বাসায় পোষা বিড়াল থাকলে এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়—তোমার প্লেটের খাবার থেকে এক চিমটি খেয়ে নেয় সে, কিংবা হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়ে রান্নাঘরের কোনো খাবারে। প্রশ্ন জাগে মনে: “এখন কি আমি সেই খাবার খেতে পারি?” কিংবা “বিড়ালের খাওয়া খাবার খেলে কি হয়?”
ইসলামী শরিয়তের আলোকে প্রতিটি খাবার ও পানীয়র পবিত্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর যেহেতু বিড়াল ঘরের প্রাণী, তাই এর মুখ, লালা এবং খাওয়ার বাকি রাখা খাবারের হুকুমও জানাটা জরুরি। বিশেষ করে, এটা জানার দরকার—বিড়ালের খাওয়া খাবার খেলে শরীরিক কোনো ক্ষতি হয় কি না, কিংবা তা শরিয়তের দৃষ্টিতে খাওয়া জায়েয কি না।
বিড়ালের খাওয়া খাবার খেলে কি হয়?
ফিকহের বড় বড় ইমামদের মতে বিড়ালের খাওয়া খাবার বা পানি নাপাক নয়।
🔹 শাফেয়ী, মালেকি ও হানাফি মাযহাব—তিনটিই এ বিষয়ে একমত যে বিড়াল ঘরের মধ্যে যেহেতু ঘোরাফেরা করে, তাই তার ব্যবহৃত খাবার বা পানীয় বৈধভাবে ব্যবহার করা যায়।
🔸 তবে, যদি বিড়াল অসুস্থ থাকে বা স্পষ্টভাবে ময়লা অবস্থায় থাকে, তাহলে স্বাস্থ্যগত সতর্কতা অবলম্বন করা উত্তম।
🕋 দলিল
**عَنْ كَبْشَةَ بِنْتِ كَعْبٍ قَالَتْ: دَخَلَ أَبُو قَتَادَةَ، فَسَكَبْتُ لَهُ وَضُوءًا، فَجَاءَتْ هِرَّةٌ تَشْرَبُ، فَأَصْغَى لَهَا الإِنَاءَ حَتَّى شَرِبَتْ، فَرَآهُ يَنْظُرُ، فَقَالَ: أَتَعْجَبِينَ يَا ابْنَةَ أَخِي؟ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّهَا لَيْسَتْ بِنَجَسٍ، إِنَّمَا هِيَ مِنَ الطَّوَّافِينَ عَلَيْكُمْ وَالطَّوَّافَاتِ.
📚 (সুনান আবু দাউদ, হাদিস ৭৫)
অনুবাদ: কাবশা বিনতে কা’ব (রাঃ) বলেন, আমি আবু কাতাদা (রাঃ) কে অজুর পানি দিচ্ছিলাম, এমন সময় একটি বিড়াল এসে পানি পান করতে লাগল। তিনি পানি পাত্র তার দিকে এগিয়ে ধরলেন, আর আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, “হে ভাইঝি! তুমি কি অবাক হলে? রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: বিড়াল অপবিত্র নয়। তারা তো তোমাদের ঘরে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীদের অন্তর্ভুক্ত।”
➡️ এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়—বিড়ালের মুখ দেওয়া পানি বা খাবার নাপাক নয়। তা খাওয়া বা ব্যবহার করা বৈধ।
☝️ তবে কি কোনো শর্ত আছে?
হ্যাঁ, কিছু শর্ত বা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে:
১. যদি বিড়াল পরিষ্কার থাকে এবং মুখে কোনো নাপাক জিনিস না লেগে থাকে, তাহলে তার খাওয়া পানি বা খাবার নিঃসন্দেহে পবিত্র ও ব্যবহারযোগ্য।
২. কিন্তু যদি দেখা যায় বিড়াল নোংরা বা গৃহস্থালি ময়লা-ময়েশায় ঘোরাফেরা করেছে, অথবা তার মুখে নাপাক কিছু লেগেছে, তাহলে সাবধানতা অবলম্বন করা উত্তম। তবে ফিকহে বলা হয়, বিড়ালের সুর মাকরূহে তানযীহী (হালকাভাবে অপছন্দনীয়), নাপাক নয়।
📌 হানাফি মাযহাবের মতে
বিড়ালের সুর পবিত্র, তবে কিছু ক্ষেত্রে তা “তানযীহান মাকরূহ” (অপছন্দনীয়) হয়, যদি পানি বা খাবারের অন্য বিকল্প পাওয়া যায়।
🧪 স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বিড়ালের খাওয়া খাবার
বিড়াল সাধারণত অনেক স্থানে ঘোরাফেরা করে, যেমন—বাথরুম, ডাস্টবিন, রান্নাঘর ইত্যাদি। এতে তার মুখ বা লোমে নানা রকম ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী থাকতে পারে। কিছু সাধারণ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে:
- Toxoplasmosis: এক ধরনের পরজীবী সংক্রমণ, যা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- Salmonella বা E. Coli: বিড়ালের মুখ বা থাবার মাধ্যমে খাবারে আসতে পারে।
✅ যদিও এগুলো সব সময় ঘটে না, তবুও সাবধানতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি।
🔄 বিশেষ করে ছোট বাচ্চা, গর্ভবতী নারী বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল কারো ক্ষেত্রে বিড়ালের খাওয়া খাবার খাওয়ার আগে ভাবা উচিত।
🧕 তাহলে করণীয় কী?
পরিস্থিতি | শরয়ী হুকুম | পরামর্শ |
---|---|---|
বিড়াল পরিচ্ছন্ন, সুস্থ | খাবার/পানি পবিত্র | খাওয়া বা ব্যবহার বৈধ |
বিড়াল নোংরা, বাইরে থেকে এসেছে | সুর মাকরূহ | সম্ভব হলে না খাওয়া উত্তম |
বিকল্প খাবার বা পানি নেই | ব্যবহার বৈধ | ব্যবহার করতে পারো, গুনাহ নেই |
স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে | শরিয়তে বৈধ, কিন্তু সতর্কতা জরুরি | ভালোভাবে গরম করে বা ধুয়ে নিতে পারো |
✅ উপসংহার
বিড়ালের খাওয়া খাবার বা পানি ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে পবিত্র, এবং তা খাওয়া জায়েয। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেই এমন আচরণ করেছেন। তবে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে কিছু সতর্কতা রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। বিকল্প থাকলে এমন খাবার এড়িয়ে চলা উত্তম, আর বিকল্প না থাকলে ব্যবহার করায় কোনো গুনাহ নেই।
🔍 ইসলামী শিক্ষার সৌন্দর্য এখানেই—তা মানবিক প্রয়োজন, বাস্তবতা ও আত্মশুদ্ধি সবকিছুর মাঝে এক ভারসাম্য রক্ষা করে।
⁉️ সাধারণ কিছু প্রশ্ন ও সংশয়
১. বিড়াল যদি বাথরুমে ঘোরে?
ইসলামে পানির হুকুম “যেমনটি বাইরে”—তাই বিড়াল কোথায় গেছে, সেটা দিয়ে নয়; মুখ দেওয়া খাবার পানযোগ্য কি না তা মুখের অবস্থা দিয়ে বিবেচনা হবে। আর রাসুল (ﷺ) সময়েও তো তারা বাইরে ঘুরে বেড়াতো।
২. রাস্তার বিড়াল হলে?
হুকুম একই। হাদীস সব বিড়ালের ব্যাপারে বলা হয়েছে, শুধু ঘরের জন্য নয়। তবে অতিরিক্ত নোংরা দেখলে এড়িয়ে যাওয়া উত্তম।
৩. একই জায়গায় বারবার মুখ দিলে?
যদি পরিষ্কার ও শুকনা থাকে, তবে সমস্যা নেই। তবে চটচটে বা নোংরা হয়ে গেলে খাওয়া পরিত্যাগ উত্তম।
৪. শুকনো খাবারে মুখ দিলে কি তা নাপাক?
না। যদি খাবার বা পানির মধ্যে থুতু প্রবেশ না করে এবং খাবার শুকনো থাকে, তাহলে নাপাক হবে না।
✅ করণীয় তালিকা
🔹 খাবার ঢেকে রাখা: রাসুল (ﷺ) খাবার ঢাকার তাগিদ দিয়েছেন যেন শয়তান বা কোনো প্রাণী মুখ না দেয়।
বিড়াল যদি মুখ দেয়, তখন…
- মুখে সুস্পষ্ট নোংরা না থাকলে খাওয়া জায়েয।
- নোংরা থাকলে সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো।
🔹 কোন অবস্থায় খাওয়া উচিত নয়?
- যদি সন্দেহ থাকে তা নাপাক বা ক্ষতিকর হতে পারে।
- খাবার যদি নোংরা হয়ে যায়।
🔹 আরবি পরিভাষা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা:
- سؤر (সুওর): পানির বা খাবারের যে অংশ কোনো প্রাণী মুখ দেওয়ার পর বেঁচে থাকে।
- বিড়ালের সুওরকে হাদীস অনুযায়ী “طاهر (পবিত্র)” বলা হয়েছে, তাই তার মুখ দেওয়া খাবার খাওয়া জায়েয।
❓ কুইজ: আপনি কী করবেন?
আপনি যদি দেখেন আপনার বিড়াল কফির কাপে মুখ দিয়েছে, আপনি কী করবেন?
(ক) না খেয়ে ফেলে দেবেন
(খ) অনায়াসে খেয়ে ফেলবেন
(গ) সন্দেহে পড়ে যাবেন
👉 সঠিক উত্তর: (খ) — কারণ হাদীস অনুযায়ী বিড়ালের মুখ দেওয়া খাবার নাপাক নয়। তবে যদি নোংরা থাকে, তাহলে পরিত্যাগ করলেও সমস্যা নেই।