ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো “মুশারাকা”। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যেখানে অংশীদারিত্ব এবং সমান অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইসলাম ধর্মে আর্থিক লেনদেন এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সম্মতি এবং দায়িত্ববোধের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা মুশারাকা কি? এর ধারণা, কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর ভিত্তি, এবং সমসাময়িক বাস্তবতায় এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব।
মুশারাকা : সংজ্ঞা ও ধারণা
মুশারাকা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “শিরক” থেকে, যার অর্থ হলো অংশীদারিত্ব। ইসলামী শরিয়াহ মতে, মুশারাকা একটি চুক্তি যেখানে দুই বা ততোধিক পক্ষ তাদের সম্পদ, দক্ষতা এবং প্রচেষ্টা একত্রিত করে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করে। লাভ-ক্ষতি পূর্বনির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী অংশীদারদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
হানাফি মাযহাবে মুশারাকার সংজ্ঞা
الشركة: عبارة عن عقد بين المتشاركين في رأس المال والربح
‘শারিকা বলা হয় – একাধিক শরীকদের মধ্যে মূলধন ও লাভাংশ্যে অংশীদারত্ব চুক্তিকে। ’ (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু : ৪/৫৮৮)
মুশারাকার বৈশিষ্ট্যসমূহ
- অংশীদারিত্ব: প্রত্যেক অংশীদার একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে মূলধন বা সম্পদ সরবরাহ করে।
- লাভ-ক্ষতির বণ্টন: লাভ পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ করা হয়, তবে ক্ষতি মূলধনের অনুপাতে ভাগ হয়।
- সমান অধিকার: সকল অংশীদার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান অধিকার রাখে।
মুশারাকার শর্তাবলি
ফুকাহায়ে কেরাম মুশারাকা চুক্তির সাথে অনেক শর্তারোপ করেছেন, যার কিছু সর্বপ্রকার মুশারাকার সাথে সম্পর্ক রাখে, আর কিছু সম্পর্ক রাখে বিশেষ বিশেষ প্রকারের সাথে।
যে সব শর্ত মুশারাকার সকল প্রকারের সাথে সর্ম্পক রাখে
এক: ওকালতের যোগ্যতা থাকা। তা মুশারাকা চুক্তিকারী এবং চুক্তিকৃত ব্যবসা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চুক্তিকারীর মধ্যে ওকালতের যোগ্যতা থাকার অর্থ হলো, তারা এমন হওয়া যে নিজে ব্যবসা করতে বা নিজের পক্ষ থেকে ব্যবাসার দায়িত্ব দিয়ে উকিল নিয়োগ করতে বা অন্যের পক্ষ থেকে উকিল হতে শরিয়ত তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। যেমন পাগল বা নির্বোধ বা অবোধ বাচ্চা না হওয়া।
কেননা মুশারাকা হলো এমন একটি চুক্তি যেখানে প্রত্যেক মুশারিক অর্ধেক মালে নিজের পক্ষ থেকে সরাসরি ব্যবসা করা আর অর্ধেক মালে তার শরিকের পক্ষ থেকে উকিল হয়ে ব্যবসা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাই তার মধ্যে ব্যবসা করা, উকিল হওয়া ও উকিল নিয়োগ দেওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। আর চুক্তিকৃত ব্যবসায় ওকালতের যোগ্যতা থাকার অর্থ হলো, ব্যবসা এমন না হওয়া যাতে ওকালত শুদ্ধ নয়। যেমন সরকারি জঙ্গল থেকে পশু শিকার করা বা লাকড়ি কাটার জন্য উকিল নিয়োগ দেওয়া।
কেননা সরকারি উন্মুক্ত জঙ্গল থেকে লাকড়ি কাটা বা পশু শিকার করার অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। তাই এ কাজের জন্য উকিল নিয়োগ দিলে তা শুদ্ধ হবে না, বরং শিকারকৃত পশু ও লাকড়ির মালিক সেই হবে, যে তা আহরণ করবে।
দুই: মুনাফা থেকে প্রত্যেক শরিকের অংশ নির্দিষ্ট করা। যেমন অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ ইত্যাদি। নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণকে ঠিক করে নেওয়া যাবে না। যেমন একজন বললো মুনাফা থেকে আমি পাঁচ হাজার নেওয়ার পর যা বাকি থাকবে সেগুলো তুমি নিবে। কেননা হতে পারে পুরো মুনাফাই হবে পাঁচ হাজার বা তার চেয়েও কম। তখন একজন সম্পূর্ণ নিয়ে যাবে। আর অন্যজন শূন্য হাতে থাকতে হবে।
মুশারাকা চুক্তির মালের সাথে সম্পর্কিত শর্তাবলি
এক: শরিকানা চুক্তির রা’সুল মাল নগদ থাকা। চাই চুক্তির সময় হোক বা মালামাল ক্রয় করার সময় হোক। সতরাং মুশারাকার মধ্যে রা’সুল মাল বাকি রেখে চুক্তি করা যাবে না। কেননা মুশারাকার মাধ্যমে উদ্দেশ্য হয়ে থাকে মুনাফ অর্জন করা। আর মুনাফা অর্জন করতে হলে মাল ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু মাল যদি বাকি থাকে তাহলে সেটা সম্ভব হবে না।
দুই: রা’সুল মাল মুদ্রা জাতীয় হওয়া। যেমন দিরহাম দিনার রুপিয়া টাকা ইত্যাদি। তা বস্তুসামগ্রী হতে পারবে না। যেমন জমি বা স্থানান্তরযোগ্য মালামাল ইত্যাদি। কেননা এসব জিনিসের মূল্য জিনিস হিসাবে কম বেশ হতে পারে। তাই এর দ্বারা মুশারাকা করা হলে তার মুনাফা বণ্টনের সময় ঝগড়ার দিকে ধাবিত করবে।
মুশারাকা মুফাওয়াজা কী?
মুশারাকা মুফাওয়াজার সংজ্ঞা: দুই বা তার অধিক ব্যক্তি অর্থ বিনিয়োগ ঋণ সবকিছুতে সমান অংশীধার হওয়ার ভিত্তিতে ব্যবসা চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। (ফাতহুল কাদির : ১৩/৪৫৫)
মুফাওয়াজার চুক্তির সাথে সম্পর্কিত শর্তাবলি
- এক: প্রত্যেক শরিকের মধ্যে ওকালত ও কিফালতের আহলিয়্যাত থাকা। যেমন তারা স্বাধীন হওয়া, বালিগ হওয়া, সুষ্ঠু জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। কেননা তারা প্রত্যেকেই একজনের জন্য অন্যজন উকিল ও কফিল। তাই উকিল ও কফিল হওয়ার আহলিয়্যাত তাদের মধ্যে থাকতে হবে।
- দুই: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকের রাসুল মাল সমান হওয়া। যদি রাসুল মালের মধ্যে কম বেশি হয়ে যায় তাহলে মুফাওয়াজা হবে না। কেননা মুফাওয়াজা হলো সমান সমান হওয়ার নাম। তাই যথাসম্ভব সমান সমানের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
- তিন: মুনাফার মধ্যে প্রত্যেকের সমান অংশ থাকা। তাই যদি মুনাফা থেকে এক জনের জন্য কম অংশ আর অপর জনের জন্য বেশি অংশ নির্ধারণ করা হয় তাহলে তা মুফাওয়াজা হবে না।
- চার: সকল ব্যবসায় প্রত্যেকে সমানভাবে অংশ গ্রহণ করা। যদি একজনের জন্য কিছু ব্যবসাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, যা অন্যজন করবে না, তাহলে তা মুফাওয়াজা হবে না। কেননা এমন করা হলে মুফাওয়াজর অর্থ বহাল থাকে না।
- পাঁচ: মুশারাকা মুফাওয়া চুক্তি করা হলে আলাদাভাবে মুফাওয়াজা শব্দ উল্লেখ করা। কেননা মুফাওয়াজার জন্য এমন কিছু শর্ত রযেছে যা অন্য মুশারাকা চুক্তির মধ্যে পাওয়া যায় না।
(আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহুÑ৪/৫৯৯-৬০৬)
কুরআনে মুশারাকার ভিত্তি
কুরআনে সরাসরি মুশারাকা শব্দটি উল্লেখ না থাকলেও পারস্পরিক সহযোগিতা, ন্যায়বিচার, এবং লেনদেনের নীতিমালা সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াত রয়েছে।
সহযোগিতা ও ন্যায়বিচার
“তোমরা সৎকর্ম এবং তাকওয়ায় পরস্পরকে সাহায্য করো, কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যকে সাহায্য করো না।” (সূরা আল-মায়িদা: ২)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মুশারাকার মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ন্যায়বিচার।
চুক্তির প্রতি আনুগত্য
“হে মুমিনগণ! তোমরা চুক্তি পূরণ করো।” (সূরা আল-মায়িদা: ১)
মুশারাকার ক্ষেত্রে চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনের এই নির্দেশনা চুক্তি সম্পাদন এবং এর প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করে।
সত্য ও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া
“তোমরা ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে সাক্ষ্য প্রদান করো, যদিও তা তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়।” (সূরা আন-নিসা: ১৩৫)
মুশারাকার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বণ্টনে ইনসাফ বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মুশারাকার প্রকারভেদ
ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মুশারাকা প্রধানত দুটি ধরনের হয়:
- স্থায়ী মুশারাকা (Permanent Musharakah): এখানে অংশীদাররা দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে একটি ব্যবসা শুরু করে এবং তাদের মূলধন বিনিয়োগ করে।
- অস্থায়ী মুশারাকা (Diminishing Musharakah): এখানে অংশীদাররা একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প বা সময়ের জন্য অংশীদারিত্ব করে এবং সময়ের সাথে সাথে মূলধনের অংশ ক্রয় করে নেয়। এই ধরনের মুশারাকা আজকাল বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়।
সমসাময়িক বাস্তবতায় মুশারাকার প্রয়োগ
বর্তমান ব্যাংকিং এবং আর্থিক ব্যবস্থায় মুশারাকার ব্যবহার ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগমূলক কর্মকাণ্ডে মুশারাকা চুক্তি ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ:
- ব্যবসায়িক বিনিয়োগ: ইসলামী ব্যাংকগুলো মুশারাকার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসায় অর্থায়ন করে, যেখানে লাভ-ক্ষতির দায়ভার উভয় পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়।
- গৃহঋণ: মুশারাকার একটি প্রকার, “ডিমিনিশিং মুশারাকা” ব্যবহার করে বাড়ি কেনার জন্য অর্থায়ন করা হয়। এখানে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়েই বাড়ির মালিকানায় অংশীদার হয়।
- অবকাঠামোগত উন্নয়ন: বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে মুশারাকার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা হয়, যা সমাজের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
মুশারাকার সুবিধা
- ন্যায়বিচার: লাভ-ক্ষতির দায়ভার ভাগাভাগি হওয়ায় এটি একটি ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা।
- বারাকাহ: ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় এতে আল্লাহর বারাকাহ থাকে।
- সমাজের উন্নয়ন: এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থায়নের সুযোগ বাড়ায়।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
- বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার অভাব: অংশীদারদের মধ্যে বিশ্বাসঘাটতি মুশারাকার সফলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এর সমাধান হলো স্বচ্ছ চুক্তি এবং নিয়মিত হিসাব প্রদান।
- আইনি কাঠামোর অভাব: অনেক দেশে মুশারাকার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন নেই। এটি সমাধানের জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং আইনি কাঠামো উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
কিছু প্রশ্ন উত্তর
১. মুশারাকা কি?
মুশারাকা হলো অংশীদারিত্বমূলক চুক্তি যেখানে অংশীদাররা লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগি করে।
২. মুশারাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
অংশীদারিত্ব, লাভ-ক্ষতির বণ্টন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান অধিকার।
৩. কুরআনে মুশারাকার ভিত্তি কী?
সহযোগিতা, ন্যায়বিচার এবং চুক্তি পূরণের উপর কুরআনের নির্দেশনা মুশারাকার ভিত্তি গড়ে তোলে।
৪. মুশারাকার সুবিধা কী?
ন্যায়বিচার, বারাকাহ, এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়ন।
৫. মুশারাকা কোথায় ব্যবহৃত হয়?
ব্যবসায়িক বিনিয়োগ, গৃহঋণ, এবং অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে।
৬. মুশারাকার চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?
বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার উন্নয়ন এবং সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি করে।