সহবাসের পর করণীয় । ইসলামিক ও স্বাস্থ্যসম্মত দিকনির্দেশনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর মিলনকে শুধু একটি দাম্পত্য অধিকার নয়, বরং ভালোবাসা ও পারস্পরিক সম্মানের অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে সহবাসের পর কিছু শিষ্টাচার ও করণীয় বিষয় রয়েছে, যা ইসলাম ও স্বাস্থ্য উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

১. পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা

ক. অজু করা

সহবাসের পর পুনরায় মিলন করতে চাইলে বা ঘুমাতে যাওয়ার আগে অজু করা সুন্নত

📖 হাদিসে এসেছে: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—

“যখন তোমাদের কেউ তার স্ত্রীসহবাস করে, তারপর আবার করতে চায়, তাহলে যেন সে ওজু করে।” (সহিহ মুসলিম: ৪৬৬)

➡️ কেন ওজু করা উচিত?

  • এটি পবিত্রতা বজায় রাখে।
  • শরীর সতেজ অনুভব করে।
  • ইবাদতের উপযোগী হয়।

খ. সম্পূর্ণ গোসল (গোসল জানাবাত) করা

সহবাসের পর পূর্ণ গোসল (গোসল জানাবাত) করা ফরজ, যদি বীর্যপাত ঘটে বা মিলন সম্পূর্ণ হয়।

📖 কোরআনে আল্লাহ বলেন:

“আর যদি তোমরা অপবিত্র (জানাবাত) অবস্থায় থাকো, তবে ভালোভাবে গোসল করো।” (সূরা আল-মায়েদা: ৬)

➡️ গোসলের নিয়ম:
1️⃣ নিয়ত করা (মনের মধ্যে বলা যে, আমি পবিত্রতার জন্য গোসল করছি)।
2️⃣ প্রথমে হাত ধোয়া ও নাপাক দূর করা।
3️⃣ ওজুর মতো করে ওজু করা।
4️⃣ তিনবার মাথায় পানি ঢালা।
5️⃣ সারা শরীরে ভালোভাবে পানি পৌঁছানো।

গোসল ছাড়া নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, মসজিদে প্রবেশ ইত্যাদি নিষিদ্ধ।

২. আল্লাহকে স্মরণ করা ও দোয়া পড়া

📌 সহবাসের আগে ও পরে দোয়া পড়া সুন্নত

➡️ সহবাসের পর এই দোয়া পড়তে পারেন:

اَللّٰهُمَّ اجْعَلْنَا مِنَ الشَّاكِرِينَ وَاجْعَلْنَا مِنَ الطَّاهِرِينَ

উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ইজআলনা মিনাশ শাকিরীন, ওয়াজআলনা মিনাত তাহিরীন।”

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের কৃতজ্ঞ বানাও এবং আমাদের পবিত্র রাখো।

৩. বিশ্রাম ও শরীরের যত্ন নেওয়া

✅ সহবাসের পর ক্লান্তি এড়াতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া উত্তম।
✅ প্রচুর পানি পান করা ভালো, কারণ এতে শরীর হাইড্রেট থাকে।
✅ পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত, যাতে শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধার হয়।
✅ অতিরিক্ত মিলন এড়ানো উচিত, কারণ এটি শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে।

৪. স্ত্রীর প্রতি সদয় হওয়া

💖 সহবাসের পর স্বামী-স্ত্রীর উচিত একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা।

📖 হাদিসে এসেছে:

“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি: ১১৬২)

✅ সহবাসের পর স্ত্রীকে অবহেলা করা উচিত নয়।
✅ কথোপকথন, আলিঙ্গন বা কোলাকুলি করা ভালোবাসা বাড়ায়।
✅ সহবাস কেবল চাহিদা পূরণের জন্য নয়, এটি আবেগ ও সম্পর্কের গভীরতাও বাড়ায়।

৫. শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা

📌 সহবাসের পর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া ভালো নয়। কারণ এতে অলসতা আসতে পারে এবং অনেকে ফরজ গোসল ছাড়া ফজরের নামাজ মিস করতে পারেন।

📖 রাসুল (সা.) বলেছেন:

“শয়তান মানুষের মাঝে প্রবাহিত হয়, যেমন রক্ত প্রবাহিত হয়।” (সহিহ বুখারি: ২০৩৯)

✅ তাই ফরজ গোসল দ্রুত সম্পন্ন করে সালাত ও ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত।

সংক্ষেপে সহবাসের পর করণীয়

☑️ অজু করা (পুনরায় মিলনের ইচ্ছা থাকলে)।
☑️ পূর্ণ গোসল করা (নামাজ ও ইবাদতের জন্য)।
☑️ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা।
☑️ পরিচ্ছন্ন থাকা ও বিশ্রাম নেওয়া।
☑️ স্ত্রীকে আদর-যত্ন করা।
☑️ ইসলামী বিধান মেনে চলা ও শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে হালাল দাম্পত্য জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন। আমিন। 🤲

কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

সহবাসের সময় (মনি) নির্গত না হলেও কী গোসল করতে হবে?

হ্যা, গোসল করতে হবে। রাসুলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন – ‘স্বামী যদি স্ত্রীর যৌনির উপর আরোহন করে কর্ম তৎপর হয়ে ওঠে। তাহলে তার উপর গোসল ওয়াজিব হয়ে যাবে। যদিও বীর্য নির্গত না হোক।’ (সহিহ মুসলিম)

প্রথমবার সহবাস শেষ হওয়ারপর দ্বিতীয়বার সহবাস শুরু করার আগে কী করতে হবে?

প্রথমবার সহবাস শেষ হওয়ারপর দ্বিতীয়বার সহবাস শুরু করার পূর্বে ওযু করে নেওয়া মুস্তাহাব।

রাসুলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন –

‘তোমাদের কেউ সহবাস করারপর যদি দ্বিতীয়বার সহবাস শুরু করতে চায় তাহলে সে যেন ওযু করে নেয়। এটা তার দ্বিতীয় সহবাসকে স্বাদময় করবে।’ ( সহিহ মুসলিম – ১/১৭১)

সহবাসের পর না ধুয়ে কি ঘুমানো যাবে?

উত্তর: সম্পূর্ণ গোসল ছাড়া সরাসরি ঘুমানো ভালো নয়। তবে, যদি খুব ক্লান্ত থাকেন, তাহলে অন্তত ওজু করে ঘুমানো সুন্নত।

📖 রাসুল (সা.) বলেছেন:

“যখন কেউ তার স্ত্রীসহবাস করে এবং আবার করতে চায়, তাহলে যেন সে ওজু করে। এটি তার জন্য চাঙ্গা হওয়ার উপায়।”
(সহিহ মুসলিম: ৪৬৬)

অর্থাৎ, ওজু করলে শারীরিক সতেজতা ও পবিত্রতা বজায় থাকে।

সহবাসের পর কতক্ষণের মধ্যে গোসল করা উচিত?

উত্তর: নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, তবে নামাজ বা কোরআন তিলাওয়াতের আগে অবশ্যই গোসল করতে হবে।
➡️ ফজরের নামাজের আগে অবশ্যই গোসল করা বাধ্যতামূলক।

সহবাসের পর কি একই বিছানায় গোসল ছাড়া শোয়া যায়?

উত্তর: হ্যাঁ, তবে ভালো হয় যদি অন্তত ওজু করে শোয়া বা বিছানা পরিবর্তন করা হয়।

➡️ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

সহবাসের পর কি খাওয়া-দাওয়া করা যায়?

উত্তর: হ্যাঁ, সহবাসের পর খাওয়া-দাওয়া করা যায়। তবে, ইসলামী শিষ্টাচার অনুযায়ী গোসল বা কমপক্ষে ওজু করে খাওয়া উত্তম।

সহবাসের পর কি টয়লেটে যাওয়া জরুরি?

উত্তর: হ্যাঁ, বিশেষ করে নারীদের জন্য টয়লেটে যাওয়া ভালো, কারণ এটি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) থেকে রক্ষা করে।

সহবাসের পর কি গরম বা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করা উচিত?

উত্তর: শরীরের জন্য যা আরামদায়ক, সেই তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।

সহবাসের পর কি সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে?

উত্তর: হ্যাঁ, ইসলাম পরিচ্ছন্নতাকে উৎসাহিত করে, তাই সহবাসের পর ভালো সুগন্ধি ব্যবহার করা যেতে পারে।

📖 রাসুল (সা.) সুগন্ধি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন।
➡️ তবে, সুগন্ধি ব্যবহারের আগে শরীর সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা জরুরি।

সহবাসের পর কি নামাজ পড়া যাবে?

উত্তর: না, যতক্ষণ পর্যন্ত না গোসল করা হয়, ততক্ষণ নামাজ পড়া যাবে না।
➡️ কারণ, সহবাসের পর দেহ অপবিত্র থাকে, যা নামাজের জন্য অনুমোদিত নয়।

সহবাসের পর কি কাপড় পরিবর্তন করা জরুরি?

উত্তর: যদি কাপড় নাপাক হয়ে যায়, তবে পরিবর্তন করা জরুরি। যদি নাপাক না হয়, তবে একই কাপড় পরা যেতে পারে।

📖 রাসুল (সা.) পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।

🔴 সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় ও বর্জনীয়

করণীয়:
✔️ সহবাসের পর ওজু করা (পুনরায় মিলনের ইচ্ছা থাকলে)।
✔️ সম্পূর্ণ গোসল করা (নামাজ ও ইবাদতের জন্য)।
✔️ পরিষ্কার থাকা ও বিশ্রাম নেওয়া।
✔️ সুগন্ধি ব্যবহার করা ও পরিচ্ছন্ন বিছানায় শোয়া।
✔️ স্ত্রীর প্রতি সদয় হওয়া ও আদর-যত্ন করা।

যা করবেন না:
❌ গোসল বা ওজু ছাড়া নামাজ পড়া।
❌ সম্পূর্ণ অপবিত্র অবস্থায় ঘুমানো।
❌ সহবাসের কথা অন্যের সাথে শেয়ার করা।
❌ শরীর বা বিছানা অপরিচ্ছন্ন রাখা।
❌ পুনরায় মিলনের আগে ওজু না করা।


পোস্টটি শেয়ার করুন