অজু ভঙ্গের কারণ । ৬ টি না কি ৮ টি? হাদিসের ভিত্তিতে উত্তর

পোস্টটি শেয়ার করুন

অজু ভঙ্গের কারণ নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী কোন কোন কাজ অজু ভঙ্গ করে, তা জানা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগপোস্টে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে অজু ভঙ্গের কারণগুলো বিশ্লেষণ করেছি। যেমন, প্রাকৃতিক নাপাকির নির্গমন, ঘুম বা বোধ-বুদ্ধি হারানো, উটের মাংস খাওয়া ইত্যাদি। বিস্তারিতভাবে প্রতিটি বিষয়ের পেছনের দলিল-প্রমাণ এবং আলেমদের মতামত তুলে ধরেছি। আপনার দৈনন্দিন ইবাদত ও পবিত্রতা রক্ষায় এই পোস্টটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ গাইড।”

অজু ভঙ্গের কারণ

এখানে আমরা ৬টি অজু ভঙ্গের কারণ নিয়ে আলোচনা করছি। এই ৬ টির ভেতর মূলত অজু ভঙের সকল দিক নিয়ে মৌলিকভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

  • পেশাব, পায়খানা বা বাতাস নির্গত হওয়া।
  • বীর্য, মজি এবং ওয়াদি নির্গমন।
  • গভীর ঘুম, যেখানে সচেতনা থাকে না।
  • বোধ বিলুপ্তি, নেশাগ্রস্ত বা অজ্ঞান বা পাগল হওয়া।

১. পেশাব, পায়খানা বা বাতাস নির্গত হওয়া

পেশাব ও পায়খানা

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে এলো।” (সূরা আন-নিসা: ৬)

এই আয়াতে পায়খানা বলতে পেশাব বা পায়খানার মাধ্যমে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া বোঝানো হয়েছে।

ইজমা: সমস্ত আলেম একমত যে, পেশাব বা পায়খানা সামনের রাস্তা (ক্বুবুল) বা পেছনের রাস্তা (দুবুর) দিয়ে বের হলে অজু ভঙ্গ হয়।

অন্য কোনো পথে নির্গমন: যেমন: মূত্রাশয় বা পেটের ক্ষত থেকে নির্গত কিছু।
এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।

আবু হানিফা, সাওরি, আহমদ, ইবনু হাজম: তাদের মতে, শরীর থেকে যেকোনো নাপাক বস্তু (যেমন রক্ত, পুঁজ, মুখ ভরে বমি) নির্গত হলে ( গড়িয়ে পড়লে) অজু ভঙ্গ হয়।

অন্য মত: ইমাম শাফেয়ির মতে, শুধু সামনের বা পেছনের রাস্তা দিয়ে কিছু নির্গত হলে অজু ভঙ্গ হয়, তা নাপাক হোক বা না হোক (যেমন: পাথরের টুকরো)।

বাতাস / বায়ু

দুবুর (পেছনের রাস্তা)

পেছনের রাস্তা দিয়ে বায়ু বের হলে অজু ভঙ্গ করে, এতে ইজমা রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“তোমাদের কেউ যদি হাদস (অর্থাৎ অজু ভঙ্গকারী কিছু) করে তবে তার নামাজ গ্রহণযোগ্য নয় যতক্ষণ না সে অজু করে।” একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন: হাদস কী? আবু হুরাইরা (রা.) বললেন: “ফুসা (হালকা বাতাস) বা দমকা বাতাস।”

ক্বুবুল (সামনের রাস্তা)

প্রথম অভিমত: এটি অজু ভঙ্গ করে।

দ্বিতীয় অভিমত: আবু হানিফা ও ইবনু হাজম বলেন, এটি অজু ভঙ্গ করে না। কারণ, “ফুসা” ও “দমকা বাতাস” বিশেষত পেছনের রাস্তা থেকে নির্গত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

মন্তব্য: যদি প্রকৃত বায়ু নির্গত হওয়ার অনুভূতি পাওয়া যায়, তবে তা অজু ভঙ্গ করবে, তা ক্বুবুল (যৌনাঙ্গ) বা দুবুর (পায়ুপথ) যেকোনো পথ থেকেই নির্গত হোক। তবে যদি তা নিশ্চিত না হয়, তবে শুধুমাত্র দুবুর থেকে নির্গত হওয়া বাতাস অজু ভঙ্গ করবে।

নারীদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা: যদি কোনো নারী তার ক্বুবুল থেকে বাতাস বের হওয়ার মতো কিছু অনুভব করেন, তবে তা “ইনজিবাজ” বা পেশির নড়াচড়া হতে পারে। এটি প্রকৃত বাতাস নয়, তাই অজু ভঙ্গ হবে না। তবে যদি কোনো নারীর প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা এক হয়ে যায় (মুফাদাহ), তখন সতর্কতার জন্য অজু করে নেওয়া উচিত।

২. বীর্য, মজি এবং ওয়াদি নির্গমন

বীর্য

বীর্যের নির্গমন অজু ভঙ্গকারী বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত। এটা হলে غسل করা বাধ্যতামূলক। কারণ, যেসব বিষয় غسل ফরজ করে সেগুলোতে অজুও ভঙ্গ হয়। এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।

মজি

মজি নির্গমনও অজু ভঙ্গকারী। আলী ইবনু আবি তালিব (রা.) বলেন:

“আমি এমন একজন ব্যক্তি ছিলাম, যার থেকে বেশি বেশিমজি নির্গত হতো। তাই আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে সংকোচবোধ করতাম, কারণ তিনি আমার শ্বশুর ছিলেন। তাই আমি অন্য একজনকে তার কাছে পাঠাই। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
‘অজু করো এবং তোমার লজ্জাস্থান ধুয়ে নাও।’

ওয়াদি

ওয়াদির ব্যাপারেও একই বিধান প্রযোজ্য। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন:

“বীর্য হলো সেটি, যা غسل ফরজ করে। আর মজি এবং ওয়াদির ব্যাপারে বলেন: ‘তোমার লজ্জাস্থান ধুয়ে নাও এবং নামাজের জন্য অজু করো।’”

মজি: মজি হলো একধরনের পাতলা, সাদা বা স্বচ্ছ তরল। এটি যৌন উত্তেজনা বা চিন্তার কারণে লজ্জাস্থান থেকে নির্গত হয়। এটি মূলত সুক্ষ্ণ ধরনের নির্গমন এবং অনেক সময় এটি অজান্তে ঘটে। মজি নাপাক এবং এটি বের হলে অজু ভঙ্গ হয়। তবে মজির কারণে গোসল ফরজ হয় না। শুধু লজ্জাস্থান ধুয়ে অজু করাই যথেষ্ট।

ওয়াদি: ওয়াদি হলো সাদা, ঘন তরল। এটি সাধারণত প্রস্রাবের পরে নির্গত হয়। এটি প্রস্রাবের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও আলাদা এক ধরনের নির্গমন। ওয়াদি নাপাক এবং এটি বের হলে অজু ভঙ্গ হয়। তবে মজির মতোই, ওয়াদির কারণে গোসল ফরজ হয় না। লজ্জাস্থান ধুয়ে অজু করলেই যথেষ্ট।

বিশেষ উপদেশ:

যদি কেউ প্রস্রাব বা মজির অনবরত নির্গমনের মতো সমস্যায় ভোগেন, যার কারণে নামাজের আগে বারবার অজু করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, এমন ব্যক্তি নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করবেন:
১. নির্গত বস্তু দ্বারা কাপড় বা শরীর নাপাক হয়ে গেলে, তা ধুয়ে ফেলবেন।
২. নামাজের সময় প্রতিবার নতুন করে অজু করবেন।
৩. এরপর নামাজে কিংবা অজুর পর যা নির্গত হবে, তা অজু বা নামাজে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এটি ঋতুবতী নারীদের (মুস্তাহাযা) মতো।

আরো পড়ুন:

৩. গভীর ঘুম, যেখানে সচেতনা থাকে না

ঘুমের কারণে অজু ভঙ্গ হওয়া নিয়ে বিভিন্ন হাদিস এসেছে। যার মধ্যে কিছু হাদিসে বলা হয়েছে ঘুমের কারণে অজু ভঙ্গ হয় না। আর কিছু হাদিসে বলা হয়েছে ঘুম অজু ভঙ্গ করে। এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দু’টি মত রয়েছে:

১. প্রথম মতামত: কেউ কেউ মনে করেন, ঘুম অজু ভঙ্গ করে না। বরং এটি একটি সম্ভাব্য কারণ মাত্র।
২. অগ্রাধিকার মতামত: কেউ কেউ বলেন, ঘুম সরাসরি অজু ভঙ্গ করে।

ঘুমের প্রকারভেদ অনুযায়ী এই মতবিরোধ নিরসন করা যায়।

  • যদি ঘুম গভীর হয়, যেখানে ব্যক্তি তার চারপাশের কোনো শব্দ, হাত থেকে কোনো কিছু পড়ে যাওয়া বা লালা ঝরা সম্পর্কে সচেতন না থাকে, তাহলে এটি অজু ভঙ্গ করবে।
  • তবে যদি ঘুম হালকা হয়, যেমন তন্দ্রা বা সামান্য ঝিমুনি, যেখানে ব্যক্তি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকে, তাহলে এটি অজু ভঙ্গ করবে না।

এই সিদ্ধান্ত হাদিসের আলোকে এসেছে। যেমন, হাদিসে এসেছে সাহাবারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে নামাজের অপেক্ষায় থাকতেন, তবুও তারা অজু করতেন না। এছাড়াও ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে প্রাপ্ত হাদিসে এসেছে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে নামাজে অংশ নিয়েছিলেন এবং ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু অজু ভঙ্গ করেননি।

উপকারিতা: ঘুম সরাসরি অজু ভঙ্গ করার কারণ নয়, বরং এটি একটি সম্ভাব্য কারণ। ঘুমের ধরন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদি কোনো ব্যক্তি সন্দেহে থাকে যে তার ঘুম অজু ভঙ্গ করেছে কি না, তাহলে এটি ভঙ্গ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়। কারণ পূর্ববর্তী অজু নিশ্চিত ছিল, এবং নিশ্চিত কিছু সন্দেহের কারণে বাতিল হয় না। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার এই মতটি ফতোয়া (২১/২৩০) গ্রন্থে পাওয়া যায়।

৪. বোধ বিলুপ্তি, নেশাগ্রস্ত বা অজ্ঞান বা পাগল হওয়া

ইজমা (ঐক্যমত) অনুযায়ী এগুলো অজু ভঙ্গকারী। এই ধরনের অবস্থাগুলি ঘুমের চেয়ে আরও বেশি প্রভাবশালী।এটি এমন একটি অবস্থার নাম, যখন ব্যক্তি তার চিন্তা বা অনুভূতি হারিয়ে ফেলে, এবং তার মনের কোনো কার্যক্ষমতা থাকে না। এই ধরনের অবস্থা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন:

  • নেশাগ্রস্ত হওয়া: যখন কোনো ব্যক্তি মাদকদ্রব্য বা অ্যালকোহল সেবন করে এবং তার ফলে তার মনোযোগ, চিন্তাভাবনা এবং আচরণে পরিবর্তন আসে।
  • অজ্ঞান হওয়া: এটি এমন একটি অবস্থার নাম যখন কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, যেমন দুর্ঘটনা বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে।
  • পাগল হওয়া: এটি মানসিক অসুস্থতার একটি স্তর যেখানে ব্যক্তির চিন্তাভাবনা এবং আচরণ পুরোপুরি অস্বাভাবিক হয়ে যায়, এবং সে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এই সমস্ত অবস্থা শরীর বা মনের এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, ব্যক্তি তার চারপাশের পরিস্থিতি বা নিজস্ব শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকে না।এ ধরনের অবস্থা যেকোনো সময় ঘটলে তার অজু ভেঙে যায়।

যে সব কারণে ওজু ভাঙে না

১. যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা

যৌনাঙ্গ স্পর্শ করলে ওযু ভঙের বিষয়ে চারটি মত রয়েছে। এখানে আমরা দুটি মতামত দিচ্ছি।

প্রথম মত: যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা কখনই অজু ভঙ্গ করে না। এটি ইমাম আবু হানিফা এবং মালেকের একটি অভিমত। এটি কিছু সাহাবীর কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা নিম্নলিখিতগুলি উপস্থাপন করেছেন:

১. তালাক ইবন আলী (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একজন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন, একজন ব্যক্তি যখন অজু করে এবং তারপর নিজের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করে, তখন তার অজু ভঙ্গ হবে কি না? তখন রাসুল (সা.) বললেন: “এটা কি তোমারই অংশ নয়?”

২. তারা বলেন, কোনো দ্বন্দ্ব নেই যে, যদি যৌনাঙ্গ পা বা মাংসপেশী স্পর্শ করা হয়, তবে তার জন্য অজু করা লাগবে না। পা বা হাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা বিসরা (রা.) এর হাদিস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যেখানে যৌনাঙ্গ স্পর্শের কারণে অজু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় মত: গোপনাঙ্গ স্পর্শ করলেই ওযু ভঙ্গ হবে। এটি হল মালিক (মালিকী মত), শাফি‘ই, আহমদ, এবং ইবনে হজমের মতবাদ, এবং অধিকাংশ সাহাবীদের কাছ থেকে এই মতামত পাওয়া যায়।

৩. স্ত্রী লোককে স্পর্শ করা

এটাও একটি মতভেদপূর্ণ বিষয়। হানাফি মাযহাবে এটি ওজু ভঙ্গ করে না। তবে অন্য মাযহাবে ওজু ভঙ্গ করে।

৩. উটের মাংস খাওয়া

এটাও একই মাসআলা। হানাফি মাযহাব অনুযায়ী উটের মাংস খেলে ওজু ভাঙে না। তবে অন্যরা বলেনযে ব্যক্তি উটের মাংস খায়, সেটা কাঁচা, রান্না করা বা গ্রিল করা হোক, তাকে অজু করতে হবে। এর প্রমাণ হলো: জাবির বিন সামুরা (রাযি আল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, একজন ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন,

“আমি কি মেষের মাংস খাওয়ার পর অজু করব?” তিনি বললেন, “চাইলে অজু করতে পারো, চাইলে করো না।” এরপর সেই ব্যক্তি আবার বললেন, “আমি কি উটের মাংস খাওয়ার পর অজু করব?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, উটের মাংস খাওয়ার পর অজু করো।’ ( মুসলিম, হাদিস নাম্বার: ৩৬০)।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x