রাব্বানা আফরিগ আলাইনা । আরবি । বাংলা অর্থ ও ফজিলত

পোস্টটি শেয়ার করুন

মানবজীবনের প্রতিটি বাঁকে আমরা কোনো না কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হই—কখনো তা হয় বাহ্যিক দুশমন দ্বারা, আবার কখনো তা হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভয়, দুঃখ কিংবা অস্থিরতা দ্বারা। এমন মুহূর্তে একজন মু’মিনের সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয় হলো আল্লাহর দরবারে একান্তভাবে ফিরে যাওয়া এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। কুরআনে বারবার আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হয়, কীভাবে নিঃস্ব ও নিরুপায় হয়ে তাঁর দরজায় কান্নাকাটি করতে হয়। রাব্বানা আফরিগ আলাইনা “رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا

এই আয়াতটি এমনই এক হৃদয়বিদারক দোয়া, যা আল্লাহর প্রিয় বান্দারা শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে করেছেন। এটি শুধু একটি বাক্য নয়—এটি ধৈর্যের অনুগ্রহ বর্ষণের আকুতি, সাহসের প্রেরণা, আর ঈমানদারের এক গভীর আত্মসমর্পণ। এই ব্লগপোস্টে আমরা এই আয়াতের শব্দগত বিশ্লেষণ, এর প্রেক্ষাপট, দোয়াটির তাৎপর্য এবং আমাদের জীবনে এর বাস্তব প্রয়োগ—সবই বিশ্লেষণ করব ইনশাআল্লাহ।

রাব্বানা আফরিগ আলাইনা । আয়াত ও এর প্রেক্ষাপট

এই দোয়া এসেছে সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫০-তে। যখন তালুত (Saul) আলাইহিসসালাম-এর নেতৃত্বে ঈমানদার একদল সৈন্য জালুত (Goliath) । তার বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হয়, তখন তারা সংখ্যায় কম, দুনিয়াবি শক্তিতে দুর্বল; কিন্তু ঈমানে দৃঢ়। শত্রুর ভয়ে নয়, বরং ঈমানের দৃঢ়তা নিয়েই তারা বলেছিল:

رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

উচ্চারণ: “রাব্বানা আফরিগ ‘আলাইনা সাবরান ওয়াস্‌সাব্বিত আ’কদামানা ওয়ান্‌সূরনা ‘আলাল্‌ কওমিল্‌ কাফিরীন।”

অর্থ: “হে আমাদের রব! আমাদের উপর ধৈর্য বর্ষণ করো, আমাদের পদমুস্তিক রাখো এবং আমাদেরকে কাফির সম্প্রদায়ের উপর বিজয় দান করো।”

শব্দ বিশ্লেষণ

১. رَبَّنَا (রাব্বানা): ‘আমাদের প্রভু’, ‘আমাদের পালনকর্তা’। এক অন্তরঙ্গ ডাকে শুরু, যেন সন্তানের আকুলতায় মা’কে ডাকা।

২. أَفْرِغْ (আফরিগ): মূল ক্রিয়াটি “إفراغ” থেকে, যার অর্থ — ঢেলে দেওয়া, ঢালার মতোভাবে পুরোটাই বর্ষণ করা। এটি কোনো কিছুর পরিপূর্ণতা বোঝায়।

৩. عَلَيْنَا (আলাইনা): ‘আমাদের উপর’। এটি বোঝায় যেন ওপরে থেকে নিচে — আল্লাহর ধৈর্যের বৃষ্টি যেন আমাদের উপর ঢেলে দেওয়া হয়।

৪. صَبْرًا (সাবরান): ‘ধৈর্য’। কিন্তু শুধু সহ্য নয়, বরং অন্তরে দৃঢ়তা, মুখে নালিশহীনতা এবং কাজে অবিচলতা—এই তিনটির সমন্বিত রূপ।

অন্তর্নিহিত শিক্ষা ও তাৎপর্য

১. ধৈর্য চাওয়ার ধরন: এই দোয়ায় শুধু ধৈর্য চাওয়া হয়নি, বরং এমনভাবে ধৈর্য চাওয়া হয়েছে যেন আল্লাহ তা আমাদের উপর ঢেলে দেন। এতে বোঝা যায়, প্রকৃত ধৈর্য নিজ প্রচেষ্টায় অর্জনযোগ্য নয়; বরং তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অপূর্ব অনুগ্রহ।

২. দ্বন্দ্বের মুহূর্তে দোয়ার শক্তি: এই দোয়া এমন মুহূর্তে করা হয়েছিল যখন সামনে ছিল শত্রু, পেছনে কোনো সহায়তা ছিল না—তবুও তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়নি। বরং আল্লাহর সাহায্যই ছিল তাদের মূল শক্তি।

৩. দৃঢ়তা ও বিজয় একই সূত্রে গাঁথা: ধৈর্য ও দৃঢ়তা থাকলেই বিজয় আসে। দোয়ায় তিনটি বিষয় একসাথে চাওয়া হয়েছে:

  • ধৈর্য
  • পদে দৃঢ়তা
  • শত্রুদের উপর বিজয়
    এর মানে হলো: আত্মিক প্রস্তুতি থাকলে আল্লাহ্‌ই বিজয় দান করেন।

আমাদের জীবনে এর প্রয়োগ

আজকের দিনে আমাদের যুদ্ধ বাইরের অস্ত্রের সঙ্গে নয়, বরং নফসের সঙ্গে, ফিতনার সঙ্গে, অন্যায়ের সঙ্গে। এই দোয়াটি আমাদের শিখিয়ে দেয়:

  • বিপদের সময় ভয় নয়, বরং ধৈর্য চাও।
  • সংকটের মুখে অভিযোগ নয়, বরং আল্লাহর দয়ার আশা করো।
  • পরীক্ষার সময়ে আতঙ্ক নয়, বরং আত্মসমর্পণ করো সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে।

যখন আমরা পরিবারে, সমাজে, দুনিয়ার যেকোনো ফিতনায় নিপতিত হই, তখন এই ছোট্ট দোয়াটিই হতে পারে আমাদের আত্মিক ঢাল।

রাব্বানা আফরিগ আলাইনা । হাদীস ভিত্তিক সমর্থন

📌 ১. ধৈর্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দান

ومن يتصبّر يصبّره الله، وما أعطي أحد عطاءً خيرًا وأوسع من الصبر

“যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাকে ধৈর্য দান করেন। আর ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও অধিক বিস্তৃত কোনো দান কাউকে দেওয়া হয়নি।” 📘 সহীহ বুখারী: ১৪৬৯, সহীহ মুসলিম: ১০৫৩

🔍 এই হাদীস আয়াতের অর্থকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে: ধৈর্য নিজের দ্বারা হয় না, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম। তাই ‘أَفْرِغْ’ — বর্ষণ করো — বলাটাই যথার্থ।

📌 ২. বিপদের সময় ধৈর্যই আসল ঈমান

إنما الصبر عند الصدمة الأولى

“আসল ধৈর্য হলো প্রথম আঘাত লাগার সময়কার ধৈর্য।” ( 📘 সহীহ বুখারী: ১২৮৩, সহীহ মুসলিম: ৯২৬ )

🔍 এই হাদীস বোঝায়, বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে যারা দোয়া করে — তারা-ই প্রকৃত ধৈর্যশীল। ঠিক যেমন তালুতের সাথীরা যুদ্ধের মুহূর্তেই এই দোয়া করেছিলেন।

📌 ৩. বিপদের সময় আল্লাহর দিকেই ফিরে যাও

احرص على ما ينفعك، واستعن بالله، ولا تعجزن

“তুমি যা উপকারে আসে তার প্রতি আগ্রহী হও, আল্লাহর সাহায্য চাও এবং অক্ষম হয়ো না।” (📘 সহীহ মুসলিম: ২৬৬৪)

🔍 এই হাদীস থেকে শিক্ষা পাই: বিপদের সময় মনোবল না হারিয়ে, কাজে মনোযোগী হয়ে, আল্লাহর সাহায্য চাওয়া — এই তিনটি হলো মু’মিনের আচরণ। “أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا” এই আচরণের নিখুঁত রূপ।

📌 ৪. ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনটি উপহার

قال الله تعالى في الحديث القدسي:

ما لعبدي المؤمن عندي جزاء إذا قبضت صفيه من أهل الدنيا ثم احتسبه إلا الجنة

“আমি আমার কোনো ঈমানদার বান্দার জন্য জান্নাত ছাড়া অন্য কোনো প্রতিদান রাখি না, যখন আমি তার প্রিয়জনকে (মৃত্যুর মাধ্যমে) নিয়ে নেই আর সে তা ধৈর্যের সঙ্গে কবুল করে।” 📘 সহীহ বুখারী: ৬৪২৪

🔍 এটি প্রমাণ করে — যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহ জান্নাত প্রস্তুত রাখেন।

📌 ৫. ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আল্লাহ থাকেন

إن الله مع الصابرين

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”

📘 সূরা বাকারা: ১৫৩

🔍 এই আয়াত এই দোয়ার অন্তিম ফলাফল ব্যাখ্যা করে: যদি কেউ ধৈর্যের দোয়া করে, আল্লাহ তাকে ছেড়ে দেন না। তিনি সাথে থাকেন, সাহায্য করেন।

তাফসীর ইবনে কাসীর (ابن كثير)

ব্যাখ্যা: তালূতের সঙ্গীরা যখন তাদের সংখ্যা ও শক্তির তুলনায় শত্রুদের বিশাল বাহিনী দেখে ভয় পায়নি, বরং তারা আল্লাহর সাহায্য কামনায় এই দোয়া করে।
“أَفْرِغْ عَلَيْنَا” — অর্থাৎ,

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর এমন ধৈর্য ঢেলে দাও যা আমাদের মন-প্রাণ ভরিয়ে দেয় এবং আমরা শত্রুর মুখোমুখি হতে পিছপা না হই।”

🔍 ইবনে কাসীর ব্যাখ্যা করেন, ‘ধৈর্য’ এখানে কেবল সহ্য নয়, বরং সাহস, দৃঢ়তা ও আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা।

📖 ২. তাফসীর আল-জালালাইন (الجلالين):

ব্যাখ্যা:

صبرًا” أي على الجهاد والثبات فيه

“ধৈর্য মানে এখানে—যুদ্ধে অবিচল থাকা এবং জিহাদের কষ্টগুলো সহ্য করা।”

🔍 তারা ‘সবর’ শব্দকে শুধু মানসিক অবস্থা হিসেবে দেখেননি, বরং বাস্তব পদক্ষেপের শক্তি হিসেবেও বুঝিয়েছেন।

📖 ৩. তাফসীর আস-সা’দী (السعدي)

ব্যাখ্যা: “এই দোয়া প্রমাণ করে, ধৈর্য ধন নয়, শিক্ষা নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অদৃশ্য রহমত, যা মানুষের উপর ‘ঢেলে দেওয়া’ হয়।”

🔍 আস-সা’দী বলেন, মানুষ নিজে নিজে ধৈর্যবান হতে পারে না যতক্ষণ না আল্লাহ তার অন্তরে সাহস, স্থিরতা ও ঈমান সঞ্চার করেন।

📖 ৪. তাফসীর আল-কুরতুবি (القرطبي)

বিশেষ শব্দ বিশ্লেষণ

  • أَفْرِغْ: মূলত ব্যবহার হয় পাত্র থেকে ঢালার জন্য। কুরতুবি বলেন,

“তারা চেয়েছে যেন ধৈর্য এমনভাবে তাদের অন্তরে প্রবাহিত হয়, যেমন পানি পাত্রে ঢালা হয়—সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করে।”

🔍 অর্থাৎ, এ দোয়া কেবল সংকল্প নয়, বরং আল্লাহর কাছ থেকে ‘পূর্ণমাত্রার’ এক উপহার চাওয়া।

📖 ৫. ইমাম ফাখরুদ্দিন আর-রাজী (الرازي):

দার্শনিক ব্যাখ্যা:

“ধৈর্য হলো ইচ্ছাশক্তির এমন এক রূপ, যা কষ্ট সহ্য করেও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। এই ধৈর্য কেবল অভ্যস্ততার মাধ্যমে আসে না, বরং আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি ও আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামের মাধ্যমে আসে।”

🔍 এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, তালূতের সাহাবিরা নিজের ক্ষমতার উপর নির্ভর করেননি — তারা চেয়েছেন ‘আল্লাহর বর্ষিত ধৈর্য’।

উপসংহার

رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا — এই ছোট্ট দোয়া আমাদের শেখায় কিভাবে ঈমানদারদের মতো সংকটে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। আল্লাহর উপর ভরসা, অন্তরের ধৈর্য, আর মুখের দোয়া—এই তিনটি যদি একত্রে থাকে, তবে বাহ্যিক পরাজয়ও আমাদের ঈমানকে বিজয়ী করে তোলে।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x