আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যলাভের বিশেষ মাধ্যম হলো নফল ইবাদাত। আর নফল ইবাদতের মধ্যে উন্নতম হলো নফল নামাজ। আবার নফল নামাজগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। কিন্তু তাহাজ্জুদের নামাজ কখন পড়তে হবে? না ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে?
এই উত্তরটি জানা না থাকার কারণে আমরা তাহাজ্জুদের নামাজ নিয়ে অনেক ভ্রান্তিতে পতিত হয়ে থাকি। তাই আজকের ব্লগটিতে আমরা এই উত্তরটি নিয়ে আলোচনা করছি।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি?
তাহাজ্জুদ পরস্পর বিপরীত অর্থবোধক একটি শব্দ। তার একটি অর্থ হচ্ছে – ঘুমানো। আর অপর অর্থ হলো – জাগ্রত থাকা।
আর পারিভাষিকভাবে তাহাজ্জুদ হলো – ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে নামাজ আদায় করা। আবার তাহাজ্জুদ শব্দটির মূলধাতু হচ্ছে – ‘জাহদ’ যার অর্থ হলো – পরিশ্রম করা, কষ্ট করা।
যেহেতু ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে অথবা না ঘুমিয়ে নামাজ আদায় করা একটি কষ্টকর কাজ তাই এই নামাজকে তাহাজ্জুদ নামাজ বলা হয়ে থাকে।
সর্বোপরি তাহাজ্জুদ নামাজ হচ্ছে বিশেষ এক প্রকার নফল নামাজ। তা মধ্য রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত সময়ে আদায় করা হয়ে থাকে।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময় কখন?
এশার নামাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। সেটা রাত্রির শেষ পর্যন্ত চলমান থাকে।
কাজেই এশার পর থেকে ফজর পর্যন্ত সমস্ত রাতই তাহাজ্জুদ নামাজের সময়। তবে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উত্তম সময় হচ্ছে শেষ রাত্রি।
শেষ রাত্রি মানে হলো – ফজরের নামাজের নিকটবর্তী সময় অথবা রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত –
কোনো ব্যক্তি যদি ভয় করে যে, সে শেষ রাতে জাগ্রত হতে পারবে না তাহলে সে যেন রাতের প্রথম অংশে বিতর আদায় করে নেয়। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস রাখে যে, সে শেষ রাতে জাগ্রত হতে পারবে সে যেন শেষ রাতে বিতর আদায় করে। কেননা শেষ রাতের নামাজ মাশহুদাহ এটাই উত্তম।
এই হাদিস থেকে অনুধাবন করা যায় উত্তম নামাজ হচ্ছে শেষ রাতের নামাজ। যদিও রাতের প্রথমাংশে তাহাজ্জুদ পড়লে তা বিশুদ্ধ হবে।
না ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে?
হ্যা, না ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে। শায়খ উয়াইযাহ উসমান বলেন –
কিয়ামুল লাইলেরর জন্য ঘুমানো শর্ত নয়। তিনি আরো বলেন – কোনো ব্যক্তি এশার নামাজের পর নফল নামাজ আদায় করে তাহলে সেটা তার তাহাজ্জুদ হিসাবে গণ্য হবে।
ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে নামাজ আদায় করা শর্ত নয়। তবে উত্তম হলো – রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নামাজ আদায় করা।
তবে অনেকে আবার তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়াকে শর্ত হিসাবে গণ্য করেছেন।
রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – বলেন,
وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ
ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ। ( সহিহ মুসলিম – ১১৬৩)
আয়িশা – রাদিয়াল্লাহু আনহা – থেকে বর্ণিত,
أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُومُ مِنْ اللَّيْلِ حَتَّى تَتَفَطَّرَ قَدَمَاهُ فَقَالَتْ عَائِشَةُ: لِمَ تَصْنَعُ هَذَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَقَدْ غَفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَفَلَا أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا
রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – রাতে (এতো লম্বা সময়) নামাজে দাঁড়াতেন যে, তার পা ফোলে যেতো। তখন আয়িশা বললেন – ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনি কেন এটা করেন? অথচ আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যৎ সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছে? তখন রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – বলেন, আমি শুকর আদায়কারী বান্দা হবো না। ( সহিহ বুখারি – ৪৫৫৭)
হাজ্জাজ ইবনে আমর আল আনসারি বলেন –
তোমাদের কেউ যেন এ ধারণা না করে যে, সে রাত থেকে নিয়ে সকাল পর্যন্ত নামাজ পড়ে নিলে সেটা তাহাজ্জুদ হয়ে যাবে।
তাহাজ্জুদ তো কেবল সেটা হবে যা ঘুম থেকে জেগে আদায় করা হয়। এমনটাই ছিলো রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – এর নামাজ।
তবে সর্বাপেক্ষা সঠিক কথা হলো – তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য ঘুমানোর প্রয়োজন নেই। কেউ যদি জাগ্রত থেকে মধ্য রাতে নামাজ আদায় করে তবে সেটা তাহাজ্জুদ গণ্য বলে হবে।
আর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করলে সেটা অবশ্যই উত্তম ও প্রশংসনীয়। কেননা ঘুম থেকে জেগে নামাজ আদায়ের মধ্যে অধীক ত্যাগ স্বাীকার করতে হয়।
ঘুমানো ছাড়া তাহাজ্জুদ পড়লে কি সওয়াব কম হয়?
আমরা পূর্বে আলোচনা করে এসেছি শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা উত্তম। তবে মধ্য রাতে আদায়া করাটাও বৈধ।
কিন্তু যদি সাওয়াবের প্রশ্ন আসে তবে অবশ্যই শেষ রাতে এবং ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করবে তার সুওয়াব বেশি হবে।
কেননা ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে আল্লাহর ইবাদতে মাশগুল হওয়াটা আল্লাহর প্রতি অধীক ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে।
ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার ফজিলত
রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – বলেন, রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে নেমে আসেন।
এসে বলেন – আমি মালিক, আমি মালিক। কে আছো আমার কাছে প্রার্থনা করবে? অতপর আমি তার প্রার্থনা কবুল করবো।
কে আছো, আমার কাছে চাইবে আমি তাকে সেটা প্রদান করবো। কে আছো, আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। ফজর হওয়া পর্যন্ত এরকম চলতে থাকে।
অপর একটি হাদিসে আছে রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – কে প্রশ্ন করা হলো – রাতের কোন অংশ ( নামাজ কবুলের) অধীক উপযুক্ত?
তখন তিনি বলেন, রাতের শেষ ভাগে। সুতরাং তুমি ইচ্ছে মতো রাতের শেষভাগে নামাজ আদায় করো।
এ দুটি হাদিস থেকে তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত প্রমাণিত হয়। রাতের শেষভাগে নামাজ কবুলের অধীক উপযুক্ত।
তাছাড়া পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীদের প্রশংসা করে বলেন –
جَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ
তাদের শরীর বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায়। (সুরা সিজদাহ – ৬)
তাহাজ্জুদ নামাজ সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১. না ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে?
হ্যাঁ, না ঘুমিয়েও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়। ইসলামী স্কলারদের মতে, এশার নামাজের পর কেউ যদি রাতের যেকোনো সময় নফল নামাজ পড়ে, তবে সেটি তাহাজ্জুদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করাই উত্তম।
২. তাহাজ্জুদ নামাজের সময় কখন শুরু হয়?
এশার নামাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত তা স্থায়ী থাকে। তবে সর্বোত্তম সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
৩. তাহাজ্জুদ নামাজ কয় রাকাত?
তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা নেই। কেউ ২ রাকাত পড়লেও তা গ্রহণযোগ্য হবে, তবে ৮ থেকে ১২ রাকাত পড়া উত্তম। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণত ১১ রাকাত পড়তেন।
৪. তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত কী?
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য বিশেষ কোনো নিয়ত নেই। মনে মনে ইবাদতের উদ্দেশ্য স্থির করাই যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ:
“আমি দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ত করছি, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”
৫. না ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদ পড়লে সওয়াব কমে যাবে কি?
না, সওয়াব কমে যাবে না। তবে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করলে তা অধিক মর্যাদাপূর্ণ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের বড় মাধ্যম।
৬. যদি কেউ রাতে জাগ্রত না হতে পারে, তাহলে তাহাজ্জুদ নামাজ কীভাবে পড়বে?
যদি কেউ শেষ রাতে জাগ্রত হতে না পারেন, তবে এশার নামাজের পর কিছু রাকাত নফল পড়ে নিতে পারেন। এতে তাহাজ্জুদের সওয়াব পাওয়া যাবে।
৭. তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার পর কী দোয়া করা উচিত?
তাহাজ্জুদের পর যেকোনো দোয়া করা যায়। বিশেষ করে, পাপমুক্তির দোয়া, রিজিক বৃদ্ধির দোয়া, জান্নাত প্রাপ্তির দোয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া বেশি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৮. মহিলারা কি তাহাজ্জুদ পড়তে পারবেন?
হ্যাঁ, মহিলারাও তাহাজ্জুদ পড়তে পারবেন। তারা ঘরে থেকেই এই নামাজ আদায় করতে পারেন এবং এটি তাদের জন্য অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত।
৯. কীভাবে তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি?
- রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- ঘুমানোর আগে তাহাজ্জুদের জন্য নিয়ত করুন।
- অ্যালার্ম ব্যবহার করুন বা কাউকে বলুন যেন আপনাকে জাগিয়ে দেয়।
- প্রথমে কম রাকাত পড়ার মাধ্যমে শুরু করুন, ধীরে ধীরে অভ্যাস গড়ে তুলুন।
১০. তাহাজ্জুদ নামাজের পরে বিতর পড়তে হয় কি?
যদি কেউ বিতর নামাজ এশার পর পড়ে নেয়, তাহলে আবার পড়ার দরকার নেই। তবে কেউ যদি তাহাজ্জুদ পড়ার ইচ্ছা রাখে, তাহলে বিতরকে সর্বশেষ রাখাই উত্তম।