ইস্তিঞ্জার নিয়ম । ৮ টি সুন্নত ও ৯ টি আদব । ঢিলা কুলুখ । হানাফি মাযহাব

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামে পবিত্রতা বা তাহারাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দৈনন্দিন ইবাদত যেমন সালাত, তাওয়াফ ইত্যাদি বিশুদ্ধভাবে সম্পাদনের জন্য দেহের পবিত্রতা অপরিহার্য। শরীর থেকে পায়খানা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হওয়া অপবিত্র বস্তু (নজাসত) দূর করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইস্তিঞ্জা। হানাফি মাযহাবে ইস্তিঞ্জার নিয়ম, সুন্নত ও আদব নির্দিষ্ট রয়েছে, যা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর শিক্ষা থেকে গৃহীত।

পবিত্রতা অর্জনের উপায় ও তার গুণাবলি

ইসতিঞ্জা (নাপাকী দূর করা) করা যায়—

  • পানির মাধ্যমে, অথবা পাথর ও তার মতো অন্যান্য বস্তু দিয়ে—যা শক্ত, পবিত্র, নাপাকী দূরকারী এবং সম্মানযোগ্য নয়; যেমন: কাগজ, কাপড়ের টুকরো, কাঠ, মাটির খোল ইত্যাদি, যদি এগুলো দিয়ে পাথরের মতো উদ্দেশ্য হাসিল হয়।

তবে সর্বোত্তম হলো: প্রথমে এমন কোনো কঠিন বস্তু (যেমন: কাগজ বা পাথর) ব্যবহার করা, তারপর পানি দিয়ে ধোয়া। কারণ, কাগজ বা পাথর দ্বারা মূল নাপাকী দূর হয়, আর পানির দ্বারা তার চিহ্ন বা প্রভাব দূর হয়।

শুধু পানি ব্যবহার করাই সবচেয়ে উত্তম শুধু পাথর বা কাগজ ব্যবহার করার চেয়ে। কারণ পানি দ্বারা মূল নাপাকী ও তার চিহ্ন উভয়ই দূর হয়।

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন এই আয়াত নাযিল হয়:

“এখানে এমন লোকেরা আছে, যারা পবিত্র থাকতে ভালোবাসে” [সূরা তওবা: ১০৮],

তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন:

“হে আনসারগণ! আল্লাহ তোমাদের পবিত্রতা ভালোবাসার গুণের প্রশংসা করেছেন। তোমাদের পবিত্রতার ধরন কী?” তারা বলল: “আমরা ওজু করি, জানাবাত (পবিত্রতার অভাব) থেকে গোসল করি, এবং ইসতিঞ্জা করি পানি দিয়ে।” তিনি বললেন: “এই তো তাই—এটিই হওয়া উচিত, সুতরাং তা অবলম্বন করো।”

পাথর বা কাগজ জাতীয় কিছু দিয়ে ইসতিঞ্জা করার শর্তসমূহ

১. নাপাক বস্তু শুকিয়ে না যায়। যদি শুকিয়ে যায়, তবে শুধু পানি ব্যবহার করা ফরজ হয়।

২. নাপাক বস্তু বের হওয়ার পর তার স্থান পরিবর্তন না করে। অর্থাৎ, যে স্থানে তা লেগেছে, সেখানেই থাকলে কাগজ/পাথর চলবে; যদি স্থানান্তর হয়ে আলাদা হয়ে যায়, তবে কেবল পানি ফরজ।

৩. তার উপর কোনো ভেজা জিনিস না লাগে, তা পবিত্র হোক বা অপবিত্র। তবে শুকনো ও পবিত্র কিছু লাগলে ক্ষতি নেই।

৪. এটি স্বাভাবিক পায়খানা-পেশাবের রাস্তা দিয়ে বের হতে হবে।

যদি শরীরের অন্য স্থান (যেমন: অপারেশনকৃত ছিদ্র বা কাটার জায়গা) দিয়ে বের হয়, তাহলে কাগজ/পাথর চলবে না; কেবল পানি ফরজ।

  • উভলিঙ্গ (খুনসা) হলে যদি একটি পথ দিয়ে মূত্র বের হয়, তবুও কাগজ/পাথর যথেষ্ট নয়—কারণ বাড়তি অংশ বের হবার সম্ভাবনা থাকে।
  • খতনা না হওয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি মূত্র চামড়ার নিচে পৌঁছে যায়, তাহলেও কাগজ/পাথর যথেষ্ট নয়।

তিনটি পাথর ব্যবহার ফরজ কি?

হানাফি ও মালিকি মাজহাব মতে: তিনটি পাথর ব্যবহার করা সুন্নত, ফরজ নয়। যদি তার চেয়েও কম দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়, তবে সেটাই যথেষ্ট।

‘পরিষ্কার হওয়ার’ মানে হচ্ছে—নাপাকী ও তার ভিজাভাব চলে যাওয়া, এবং পাথর একেবারে পরিষ্কার বের হওয়া (অল্প কিছু দাগ থাকলে ক্ষতি নেই)।

তাদের দলিল:

“যে ইসতিজমার (পাথর দিয়ে ইসতিঞ্জা) করে, সে বিজোড় সংখ্যা ব্যবহার করুক। যে তা করল, সে উত্তম করল; না করলেও গোনাহ নেই।”

পানি দিয়ে ইসতিঞ্জার ক্ষেত্রে কতবার ধুতে হবে?

সঠিক মত হলো: এটি ব্যক্তির বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যতক্ষণ না মনে নিশ্চিত হয় যে, নাপাকী দূর হয়ে গেছে—অথবা প্রভাব চলে গেছে—ততক্ষণ ধোয়া উচিত।

ইমাম আহমাদ (রহ.) এর কাছেও এটি অধিক গ্রহণযোগ্য মত। তিনি বলেন:

“ইসতিঞ্জার সীমা হলো: যেন পরিষ্কার হয়ে যায়।”

রাসূল ﷺ থেকে এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নির্ভরযোগ্যভাবে প্রমাণিত হয়নি।
তবে আহমাদ (রহ.) থেকে সাতবার ধোয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।

ইস্তিঞ্জা করার নিয়ম

১. প্রথমে বাম হাতে নাপাক জায়গা স্পর্শ করার আগেই হাতে পানি ঢেলে নেওয়া।

২. এরপর ধোয়া হবে—

  • প্রস্রাবের ক্ষেত্রে: শুধু মূত্রত্যাগের স্থান।
  • মযীর (উত্তেজনায় নির্গত পাতলা তরল) ক্ষেত্রে: সম্পূর্ণ লিঙ্গ।
  • তারপর ধোয়া হবে পায়ুপথ।

৩. পানি ধারাবাহিকভাবে ঢালতে হবে, এবং বাম হাত দিয়ে ঘষতে হবে, হালকা ঝুঁকে, ভালোভাবে চেপে চেপে পরিষ্কার করা পর্যন্ত।

৪. ডান হাত দিয়ে ইসতিঞ্জা করা যাবে না, এবং তাতে লিঙ্গ স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ।

৫. যিনি রোযা রাখছেন, তার জন্য সতর্কতা: ভেজা আঙুল পায়ুপথে প্রবেশ করালে রোযা ভেঙে যাবে—এটা এড়িয়ে চলা জরুরি।

ইসতিজমার (পাথর বা কাগজ দিয়ে ইসতিঞ্জা) পদ্ধতি

১. প্রথম পাথর দিয়ে মোছা হবে সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে।

  • দ্বিতীয় পাথর দিয়ে মোছা হবে পেছন থেকে সামনের দিকে।
  • তৃতীয় পাথর দিয়ে আবার
    • যদি অণ্ডকোষ ঝুলে থাকে, তাহলে সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে মোছা হবে (যাতে অণ্ডকোষ নাপাক না হয়)।
    • আর যদি অণ্ডকোষ ঝুলে না থাকে, তাহলে পেছন থেকে সামনের দিকে মোছা হবে।

মহিলাদের জন্য নিয়ম

মহিলারা ইসতিজমা শুরু করবেন সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে, যাতে প্রস্রাব বা নাপাকী তাদের গোপনাঙ্গে না ছড়ায়।

ইস্তিঞ্জার সুন্নাত

ইসতিঞ্জার সুন্নত আমলসমূহ

১. পাথর বা কাগজ দিয়ে ইসতিঞ্জা করা, তবে এমন কিছু দিয়ে যা

  • অতিরিক্ত খসখসে না (যেমন: ইঁট)।
  • অতিরিক্ত মসৃণ না (যেমন: পলিশ করা পাথর)।
    উদ্দেশ্য হলো—পরিষ্কার হওয়া।

✔ পাথরের মতো গণ্য: যেকোনো পবিত্র জিনিস যা সহজে ময়লা দূর করে এবং ক্ষতিকর নয়।

✘ নিষেধ:

  • নাপাক জিনিস (যেমন: কয়লা),
  • ক্ষতিকর বস্তু (যেমন: কাচ),
  • মূল্যবান বা সম্মানিত বস্তু (যেমন: রেশম, সুতা, খাদ্য)।

পানির বিকল্প হিসেবে অন্যান্য তরল (যেমন গোলাপজল, ভিনেগার) দিয়ে ইসতিঞ্জা করা বৈধ।

২. তিনবার মোছা করা (তছলিস)

হানাফি ও মালিকি মতে: সুন্নত

“তোমাদের কেউ যখন প্রাকৃতিক কাজ সারতে যায়, তখন যেন তিনটি পাথর দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে।”

“যে ইসতিজমা করে, সে যেন বিজোড় সংখ্যায় করে।”

৩. ডান হাত দিয়ে ইসতিঞ্জা না করা (অবশ্য অজুর কারণে, বা প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা)।

হাদিস:

“তোমাদের কেউ যখন প্রস্রাব করে, তখন যেন ডান হাতে লিঙ্গ স্পর্শ না করে। যখন টয়লেটে যায়, তখন ডান হাতে মুছবে না।” ➤ অতএব, ইসতিঞ্জা বাম হাত দিয়ে করা সুন্নত।

৪. ইসতিঞ্জা বা পায়খানার সময় পর্দা করা (গোপনতা রক্ষা করা)

  • দেহের গোপন অঙ্গ যেন অন্য কেউ না দেখে—এটা ওয়াজিব।
  • পর্দা না করা গুনাহ।
  • প্রয়োজন হলে কাপড়ের নিচ দিয়ে পাথর ব্যবহার করে মোছা যাবে।
  • যদিও কেউ পর্দা ছাড়া ইসতিঞ্জা করল, তবু নামায সহিহ হবে।
    দলিল:

“যে পায়খানায় যাবে, সে যেন লুকিয়ে থাকে। না পারলে বালির ঢিবি তৈরি করে তার আড়ালে বসে।”
শহর বা জনবহুল স্থানে এমন দূরে যায় যেন তার গন্ধ বা শব্দ কেউ না পায়।

৫. ইসতিঞ্জা শেষে হাত ধোয়ার আগে তা ঘষে নেওয়া যেমন: মাটি, সাবান বা ঝাঁজযুক্ত কিছু দিয়ে।

৬. রোযাদার হলে—দাঁড়ানোর আগে পায়ুপথ মুছে শুকিয়ে নেওয়া, যাতে ভেজা অংশ থেকে পানি ভিতরে না টানে।

৭. পুরুষদের জন্য সুন্নত: আগে সামনের অংশ (লিঙ্গ) ধোয়া, তারপর পিছনের অংশ। যাতে পেছনের নাপাকির কারণে সামনের অংশ বা হাত আবার নাপাক না হয়। নারীরা যেকোনো অংশ দিয়ে শুরু করতে পারবে।

ইস্তিঞ্জার আদব

১. সম্মানিত নাম নিয়ে না যাওয়া

  • টয়লেটে যাওয়ার সময় এমন কিছু বহন না করা যাতে আল্লাহর নাম বা সম্মানিত নামসমূহ (যেমন: ফেরেশতা, العزيز, الكريم, মুহাম্মদ, আহমদ) লেখা থাকে।
  • তবে যদি কেউ বস্তুকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করে, যাতে পড়ে না যায় বা অপমানিত না হয়, তাহলে ক্ষতি নেই।

📌 হাদিস: রাসুল (ﷺ) যখন টয়লেটে যেতেন, তাঁর আংটি খুলে রাখতেন। তাতে লেখা ছিল: “মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ”।

২. প্রস্তুতি

  • জুতা পরা
  • মাথা ঢেকে রাখা
  • ইসতিঞ্জার উপকরণ (পাথর, পানি ইত্যাদি) সঙ্গে রাখা বা প্রস্তুত রাখা

৩. প্রবেশ ও বাহির হওয়ার আদব

  • প্রবেশ: বাম পা দিয়ে
  • বাহির: ডান পা দিয়ে
  • প্রবেশের দোয়া: بِسْمِ الله، اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الخُبُثِ وَالخَبَائِثِ
    “বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই পুরুষ ও নারী শয়তান থেকে।”
    📌 এটি দোয়া শয়তানের দৃষ্টি থেকে আত্মগোপনের জন্য।
  • বাহির হওয়ার দোয়া: غُفْرَانَك، الحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنِّي الأَذَى وَعَافَانِي
    “আপনার ক্ষমা চাই। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমার থেকে কষ্ট দূর করেছেন এবং আমাকে আরোগ্য দিয়েছেন।”

৪. বসার পদ্ধতি ও আচরণ

  • বাম পা ভাঁজ করে বসা, ডান পা খাড়া রাখা
  • দুই পায়ের মধ্যবর্তী অংশ খোলা রাখা
  • কথা না বলা (যদি না জরুরি হয়)
  • প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় বসে না থাকা
  • কাপড় উপরের দিকে না তোলা যতক্ষণ না মাটি স্পর্শ করছে। কেননা রাসুল (ﷺ) মাটি স্পর্শ করার সময়েই কাপড় তুলতেন
  • বসে প্রস্রাব করাই সুন্নত, যাতে ছিটে না পড়ে
  • দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করায় নফরতযোগ্য (তবে কোনো সমস্যা বা প্রয়োজনে বৈধ)

৫. নিষেধ কাজগুলো

  • বাতাসের বিপরীতে প্রস্রাব না করা (ছিটে ফিরে আসার আশঙ্কা)
  • স্থির পানি বা অল্প চলমান পানিতে প্রস্রাব না করা
  • কবর, রাস্তার মাঝখানে, মানুষ বসে আড্ডা দেয় এমন স্থানে প্রস্রাব না করা হাদিস: “তিন জায়গায় প্রস্রাব করা অভিশাপ ডেকে আনে — পানি পানের জায়গা, রাস্তায়, ও ছায়ায়”
  • গর্তে প্রস্রাব না করা কারণ রাসুল (ﷺ) নিষেধ করেছেন গর্তে প্রস্রাব করতে (হাতি-পোকামাকড়ের আবাস হতে পারে)

৬. কিবলার দিক

  • হানাফি মতে: টয়লেট হোক বা না হোক—কিবলার দিকে মুখ বা পেছন দিয়ে পায়খানা করা হারাম।

৭. অন্যান্য আদব

  • আকাশে না তাকানো
  • নিজের লজ্জাস্থানে না তাকানো
  • নির্গত বস্তুর দিকে না তাকানো
  • হাতে না খেলা, দাঁত না মাজা
  • ডানে-বামে না তাকানো
  • দীর্ঘ সময় বসে না থাকা
  • দাঁড়ানোর সময় ধীরে ধীরে কাপড় নামানো

৮. হারাম স্থানসমূহ

  • মসজিদে প্রস্রাব বা পায়খানা করা হারাম, এমনকি পাত্রে করলেও।
  • সম্মানিত কবরের উপর প্রস্রাব করা হারাম।
  • কবরের আশেপাশেও না করা উচিত, সম্মান রক্ষার্থে।

৯. অতিরিক্ত দোয়া

ইসতিঞ্জা শেষে দোয়া:

اللهم طهر قلبي من النفاق، وحصن فرجي من الفواحش
الحمد لله الذي أذاقني لذته، وأبقى فيّ منفعته، وأخرج عني أذاه

হে আল্লাহ, আমার অন্তরকে নিষ্কলুষ করো, এবং লজ্জাস্থানকে ফাহিশা থেকে রক্ষা করো। সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে (বায়োলজিকাল প্রক্রিয়ার) স্বস্তি দিয়েছেন এবং আমাকে পরিষ্কার করেছেন।

  • অন্তরে আল্লাহর প্রশংসা করা যদি হাঁচি আসে।

পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x