তে।
✅ উদাহরণ-১:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ، لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ، الأَحَدُ الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
✅ উদাহরণ-২:
يا حي يا قيوم، برحمتك أستغيث، أصلح لي شأني كله، ولا تكلني إلى نفسي طرفة عين
✅ উদাহরণ-৩:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ…
(সম্পূর্ণ দীর্ঘ দোয়া আগেই দেওয়া হয়েছে)
৬. তারপর আপনি যা চান—তা চেয়ে নিন
নিজ ভাষায়, আন্তরিকভাবে, চোখের পানি ফেলে চাইতে পারেন। এমনকি নীরব মনে করলেও দোয়া হবে, কারণ আল্লাহ অন্তর জানেন।
৭. শেষে আবার দরুদ পাঠ করুন
এটা সুন্নাহর আদব। শুরু ও শেষে দরুদ দিয়ে দোয়া করা দোয়াকে বিশেষ মর্যাদা দেয়।
✦ কখন পড়া উত্তম?
- তাহাজ্জুদের সময়
- নামাজ শেষে
- রুকু-সিজদার মাঝে
- বিপদের সময়
- গোপনে নির্জনে
✅ ইসমে আজম দিয়ে সংকট নিরসনের আমল
ইসমে আজম দিয়ে দোয়া করলে দোয়া কবুল হওয়া নিশ্চিত—এমন বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সাহাবায়ে কিরাম এবং সালাফে সালেহীনরাও সংকটময় মুহূর্তে আল্লাহর ইসমে আজম দ্বারা দোয়া করতেন। নিচে কয়েকটি নির্দিষ্ট সমস্যা ও তার সাথে সম্পৃক্ত আমল দেওয়া হল—
🔹 ১. মানসিক অস্থিরতা ও অজানা ভয় কাটাতে
📖 আমল: রোজ রাতে ঘুমানোর আগে
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ، بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ، أَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ، وَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ
📌 অর্থ: “হে চিরজীবিত, হে বিশ্বকে ধারণকারী! আমি তোমার দয়াপূর্ণ সাহায্য প্রার্থনা করি, আমার সমস্ত অবস্থা তুমি ঠিক করে দাও, আর এক চোখের পলক পরিমাণ সময়ের জন্যও আমাকে আমার নিজের উপর ছেড়ে দিও না।”
🟢 প্রতি রাতে ৭ বার পড়ুন। মনে গভীর তবাক্কুল রাখুন।
🔹 ২. অসুস্থতা ও অপারেশনের আগে
📖 আমল:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، الْأَحَدُ الصَّمَدُ…
🕓 সময়:
অপারেশনের আগে, অসুস্থতা শুরুর সময়, কিংবা চিকিৎসা শুরুর আগে ৩ বার পড়ে নিজের শরীরের উপর ফুঁ দিন।
💡 এই দোয়াটি তিরমিজি হাদিসে ইসমে আজম হিসেবে চিহ্নিত।
🔹 ৩. চাকরি ও রিজিকের সমস্যা দূর করতে
📖 আমল:
- দৈনিক ফজরের পর
- ইকামাতের আগ মুহূর্তে
- অফিসে যাওয়ার আগে
يَا رَزَّاقُ، يَا فَتَّاحُ، يَا عَلِيمُ، يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ، بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ، فَارْزُقْنِي مِنْ حَيْثُ لَا أَحْتَسِبْ
📌 অর্থ: “হে রিজিকদাতা! হে উন্মোচনকারী, হে সর্বজ্ঞ, হে চিরজীবিত, হে বিশ্ব-ধারণকারী! আমি তোমার করুণা প্রার্থনা করি, আমাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দাও যা আমি কল্পনাও করতে পারি না।”
🟢 ২১ বার করে পড়ুন সকালবেলায়।
🔹 ৪. সন্তান না হওয়া / বন্ধ্যাত্ব সমস্যা
📖 আমল:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِاسْمِكَ الْأَعْظَمِ أَنْ تَرْزُقَنِي ذُرِّيَّةً صَالِحَةً رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
🕓 তাহাজ্জুদের সময়, সিজদার মাঝে।
📌 ৪০ দিন ধরে এই দোয়া নিয়মিত করুন—আল্লাহর ইসমে আজম দ্বারা সন্তান চাওয়া, হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর দোয়া থেকে অনুপ্রাণিত।
🔹 ৫. দাম্পত্য কলহ বা পরিবারে অশান্তি
📖 আমল:
اللَّهُمَّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ
এর আগে পড়ুন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِاسْمِكَ الْأَعْظَمِ…
🕓 সময়: ফজর ও মাগরিবের পর
🔹 ৬. বিপদে পড়লে দ্রুত সহায়তা চাওয়ার জন্য
📖 আমল: যেকোনো সময়, হঠাৎ দুর্ঘটনা, বিপদ, শত্রুর আক্রমণ, ভয় ইত্যাদির সময়:
يا حي يا قيوم، برحمتك أستغيث
🟢 যতবার সম্ভব — দ্রুত, মনে মনে অথবা জোরে জোরে।
❓ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (FAQ)
🔹 ইসমে আজম বলতে কি শুধু একটি নির্দিষ্ট নাম বোঝায়?
📌 নয়। অধিকাংশ আলেমের মতে, ইসমে আজম একটি নির্দিষ্ট নাম নয় বরং আল্লাহর কিছু নাম বা বাক্য—যা দোয়ার সময় বলা হলে তা কবুল হয়। তবে কিছু নামের গুরুত্ব বেশি, যেমন:
الحيّ القيّوم, الله الواحد الأحد الصمد, ذو الجلال والإكرام ইত্যাদি।
🔹 ইসমে আজম দিয়ে দোয়া করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি কি আছে?
📌 নির্দিষ্ট ফরম্যাট নেই, তবে দোয়া শুরুতে ও শেষে দরুদ পাঠ করা উত্তম। একাগ্র চিত্তে আল্লাহর প্রশংসা করে ইসমে আজম ব্যবহার করে আপনার প্রয়োজন বর্ণনা করুন।
🔹 নারীরা কি ইসমে আজম দিয়ে দোয়া করতে পারবে?
📌 অবশ্যই পারবে। নারী-পুরুষ সবার জন্যই ইসমে আজমের মাধ্যমে দোয়া করা উন্মুক্ত। দোয়া কবুলে নারী-পুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
🔹 ইসমে আজম দিনে কয়বার পড়া উচিত?
📌 এটি নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নয়। আপনি ইচ্ছেমতো বারবার পড়তে পারেন—বিশেষত দোয়ার সময়, সালাতের সিজদায়, তাহাজ্জুদের সময় বা বিপদে পড়লে।
🔹 ইসমে আজম না জেনেও কি দোয়া কবুল হতে পারে?
📌 হ্যাঁ। আল্লাহর দরবারে আন্তরিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইসমে আজম জেনে-বুঝে ব্যবহার করলে দোয়ার কবুল হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়—হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
🔹 ইসমে আজম শুধু আরবি ভাষায় বলতে হবে?
📌 হ্যাঁ, কারণ এটি আল্লাহর নাম, যা আরবিতে প্রোথিত। তবে অর্থ বুঝে মনোযোগ সহকারে পাঠ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।