নাজাসাত অর্থ কি? কত প্রকার ও কী কী? বিস্তারিত আলোচনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামে পবিত্রতা ও পরিছন্নতা শুধুমাত্র বাহ্যিক আচরণ নয়, বরং এটি ইমানের একটি অংশ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ” – “পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক” (মুসলিম)। আর এই পবিত্রতার গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হলো নাজাসাত বা নাপাকি থেকে মুক্ত থাকা। বিশেষত, নামাযের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের ক্ষেত্রে দেহ, পোশাক ও নামাযের স্থান — সব কিছুকে নাপাকি থেকে মুক্ত রাখা আবশ্যক। নাজাসাত অর্থ কি? নাজাসাত কত প্রকার ও কী কী বিস্তারিত আমার এই পোস্ট থেকে জানব, ইন-শা আল্লাহ।

তবে বাস্তব জীবনে নানাভাবে অল্পবিস্তর নাপাকির সংস্পর্শে আসা প্রায় অনিবার্য। কখনো তা কাপড়ে লেগে যায়, কখনো রাস্তাঘাটে, আবার কখনো নিজের অজান্তে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে— সব ধরনের নাপাকি কি নামাযের জন্য প্রতিবন্ধক? নাকি কিছু পরিমাণে ছাড় দেওয়া হয়েছে?

নাজাসাত অর্থ কি?

নাজাসাত (অপবিত্রতা) — এটি পবিত্রতার বিপরীত শব্দ। আন-নাজাস — পবিত্রতার বিপরীত বস্তু, এর বহুবচন আনজাস। এর দ্বারা এমন একটি জিনিসকে বোঝায় যা শরিয়তের দৃষ্টিতে ঘৃণিত ও অপবিত্র।

নাজিস শব্দটি দুইভাবে ব্যবহৃত হয়:

১. হুকমি (পরোক্ষ) — যেটি শরীরের কোনো অংশে ধারণকৃত একটি অবস্থা।
২. হাকিকি (প্রকৃত) — বাস্তব কোনো অপবিত্র বস্তু।

খুবস (নোংরা বা অপবিত্র বস্তু) — শুধু প্রকৃত (হাকিকি) অপবিত্রতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
হাদাস — পরোক্ষ (হুকমি) অপবিত্রতার সাথে সংশ্লিষ্ট।

নাজিস (نَجِس) শব্দটি যদি জিম (ج) অক্ষরটি ফতহার সাথে পড়া হয়, তবে এটি একটি নামবাচক শব্দ। আর যদি কসরার (ই) সাথে পড়া হয়, তবে এটি একটি বিশেষণ।

নাজাসাত (অপবিত্রতা) মূলত দুই প্রকার

  • নাজাসাতে হাকিকি
  • নাজাসাতে হুকমি

নাজাসাতে হাকিকি কি?

ভাষাগতভাবে: এমন বস্তু যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘৃণা করে — যেমন রক্ত, প্রস্রাব, পায়খানা ইত্যাদি।

শরিয়তের দৃষ্টিতে: এমন অপবিত্র বস্তু যা কোনো বৈধতা ছাড়া নামাজ সহিহ হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

নাজাসাতে হুকমি কি?

এটি একটি কাল্পনিক বা ধারণাগত অবস্থা যা দেহের কোনো অঙ্গকে ঘিরে থাকে এবং নামায আদায়ের জন্য বৈধতা না থাকলে তা বাধা সৃষ্টি করে।

এর মধ্যে পড়ে:

  • ছোট হাদাস: যেমন অজু ভেঙে যাওয়া, যা অজু দ্বারা দূর হয়।
  • বড় হাদাস: যেমন জানাবত, যা গোসলের মাধ্যমে দূর হয়।

নাজাসাতে হাকিকি বা প্রকৃত অপবিত্রতা তিন প্রকার

  • গলিজা বা গুরুতর ও মুখাফফাফা বা সহজ
  • জামিদ বা জমাট বস্তু ও মায়ি’আ বা তরল প্রবহমান
  • মার’ইয়া বা দৃষ্টিগোচর ও গাইরু মার’ইয়া বা অদৃশ্য

প্রথম প্রকার : গলিজা বা গুরুতর ও মুখাফফাফা এর পরিচিতি

১. নাজাসাতে গলিজা কি? — গুরুতর অপবিত্রতান পরিচয়

🔹 সংজ্ঞা: যেসব অপবিত্রতা এমন দলীল দ্বারা প্রমাণিত যা অকাট্য ও শক্ত ভিত্তিসম্পন্ন (قطعي الدلالة), সেগুলোকে গুরুতর অপবিত্রতা বলা হয়।

উদাহরণ:

  • প্রবাহিত রক্ত
  • মল (গায়িত)
  • এমন প্রাণীর মূত্র যার মাংস খাওয়া জায়েয নয় (যেমন: বিড়াল, শেয়াল, ইঁদুর, কুকুর, ইত্যাদি), এমনকি যদি তা শিশু হয় এবং কঠিন খাবার খায় না
  • মদ (খামর)
  • মুরগি, হাঁস, রাজহাঁস — এদের বিষ্ঠা (এরা সাধারণত উড়তে পারে না)
  • মৃত প্রাণীর গোশত ও চামড়া
  • কুকুরের নাপাক বস্তু (মল, লালা, ইত্যাদি)
  • হিংস্র জন্তুর পায়খানা ও লালা
  • পুরো মুখভর্তি বমি
  • মানব শরীর থেকে বের হওয়া সব কিছু যা ওযু ভঙ্গ করে — যেমন:
    • মল
    • বীর্য (مني)
    • মযী (ময়লা সাদা তরল)
    • প্রবাহিত রক্ত
    • গর্ভস্রাব ইত্যাদি

🔹 ক্ষমাযোগ্য পরিমাণনা: মাজে এক দিরহাম বা তার কম পরিমাণ হলে ক্ষমাযোগ্য।
🔸 এক দিরহাম বলতে বোঝায়: বড় মাপের দিরহাম (মিথকাল) — বা হাতের তালুর সমান জায়গা। কারণ অল্প পরিমাণ থেকে বাঁচা কষ্টকর। এ পরিমাপ নেওয়া হয়েছে ইসতিঞ্জার স্থান থেকে কিয়াস করে।

এর বেশি হলে নামাজ সহিহ হবে না।

২. নাজাসাতে খফিফার কি? সহজ বা লঘু অপবিত্রতার পরিচয়

🔹 সংজ্ঞা: নাজাসাত খফিফা অর্থ, যে অপবিত্রতা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয় (ظني الدلالة), তাকে হালকা নাপাকী বলা হয়।

উদাহরণ:

  • খাওয়ার উপযোগী প্রাণীর প্রস্রাব — যেমন:
    • ঘোড়া
    • উট
  • এমন পাখির বিষ্ঠা যাকে খাওয়া যায় না (কিন্তু উড়ন্ত অবস্থায় থাকে)

🔹 মতভেদ

  • উট, গরু, ছাগল ইত্যাদির বিষ্ঠা ও গোবর সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফার মতে — গুরুতর নাপাক।
  • কিন্তু তাঁর দুই শাগরিদ (ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ) বলেছেন — সহজ নাপাক।
  • সাহিবাইনের মতই শ্রেষ্ঠতর ও গ্রহণযোগ্য, কারণ:
    • রাস্তাঘাট এসব দিয়ে ভর্তি,
    • সবার পক্ষে এগুলো এড়ানো কঠিন।
  • এমনকি মুহাম্মদ পরবর্তীতে বলেন: “রাস্তায় গোবর থাকলে, তা অপবিত্রতা সৃষ্টি করবে না, এমনকি পরিমাণ বেশি হলেও।”

আজকের যুগে পাকা রাস্তা ও শহরের প্রেক্ষাপটে, এই ধরনের অপবিত্রতা সহজই বিবেচিত।

🔸 ক্ষমাযোগ্য পরিমাণ:

  • যদি কাপড়ে লাগে: সমগ্র কাপড়ের এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত নামাজে ক্ষমাযোগ্য
  • যদি দেহে লাগে: লেগে যাওয়া অঙ্গের এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত ক্ষমাযোগ্য।

🟢 এই পরিমাপ সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে সহজীকরণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, বিশেষ করে যারা সাধারণ মানুষ এবং গভীর জ্ঞান রাখে না।

হাম্বলী মাযহাব অনুযায়ী নাপাকির মাফযোগ্যতার বিধান

🔹 সাধারণ নীতিমালা

حنابلة মতে: ➤ সামান্য পরিমাণ নাপাকিও মাফযোগ্য নয়, এমনকি চোখে দেখা না গেলেও –
যেমন: মাছির পায়ে লেগে আসা অপবিত্রতা।

📖 প্রমাণ:

  • কুরআন: {وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ} “তোমার পোশাককে পবিত্র রাখো” [সূরা মুদ্দাসসির, ৭৪:৪]
  • হাদিস: ابن عمر رضي الله عنهما বলেন: “আমাদেরকে নাপাকি সাতবার ধোয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

🔸 তবে কিছু ব্যতিক্রম মাফযোগ্য – নির্দিষ্ট শর্তে:

✅ ১. সামান্য পরিমাণ রক্ত / পুঁজ / ক্ষতের পানি

  • যদি তা এমন প্রাণী থেকে আসে:
    • যার জীবনকালে দেহ পবিত্র (তাহির), যেমন:
      • মানুষ
      • খাওয়ার উপযোগী প্রাণী: গরু, উট
      • অথবা বিড়ালের মতো পশু, যা শরয়ীভাবে অপবিত্র না
  • আরও শর্ত:
    • এটি খাদ্য নয় এবং তরল নয়
    • মল-মূত্রপথ (قبل أو دبر) থেকে বের হয়নি
    • যেমন:
      • বাহুর ক্ষতের পুঁজ
      • কনুইয়ের ঘা থেকে রক্ত

❌ কোন অবস্থায় মাফ নয়?

  • যদি তা হয়:
    • খাওয়ার বস্তুতে পড়ে
    • তরল বস্তুতে পড়ে
    • অপবিত্র প্রাণী থেকে আসে (যেমন: কুকুর, শুকর, গাধা, খচ্চর)
    • বা পায়খানা-মূত্রদ্বার (قبل أو دبر) থেকে নিঃসৃত (যেমন: হায়েয/নেফাসের রক্ত)

✅ ২. ইসতিজমার পর সামান্য দাগ

  • যদি প্রচলিত নিয়মে তিনটি ঢেলা দিয়ে পরিষ্কার করা হয়
  • এবং পরিষ্কার হওয়া নিশ্চিত হয়, তাহলে বাকি দাগ মাফযোগ্য।

✅ ৩. পিচঢালা রাস্তার কাদায় মিশে যাওয়া নাপাকি

  • যদি নাপাকি নিশ্চিত হয়, তবুও তা মাফযোগ্য, কারণ এ থেকে বাঁচা কষ্টকর।

দ্বিতীয় প্রকার: জামিদ বা জমাট ও মায়ি’আ বা তরল প্রবহমান নাজাসাত অর্থ

৩. জামিদ (نَجَس جَامِد) — জমাট বা কঠিন অপবিত্র বস্তু

১. নাজাসাতুন জামিদা (জমাট নাপাকী)

যেসব অপবিত্র বস্তু কঠিন বা জমাট অবস্থায় থাকে।

🔸 উদাহরণ:

  • মৃত প্রাণীর শরীর (ميتة)
  • মল (غائط)

২. নাজাসাতুন মায়ি’আ (তরল নাপাকী)

যেসব অপবিত্র বস্তু তরল বা প্রবাহমান।

🔸 উদাহরণ:

  • প্রস্রাব (بول)
  • প্রবাহিত রক্ত (الدم المسفوح)
  • মযী (মেয়লা সাদা তরল যা উত্তেজনায় বের হয় – مذي)

তৃতীয় প্রকার: নাজাসাতের দৃষ্টিগোচর (مرئية) ও অদৃশ্য (غير مرئية) রূপে বিভাজন

১. নাজাসাতুন মার’ইয়্যাহ (দৃষ্টিগোচর অপবিত্রতা)

যে অপবিত্রতা শুকিয়ে যাওয়ার পরও চোখে দেখা যায়।

🔸 উদাহরণ:

  • মল (عذرة)
  • রক্ত (دم)

🔹 পবিত্র করার পদ্ধতি:

  • যেহেতু এ ধরনের অপবিত্রতা চোখে দেখা যায়, তাই এর মূল বস্তু (عين/جرم) দূর করতে হয়।
  • একবার ধোয়ায় যদি বস্তুটা দূর হয়ে যায়, তাহলে তাহারাত হাসিল হয়ে যায়।

২. নাজাসাতুন গাইরু মার’ইয়্যাহ (অদৃশ্য অপবিত্রতা)

যে অপবিত্রতা শুকিয়ে গেলে আর চোখে দেখা যায় না।

🔸 উদাহরণ:

  • প্রস্রাব (بول)
  • এমন তরল যা দৃষ্টিগোচর থাকে না

🔹 পবিত্র করার পদ্ধতি: যেহেতু এর বস্তু দেখা যায় না, তাই পবিত্র করার জন্য বারবার ধোয়া দরকার যতক্ষণ না ধোয়ার ব্যক্তি প্রবল ধারণা করে যে স্থানটি পবিত্র হয়ে গেছে।

🟢 ওয়াসওয়াসায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য

  • তিনবার ধোয়া আবশ্যক ধোয়া যেন সঠিকভাবে হয়, কারণ একবারে পবিত্র হওয়া নিশ্চিত হয় না।
  • প্রতিবার ধোয়ার পর চিপে পানি বের করে ফেলা (عصر) জরুরি, কারণ এটাই অপবিত্রতা বের করে।

পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x