উলংগ হলে কি ওযু ভাঙ্গে? কুরআন ও হাদিস কী বলে?

পোস্টটি শেয়ার করুন

সলিমের জন্য ওযু রাখা যেমন ইমানের অংশ, তেমনি ওযু ভেঙে যাওয়ার কারণগুলো জানা থাকা আবশ্যক। অনেক সময় এমন প্রশ্ন ওঠে: উলংগ হলে কি ওযু ভেঙে যায়? এই বিষয়টি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন, কারো কাছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও শুনতে পাওয়া যায়। তাই, কুরআন, হাদিস এবং ফিকহের আলোকে এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা জানা জরুরি। চলুন, বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করি।

উলংগ হলে কি ওযু ভাঙ্গে? সংক্ষিপ্ত উত্তর

না, উলংগ হলে ওযু ভাঙ্গে না। শুধু উলংগ হয়ে যাওয়া—অর্থাৎ কাপড় খুলে সম্পূর্ণ বা আংশিক নগ্ন হয়ে যাওয়ার কারণে—ওযু নষ্ট হয় না। যতক্ষণ না শরীর থেকে কোনো নাপাক বস্তু বের হয় বা অন্য কোনো ওযুভঙ্গের কারণ ঘটে, ততক্ষণ ওযু অটুট থাকে।

দলীলসমূহ

১. কুরআন ও হাদিসে ওযু ভঙ্গের যে কারণগুলো বলা হয়েছে, তার মধ্যে “উলংগ হওয়া” কোথাও উল্লেখ নেই।
২. রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম—তাদের যুগে কেউ কাপড় ছাড়িয়ে উলংগ হলে ওযু করতে বলা হয়েছে—এমন কোনো নির্ভরযোগ্য হাদিস পাওয়া যায় না।
৩. ফিকহের বড় বড় ইমামগণ (ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফি’ ও ইমাম আহমদ রহিমাহুমুল্লাহ) কেউ উলংগ হওয়াকে ওযু ভঙ্গের কারণ বলে উল্লেখ করেননি।

অঙ্গ ঢেকে রাখা ওযুর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বরং এটি নামাজের শর্তগুলোর একটি। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে উলঙ্গ অবস্থায় নামাজ পড়ে, তবে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে সর্বসম্মতিক্রমে। তবে তার ওযু বাতিল হবে না। কারণ, নামাজ যেসব কারণে বাতিল হয়, সেসব কারণে সবসময় ওযু বাতিল হয় না।

উদাহরণস্বরূপ, নামাজ বেশি কথা বলার কারণে, ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজের রুকন বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে বা কিবলামুখী হওয়ার পরিবর্তে অন্যদিকে ফিরে নামাজ পড়ার কারণে বাতিল হয়। কিন্তু এসব কারণে ওযুর ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। ইসলাম ওয়ব ডট নেট

ওযু ভঙ্গের সাধারণ কারণসমূহ

কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে যা ওযু ভঙ্গ করে। সেগুলো হলো:

  • পায়খানা বা প্রস্রাব করা
  • গ্যাস বা বাতাস নির্গমন
  • গভীর ঘুম
  • মদী বা মণি বের হওয়া
  • জ্ঞান হারানো বা অজ্ঞান হওয়া

এগুলোর মধ্যে “উলঙ্গ হওয়া” ওযু ভাঙার কারণ হিসাবে কোনো হাদিস বা ফিকহি কিতাবগুলোতে উল্লেখ নেই।

আরো পড়ুন:

উলঙ্গ হওয়া ও ওযুর সম্পর্ক

উলঙ্গ হওয়ার সঙ্গে ওযুর সম্পর্ক নির্ধারণে ইসলামের মূলনীতি ও ফিকহি কিতাবসমূহে দুটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে:

ওযু একটি শারীরিক পবিত্রতা: ওযুর জন্য শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গ ধোয়া বাধ্যতামূলক। এটি একটি বাহ্যিক পবিত্রতা, যা উলঙ্গ হওয়ার মতো কোনো বাহ্যিক অবস্থার কারণে বাতিল হয় না।

উলংগ হলে ওযু ভাঙ্গে না
উলংগ হলে ওযু ভাঙ্গে না

ব্যবহারিক উদাহরণ

১. গোসলের সময় উলংগ হওয়া: কেউ ফরজ গোসল করার জন্য কাপড় খুলে একাকী বাথরুমে প্রবেশ করল। সে তখন সম্পূর্ণ উলংগ। এই অবস্থায়, যদি তার আগের ওযু অটুট থাকে এবং গোসলের সময় কোনো নাপাকী বের না হয় (যেমন প্রস্রাব-পায়খানা বা গ্যাস ইত্যাদি), তাহলে তার ওযু নষ্ট হবে না। শুধু উলংগ হওয়াতেই ওযু ভাঙ্গে না।

২. কাপড় পরিবর্তনের সময়: কেউ নতুন পোশাক পরার জন্য পুরোনো কাপড় খুলল এবং কিছু সময়ের জন্য উলংগ থাকল। এই মুহূর্তে যদি সে কোনো ওযু ভঙ্গকারী কাজ না করে, তাহলে তার ওযু অটুট থাকবে। নতুন কাপড় পরার পরেও নামাজ আদায় করতে পারবে।

৩. দুর্ঘটনাবশত কাপড় খুলে যাওয়া: কখনো দুর্ঘটনাবশত মানুষের কাপড় খুলে যেতে পারে, যেমন কোনো শিশুর কাপড় খুলে গেল, অথবা কোনো প্রবল বাতাসে কারো পোশাক সরে গেল। এক্ষেত্রেও শুধু উলংগ হওয়ার কারণে ওযু ভাঙবে না। যদি শরীর থেকে কোনো নাপাক পদার্থ বের না হয়, তাহলে ওযু অক্ষত থাকবে।

৪. চিকিৎসার জন্য উলংগ হওয়া: ডাক্তারি পরীক্ষার সময় কখনো রোগীকে নির্দিষ্ট অঙ্গ অনাবৃত করতে হয়। যদি কেউ চিকিৎসার প্রয়োজনে নির্জনে বা সীমিত পরিসরে কাপড় খুলে থাকেন, তাহলে তার ওযু নষ্ট হবে না, যতক্ষণ না কোনো শরীয়ত নির্ধারিত ওযু ভঙ্গের কারণ ঘটে।

উলংগ হওয়া সংক্রান্ত আদব ও নীতিমালা

ইসলাম শুধু ইবাদতের নিয়মই নয়, ব্যক্তিগত জীবনযাপনের সৌজন্যবোধ ও শালীনতার প্রতিও গভীরভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। উলংগ হওয়া—চাই তা একাকী হোক কিংবা জনসমক্ষে—এ সম্পর্কেও ইসলামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদব ও বিধান রয়েছে। নিচে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

১. নির্জনে হলেও লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা ওয়াজিব

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বেশি লজ্জাবতী এবং লজ্জাকে ভালোবাসেন। তাই যখন তোমাদের কেউ গোসল করে, সে যেন নিজের সতর ঢেকে রাখে।” (আবু দাউদ, হাদিস 4012)

এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, এমনকি যখন একাকী থাকি, তখনও সম্পূর্ণ উলংগ হওয়া থেকে পরহেজ করা উচিত। সতর (লজ্জাস্থান) সর্বদা সম্মান ও গোপনীয়তার সাথে রাখা ইসলামের শিক্ষা।

২. চরম প্রয়োজনে (যেমন গোসলের সময়) উলংগ হওয়া জায়েয

কখনো কখনো, যেমন ফরজ গোসল বা অশুদ্ধি দূর করার জন্য শরীরের সমস্ত অংশ ধৌত করা আবশ্যক হয়। এমন ক্ষেত্রে প্রয়োজনে উলংগ হওয়া জায়েয। তবে যতটা সম্ভব আড়াল রক্ষা করা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়)।

৩. সতর ঢাকতে আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করা

গোসলের সময় পর্দা ব্যবহার করা, দরজা বন্ধ করা, কিংবা আচ্ছাদন করে নেওয়া—এসব ইসলামী আদবের মধ্যে পড়ে। সাহাবায়ে কেরামও প্রয়োজনীয় পর্দার ব্যবস্থা করতেন।

৪. জনসম্মুখে উলংগ হওয়া কঠোরভাবে হারাম

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“লোকদের মাঝে কাপড় ছাড়া চলাফেরা করো না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস – ৩৪১৪)

জনসমক্ষে উলংগ হওয়া চরম গুনাহ এবং কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি আধুনিক কালের ‘নিম্নস্তরীয় পোশাক’ও ইসলামের দৃষ্টিতে সতর অমর্যাদা করা বলে গণ্য হয়।

৫. লজ্জাস্থানের প্রতি সম্মান রাখা ঈমানের অঙ্গ

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“লজ্জা ঈমানের অংশ।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৩৬)

সতর সংরক্ষণ করা শুধু সামাজিক সৌজন্য নয়, বরং এটি সরাসরি ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত। উলংগ হওয়া বা লজ্জাস্থান প্রকাশে নির্লজ্জ হওয়া ধীরে ধীরে ঈমানের দুর্বলতার দিকে নিয়ে যায়।

সারসংক্ষেপ

শুধু উলংগ হওয়া, একা হোক বা অন্যের সামনে, ওযু ভঙ্গের কারণ নয়। ওযু তখনই ভাঙে যখন শরীয়তে নির্ধারিত নির্দিষ্ট কিছু কাজ সংঘটিত হয়, যেমন প্রস্রাব-পায়খানা, গ্যাস নির্গমন, ইত্যাদি। তাই গোসলের সময়, কাপড় পরিবর্তনের সময় বা চিকিৎসার প্রয়োজনে উলংগ হলেও ওযু অটুট থাকে, যদি কোনো নাপাকী বের না হয়। তবে ইসলামের আদব হলো — নির্জনে থাকলেও সতর ঢেকে রাখা, লজ্জাশীলতা বজায় রাখা এবং অপ্রয়োজনে উলংগ না হওয়া। এটাই ঈমানের সৌন্দর্যের অন্যতম নিদর্শন।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x