রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা। আরবি ও বাংলা পরিপূর্ণ দোয়া

পোস্টটি শেয়ার করুন

মানুষ ভুল করে— এটা তার স্বভাবজাত দুর্বলতা। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল করে, সীমাবদ্ধ জ্ঞানে। কখনো জেনে, কখনো না জেনে আমরা পাপের পথে পা বাড়াই। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের দরজা সবসময় খুলে রেখেছেন; তিনি বারবার ফিরে আসার সুযোগ দেন। এই ফিরে আসাটাই হলো তাওবা, আর তাওবার মূল চাবিকাঠি হলো ক্ষমা প্রার্থনা ‘রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা’ — যা শুরু হয় আন্তরিক দোয়ার মাধ্যমে।

কুরআনে বহু স্থানে আল্লাহ বান্দার কাছে নিজের গুনাহ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। তেমনি একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দোয়া হলো—

رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا

“হে আমাদের রব! আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন।”

এই দোয়াটি শুধু মুখে উচ্চারণ করার বিষয় নয়; বরং হৃদয়ের এক গভীর আত্মসমর্পণ, একটি অশ্রুসিক্ত আত্মার আর্তনাদ, যা বান্দাকে তার প্রভুর সামনে নিঃস্বভাবে দাঁড় করায়। এই দোয়ার পেছনে রয়েছে এক বিশাল ভাবগত তাৎপর্য, এক ঈমানী শিক্ষা এবং মহান আল্লাহর ক্ষমাশীলতা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস।

এই ব্লগপোস্টে আমরা জানব – রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা, এই দোয়ার মূল উৎস, এর শব্দগত বিশ্লেষণ, কুরআনিক প্রেক্ষাপট, ইসলামী ভাবনায় এর গুরুত্ব, এবং কীভাবে এই দোয়া আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠতে পারে।

রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা — একটি ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া

দোয়ার আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ

আরবি:

رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا

বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা

বাংলা অর্থ: হে আমাদের রব! আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন।

কুরআনিক প্রেক্ষাপট

এই দোয়াটি মূলত এসেছে সুরা আলে ইমরান এর ১৬তম আয়াতে। আয়াতটি হলো:

“الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ”

“যারা বলে, হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, অতএব তুমি আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করো এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।” — (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৬)

এই দোয়াটি ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, তাদের অন্তর নম্র হয় এবং তারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

শব্দগত বিশ্লেষণ

  • رَبَّنَا (রাব্বানা): “হে আমাদের রব!” — এখানে ‘রব্ব’ শব্দের অর্থ পালনকর্তা, অভিভাবক, সৃষ্টিকর্তা। এটি গভীর ভালোবাসা ও নির্ভরতার প্রকাশ।
  • فَاغْفِرْ (ফাগফির): এটি فعل أمر (অর্ডার বা অনুরোধের ধাঁচে ক্রিয়া), যার অর্থ: “তুমি ক্ষমা করো!” এটি অত্যন্ত বিনয় ও কাতর অনুরোধ প্রকাশ করে।
  • لَنَا (লানা): “আমাদের জন্য” — অর্থাৎ এই দোয়াটি কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সম্মিলিত দোয়া।
  • ذُنُوبَنَا (যুনুবানা): “আমাদের পাপসমূহ” — ‘ذَنب’ (যানব) শব্দটি মূলত এমন পাপ বোঝায় যার পরিণতিতে শাস্তি আসে। এটি সাধারণ ভুল নয়, বরং এমন অপরাধ যা আত্মার ওপর বোঝা তৈরি করে।

দোয়াটির তাৎপর্য ও শিক্ষা

১. ঈমানের সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা

এখানে ঈমানের পরপরই ক্ষমা চাওয়ার কথা এসেছে। কারণ, ঈমানই হলো গুনাহ থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। কেউ ঈমান আনার পরও যদি পাপ করে, তবে তার জন্য আশার দরজা খোলা—আল্লাহ ক্ষমা করতে প্রস্তুত।

২. অন্তরের বিনয় ও আত্মসমর্পণ

এ দোয়া শুধু মুখের উচ্চারণ নয়; বরং একটি ভেঙে পড়া অন্তরের নিঃশব্দ আর্তনাদ। বান্দা এখানে নিজেকে দোষী স্বীকার করে নিচ্ছে এবং প্রভুর কাছে সাহায্য চাইছে।

৩. সম্মিলিত আবেদন

“لَنَا” — আমাদের জন্য! এর দ্বারা বোঝা যায়, একজন মুমিন শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সমস্ত মুমিন ভাই-বোনের জন্য ক্ষমা চায়। এটি একটি উম্মাহভিত্তিক চেতনার পরিচয়।

৪. দুনিয়া ও আখিরাতের সংযোগ

যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে শুধু এই দুনিয়ার ভালো চায় না; বরং পরকালের চিরস্থায়ী মুক্তিও কামনা করে।

দোয়াটি আমাদের জীবনে কীভাবে কাজে লাগবে?

✅ নিয়মিত এই দোয়া পাঠ করা উচিত, বিশেষতঃ নামাজের সিজদা, তাশাহহুদ কিংবা দোয়ার সময়।
✅ তাওবা করতে চাইলে এই দোয়াটি খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দোয়া।
✅ যখন নিজের কোনো গুনাহে অনুতপ্ত হই, তখন এই দোয়া অন্তরের গভীরতা থেকে পড়া যেতে পারে।
✅ অন্যদের জন্য দোয়া করার সময়ও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে—যেমন পরিবার, বন্ধু, উম্মাহর জন্য।

📚 তাফসিরকারকদের দৃষ্টিতে আয়াত ৩:১৬ এর ব্যাখ্যা

আরোও পড়ুন:

১. তাফসির ইবন কাসীর (Ibn Kathir):

মন্তব্য: ইবন কাসীর বলেন, এই আয়াতে সেই সব লোকদের কথা বলা হয়েছে, যাদের অন্তরে তাকওয়া রয়েছে। তারা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

উদ্ধৃতি:

“এরা এমন লোক, যারা শুধু ঈমান আনে না; বরং ঈমান আনার পর নিজেদের গুনাহকে ভুলে যায় না। বরং তারা দোয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ক্ষমা চায়।” — (তাফসির ইবন কাসীর, ৩:১৬)

তিনি আরও বলেন, এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়—তাকওয়াবান বান্দার পরিচয় হলো, সে সবসময় আত্মসমালোচনামূলক থাকে এবং পাপ নিয়ে গাফেল থাকে না।

২. তাফসির কুরতুবী (Al-Qurtubi)

মন্তব্য: ইমাম কুরতুবী এই আয়াতের আলোকে বলেন, “এই দোয়ার মাঝে রয়েছে ঈমান, দোয়া, বিনয়, গুনাহ স্বীকার, এবং আখিরাতের ভয়—সব একত্রে।”

উদ্ধৃতি:

“এখানে ঈমানদারদের একটি নিদর্শন দেওয়া হয়েছে যারা মুখে শুধু ঈমানের দাবি করে না, বরং আল্লাহর ভয়, অনুতপ্ত অন্তর এবং ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে তার প্রমাণ দেয়।” — (তাফসির কুরতুবী, ৩:১৬)

তিনি এটিকে এক প্রকার আধ্যাত্মিক উন্নতির দোয়া বলে ব্যাখ্যা করেন, যা একজন মুমিনকে অন্তরের বিশুদ্ধতার পথে নিয়ে যায়।

৩. তাফসির তাবারী (Al-Tabari)

মন্তব্য: ইমাম তাবারী বলেন, এই আয়াতে ঈমানদারদের অবস্থা এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেন তারা সবসময় আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, যেন তাদের কোনো আমলই তাদের গর্বিত করে না।

উদ্ধৃতি:

“এই আয়াত প্রমাণ করে, ঈমানদারদের জন্য অপরিহার্য—তারা যত ভালো কাজ করুক না কেন, তবু তাদের উচিত নিজের পাপের কথা মনে রেখে ক্ষমা চাওয়া।” — (তাফসির তাবারী, ৩:১৬)

তিনি আরও বলেন, এই আয়াতের মধ্যে রয়েছে বান্দার হৃদয়ের নম্রতা ও আল্লাহর দয়ার প্রতি চরম নির্ভরতা।

সারসংক্ষেপে শিক্ষা ইমামদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী

  • ঈমান আনা মানেই পূর্ণতা নয়, বরং ঈমানের সাথে থাকা উচিত তাওবা ও ক্ষমা চাওয়ার আমল।
  • সত্যিকারের মু’মিন কখনো নিজের আমলকে যথেষ্ট মনে করে না—বরং সে সবসময় অনুতপ্ত থাকে।
  • দোয়া শুধু চাওয়ার মাধ্যম নয়, বরং তা আত্মার শুদ্ধির এক পথ।
  • গুনাহ স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনাই একজন ঈমানদারের আত্মিক পরিণতির ইঙ্গিত বহন করে।

দোয়ার শব্দভিত্তিক বিশ্লেষণ (تفسير الكلمات)

শব্দউচ্চারণঅর্থব্যাকরণ ও উৎসশিক্ষা / ব্যাখ্যা
رَبَّنَاরাব্বানাআহে আমাদের পালনকর্তা“رَبّ” = প্রতিপালক + “نَا” = আমাদেরআমাদের সব চাওয়ার শুরু হওয়া উচিত আল্লাহর নাম নিয়ে। তিনি লালনপালনকারী, তাই তাঁকে ডাকতে দ্বিধা নেই।
فَاغْفِرْফাগফিরঅতএব ক্ষমা কর“غَفَرَ” ধাতু থেকে এসেছে; অর্থ: ঢেকে দেওয়া, ক্ষমা করাগুনাহের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া আবশ্যক।
لَنَاলানাআমাদের জন্য“لِ” = জন্য + “نَا” = আমাদেরআমরা স্বীকার করছি—আমরা অপরাধ করেছি, আমাদেরই ক্ষমা দরকার।
ذُنُوبَنَاযুনূবানাআমাদের গুনাহসমূহ“ذَنْب” = পাপ/অপরাধ + “نَا” = আমাদেরগুনাহকে ছোট মনে না করে তা স্বীকার করে নেয়া এবং তা থেকে মুক্তি চাওয়া মুমিনের চিহ্ন।

📝 অতিরিক্ত টিপস

  • غَفَرَ” শব্দের অর্থ শুধুমাত্র ‘ক্ষমা’ না, বরং পাপকে ঢেকে দেওয়া এবং শাস্তি থেকে রক্ষা করা — এটা আরও গভীর তাৎপর্য বহন করে।
  • এই দোয়াটি সংক্ষিপ্ত হলেও তাওবার সব উপাদান এতে রয়েছে: অহংকারহীনতা, স্বীকারোক্তি, অনুনয় ও করুণা প্রার্থনা।

শেষ কথা

রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা —এই দোয়া শুধু একটি বাক্য নয়, বরং একটি হৃদয়ের আর্তি। এক অপরাধবোধে ভরা আত্মা যখন তার প্রভুর দিকে ফিরে তাকায়, তখন এ দোয়া তার মুখ থেকে বের হয়ে আসে। এই দোয়া আমাদের শেখায়—গুনাহ যত বড়ই হোক, আল্লাহর দরজা কখনো বন্ধ নয়।

আসুন, আমরা প্রতিদিন অন্তর থেকে এই দোয়া করি, নিজের জন্য, আমাদের পরিবার ও উম্মাহর জন্য। কারণ, ক্ষমা পাওয়ার আশা কখনো ছাড়তে নেই।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x