ওজুর ফরজ বা মৌলিক রুকনগুলো এমন কিছু কাজ যা ওজুর অস্তিত্ব নির্ধারণ করে। এগুলোর কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে অজু শুদ্ধ হবে না। সেই অজু দ্বারা নামাজ বা অন্য ইবাদত শরিয়তসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। আমরা এখানে ওযুর ফরজ কয়টি? কী কী? চার মাযহাবের ভিত্তিতে আমরা বিষয়টি আলোচনা করছি।
ওযুর ফরজ কয়টি?
হানাফি মাযহাবে ওযুর ফরজ ৪ টি। তবে অন্য মাযহাবে আরো বেশি ফরজ রয়েছে। আমরা এখানে কেবল হানাফি মাযহাবের কথা আলোচনা করব। আর অন্য মাযহাবের মতগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করব।
১. সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল ধৌত করা
মুখমণ্ডল বলতে বোঝানো হয় – মুখের যে অংশটি সামনাসামনি থাকে। এর সীমানা হলো:
- লম্বাভাবে: কপালের উপরিভাগ থেকে চিবুক ও থুতনির নিচ পর্যন্ত।
- চওড়াভাবে: এক কান থেকে অন্য কান পর্যন্ত।
মুখমণ্ডল ধৌত করা অজুর অন্যতম ফরজ বা রুকন। এটি ছাড়া অজু শুদ্ধ হয় না। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ}
“হে ঈমানদারগণ, যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ধৌত করো।” (সূরা মায়িদা: ৬)
যাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অজুর বর্ণনা বর্ণনা করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মুখমণ্ডল ধৌত করার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে সকল আলেমের ঐক্যমত্য রয়েছে।
মুখে পানি নেওয়া (মাযমাযা) এবং নাকে পানি নেওয়া (ইস্তিনশাক) ওয়াজিব
মাযমাযা: কুলি করা এবং এর মুখের ভেতরে পানি ঘোরানো।
ইস্তিনশাক: নাকের ভেতরে পানি প্রবেশ করানো এবং শ্বাসের সাহায্যে নাকের গভীর পর্যন্ত তা পৌঁছানো।
ইস্তিনসার: ইস্তিনশাকের পর নাক থেকে পানি বের করে ফেলা।
অজুর ক্ষেত্রে মুখে এবং নাকে পানি নেওয়া অধিকতর সঠিক মতে ফরজ হিসেবে গণ্য। তবে হানাফি মাযহাবে এটি সুন্নাহ। এর কারণ নিম্নরূপ:
মতামত
অজু ও গোসলের ক্ষেত্রে মুখে পানি নেওয়া (মাযমাযা) এবং নাকে পানি টানা (ইস্তিনশাক) সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে চারটি মতামত রয়েছে:
প্রথম মত: মাযমাযা ও ইস্তিনশাক গোসলের ক্ষেত্রে ফরজ, কিন্তু অজুর ক্ষেত্রে নয়। এই মত পোষণ করেছেন সাওরী, আবু হানিফা এবং আহলে রায়ের অন্যান্য ফকিহগণ।
দ্বিতীয় মত: মাযমাযা ও ইস্তিনশাক গোসল ও অজু উভয়ের ক্ষেত্রে সুন্নত। এটি মালিক, শাফেয়ী, লৈস, আওযায়ী এবং অনেক আলেমের মত।
তৃতীয় মত: মাযমাযা ও ইস্তিনশাক উভয়ই গোসল ও অজু উভয়ের ক্ষেত্রে ফরজ। এই মত পোষণ করেছেন আতা, ইবনে জুরাইজ, ইবনে মুবারক, ইসহাক, এবং আহমদ ইবনে হাম্বলের একটি বর্ণনা মতে। এটি হাম্বলি মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত।
চতুর্থ মত: ইস্তিনশাক উভয় ক্ষেত্রেই ফরজ, কিন্তু মাযমাযা উভয় ক্ষেত্রেই সুন্নত। এই মত পোষণ করেছেন আহমদ (একটি বর্ণনা অনুযায়ী), আবু উবাইদ, আবু সাওর, এবং হাদিসবিশারদদের একটি দল। ইবনে মুনযির এই মতকে গ্রহণ করেছেন।
দাড়ি ও মুখমণ্ডলের অন্যান্য লোম ধৌত করার বিধান
যদি মুখে গজানো লোম (দাড়ি, গোঁফ, নীচের ঠোঁটের নীচের লোম, ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি) ঘন হয় এবং ত্বক দেখা না যায়, তাহলে বাহ্যিক লোম ধৌত করাই যথেষ্ট।
কিন্তু যদি লোম পাতলা হয় এবং ত্বক দেখা যায়, তাহলে ত্বকসহ লোম ধৌত করতে হবে। যদি কোনো অংশ পাতলা এবং কোনো অংশ ঘন হয়, তবে পাতলা অংশের ত্বক ধৌত করতে হবে এবং ঘন অংশের বাহ্যিক অংশ ধৌত করাই যথেষ্ট।
আবু হানিফা এবং আহমদ (একটি বর্ণনা অনুযায়ী) বলেছেন যে, দাড়ির নিচে ঝুলে থাকা অংশ ধৌত করা ফরজ নয়। মুখমণ্ডলের সীমানার মধ্যে যা পড়ে কেবল সেটুকুই ধৌত করা ফরজ। কারণ, এখানে মুখমণ্ডল বলতে মূলত ত্বককেই বোঝানো হয়েছে।
অন্যদিকে, শাফেয়ী এবং আহমদের প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী দাড়ির নিচে ঝুলে থাকা অংশ ধৌত করাও ফরজ। কারণ, এটি ফরজ সীমানার ভেতরে জন্মানো এবং বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান হওয়ায় মুখমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। এই মতই অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়।
২. কনুইসহ হাত ধৌত করা
উভয় হাত কনুইসহ ধৌত করা ওজুর আরেকটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন:
{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ}
“হে ঈমানদারগণ, যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করো।” (সূরা মায়িদা: ৬)
আলেমগণ এই ব্যাপারে একমত যে, অজুর ক্ষেত্রে হাত ধৌত করা ফরজ।
“ইলা” শব্দের ব্যাখ্যা: আল্লাহর বাণীতে {وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ} (হাত কনুই পর্যন্ত) “ইলা” শব্দটি আরবী ভাষায় “মাআ’” অর্থাৎ “সহ” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণ:
- {وَلاَ تَاكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ} (তোমাদের সম্পদের সঙ্গে তাদের সম্পদ খেও না।)
- {وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَى قُوَّتِكُمْ} (তিনি তোমাদের শক্তির সঙ্গে আরও শক্তি বৃদ্ধি করবেন।)
এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কনুই ধৌত করা হাত ধৌত করার অন্তর্ভুক্ত এবং ফরজ। এটাই অধিকাংশ আলেমের মত। যদিও কিছু মালিকী আলেম এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আমল:
“তিনি অজু করলেন এবং তাঁর হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করলেন, এমনকি উপরের অংশেও পানি পৌঁছালেন। পা ধৌত করলেন এমনভাবে যে, তা পায়ের গোড়ালির উপরে পৌঁছে গেল। এরপর তিনি বললেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে এভাবেই অজু করতে দেখেছি।’” (সহীহ মুসলিম)
বিধানগত নীতি: শরীয়তের একটি মূলনীতি হলো: “যা ছাড়া কোনো ফরজ পূর্ণ হয় না, তা-ও ফরজ।” হাত ধৌত করার ক্ষেত্রে কনুই পর্যন্ত ধৌত করা ছাড়া এই ফরজ পূর্ণ হয় না। তাই কনুইসহ ধৌত করা ফরজ।
৩. মাথা মাসাহ করা
মাথা মাসাহ করা ওজুর আরেকটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন:
{وَامْسَحُوا بِرُؤُوسِكُمْ}
“তোমাদের মাথা মাসাহ করো।” (সূরা মায়িদা: ৬)
আলেমগণ একমত যে, মাথা মাসাহ করা অজুর ফরজ। তবে মাসাহের পরিমাণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে তিনটি মত রয়েছে:
প্রথম মত
পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য পুরো মাথায় মাসাহ করা ফরজ। এটি মালিক, আহমদ (প্রধান মত), অধিকাংশ হাম্বলি ফকিহ, আবু উবাইদ, ইবনে মুনযির এবং ইবনে তাইমিয়ার মত।
দ্বিতীয় মত
মাথার কিছু অংশে মাসাহ করাই যথেষ্ট। এটি আবু হানিফা ও শাফেয়ীর মত। তবে তারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন যে, কতটুকু অংশে মাসাহ করতে হবে: কেউ বলেছেন তিনটি চুল, কেউ বলেছেন মাথার এক-চতুর্থাংশ, আবার কেউ বলেছেন অর্ধেক।
তৃতীয় মত
পুরুষের জন্য পুরো মাথায মাসাহ করা ফরজ, তবে নারীদের ক্ষেত্রে তা নয়। কিছু অংশ করে নিলেই হবে।
এটি আহমদের একটি বর্ণিত মত। এই মত অনুযায়ী, নারীদের জন্য মাথার সামনের অংশ মাসাহ করাই যথেষ্ট।
৪. গোঁড়ালিসহ পা ধৌত করা
ওজু করার সময় পা ধৌত করা সর্বসম্মতভাবে ফরজ। এটি অধিকাংশ আহলে সুন্নাহর মতে প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন:
{وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ}
“তোমাদের পা গোঁড়ালি পর্যন্ত ধৌত করো।” (সূরা মায়িদা: ৬)
সুন্নাহ থেকে প্রমাণ
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অজুর বর্ণনাগুলোর প্রতিটিতেই পা ধৌত করার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস: তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ ﷺ পা তিনবার ধৌত করতেন এবং গোঁড়ালি পর্যন্ত পরিষ্কার করতেন। (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
গোঁড়ালি ধৌত করার আবশ্যকতা
গোঁড়ালি ধৌত করা অজুর অন্তর্ভুক্ত, কারণ শরিয়তের নিয়ম অনুসারে, সীমানার মধ্যে যা পড়ে, তা ধৌত করতে হয়।
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস: ইবনে উমর বলেন, এক সফরে আমরা ছিলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং দেখলেন আমরা তাড়াহুড়ো করে পায়ে মাসাহ করছি। তিনি উচ্চ স্বরে বললেন:
“দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের গোঁড়ালি আগুনে পুড়বে।” তিনি এটি দুই বা তিনবার বললেন। (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
অন্য মাযহাবে ওজুর আরো কিছু ফরজ
নিয়ত করা ওজুর ফরজ
অজুর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো নিয়ত। অধিকাংশ ফকিহদের মতে—যেমন মালিক, শাফেয়ি, আহমদ, ইসহাক, এবং লেইস — অজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত অপরিহার্য।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাণী, তিনি বলেন:
“সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিমে উল্লেখিত, এবং এটি একটি মুতাওয়াতির হাদিস।)
“إِنَّمَا” শব্দের গুরুত্ব: এই হাদিসে ব্যবহৃত “إِنَّمَا” শব্দটি একচেটিয়া অর্থ বহন করে। এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে: “কোনো কাজই শুদ্ধ হয় না, যদি তা নিয়তের সঙ্গে না হয়।”
কান মাসাহ করা (مسح الأذنين)
অজুর সময় কান মাসাহ করা ফরজ, কারণ কানকে মাথার অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাণী: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“কান মাথার অংশ।” (এই হাদিসটি মারফু হিসেবে দুর্বল হলেও এটি সাহাবি ইবনে উমর (রা.)-এর মতো অনেক সালাফের থেকে সাব্যস্ত।)
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আমল: যেসব হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অজুর বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে যে তিনি মাথার সঙ্গে কানও মাসাহ করতেন।
অজুর অঙ্গগুলোর ক্রমানুসারে ধৌত করা (ترتيب)
অজুর সময় অঙ্গগুলোকে নির্ধারিত ক্রমে ধৌত করা ফরজ। এই ক্রমটি আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন:
{فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ}
এই নির্দেশ অনুযায়ী, অজুর ক্রম হলো:
- প্রথমে মুখমণ্ডল ধৌত করা।
- তারপর হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করা।
- এরপর মাথায় মাসাহ করা।
- সবশেষে পা গোঁড়ালি পর্যন্ত ধৌত করা।
ক্রমানুসারে ধৌত করার বিধান
- অধিকাংশ আলেমের মতে, এই ক্রমানুসার শর্ত এবং এটি পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
- এটি শাফেয়ি, হাম্বলি, আবু সাওর, আবু উবাইদ এবং জাহিরি মাযহাবের মত।
মুওয়ালাত (ক্রমাগত ধৌত করা)
এটি হল অজুর প্রত্যেক অঙ্গ একে অপরের পরপর ধৌত করা, যেন এক অঙ্গ ধৌত করার পর অন্য অঙ্গ ধৌত করার আগে ধৌতকৃত অঙ্গগুলো শুকিয়ে না যায়।
শাফেয়ি মাজহাবের পুরাতন মত অনুযায়ী এবং আহমদ ইবনে হাম্বলের প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী মুওয়ালাত ফরজ। মালিক (রহ.)-ও এটিকে ফরজ বলেছেন, তবে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিরতি দেওয়া এবং অসাবধানতাবশত বিরতি দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। এই মতটিই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াও পছন্দ করেছেন।