ওযুর সুন্নত কয়টি? ১৪ না কি ১২ টি । ছবিসহ বিবরণ ও রেফারেন্স

পোস্টটি শেয়ার করুন

ওযুতে কিছু ফরজ কাজ রয়েছে যা অবশ্য পালনীয়। আবার কিছু সুন্নত কাজ রয়েছে, যা পালন করলে ওযু অধিক বরকতময় এবং পূর্ণাঙ্গ হয়। এই সুন্নতগুলো শুধু রাসুল (ﷺ)-এর অনুসরণের অংশ নয়, বরং এগুলো ওযুর সৌন্দর্য ও ফজিলত বৃদ্ধি করে। এ পোস্টে আমরা ওযুর সুন্নত কয়টি- এ নিয়ে আলোচনা করব এবং দেখব কিভাবে এগুলো আমাদের ইবাদতে আরও গভীরতা আনে।

ওযুর সুন্নত কয়টি?

ওযুর সুন্নত মূলত ১৪ টি। মাযহাব ও ইমামদের অভিমতের ভিত্তিতে সেখানে একটি দুটি বাড়তে বা কমতে পারে। তবে আমারা এখানে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত ওযুর ১৪ টি সুন্নত নিয়ে আলোচনা করব। যথা:

  • মিসওয়াক করা।
  • অজুর শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া।
  • অজুর শুরুতে হাতের তালু ( কব্জি পর্যন্ত ) ধোয়া।
  • কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া ( এক হাতের তালু থেকে পানি নিয়ে )
  • ভালোভাবে কুলি করা ও নাকের গভীরে পানি দেওয়া (রোজাদার ব্যতীত)
  • ডান দিক থেকে শুরু করা।
  • প্রতিটি অঙ্গ তিনবার করে ধোয়া।
  • ঘন দাড়ি খিলাল করা (পানির সাথে)।
  • অঙ্গগুলো ঘষা।
  • হাত ও পায়ের আঙুলগুলো খিলাল করা (পানি পৌঁছানো কঠিন হলে)
  • ফরজ স্থান থেকে বেশি ধোয়া।
  • পানির ব্যবহারে সংযমী হওয়া।
  • অজুর পর দোয়া পড়া।
  • অজুর পর দুই রাকাত নামাজ আদায় করা।

১. মিসওয়াক করা

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন: “যদি আমি আমার উম্মতের জন্য কষ্টের আশংকা না করতাম, তবে আমি তাদেরকে প্রতিটি ওযুর সাথে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।” (নাসাঈ)

২. অজুর শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া

বিসমিল্লাহ বলা নিজেই একটি মহৎ এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় কাজ। ওযুর সময় বিসমিল্লাহ পড়া সম্পর্কে হাদিস রয়েছে, তবে বেশিরভাগ হাদিসই দুর্বল।

এর মধ্যে একটি হাদিস হলো:

“যে ব্যক্তি অজুর সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে না, তার অজু হয় না।” ( আবু দাউদ :১০১, যঈফ)

এই হাদিসটি দুর্বল বলে অভিহিত করা হয়েছে, যদিও কিছু আলিম এটি সহীহ বলেছেন।

এছাড়া অত্যন্ত দুর্বল কিছু হাদিসও পাওয়া যায়, যেগুলো প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
সেই কারণে ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন:

“আমি এ বিষয়ে কোনো সনদযুক্ত ভালো হাদিস জানি না।”

বিসমিল্লাহর বাধ্যতামূলক না হওয়ার পক্ষে দলিল

যারা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর অজুর বিবরণ বর্ণনা করেছেন, তারা কেউই বিসমিল্লাহর উল্লেখ করেননি। এটি সাওরী, মালিক, শাফেয়ি এবং আসহাবে রায়ের (হানাফি মাজহাবের আলিমগণ) মত। এটি ইমাম আহমদেরও একটি বর্ণনা।

৩. অজুর শুরুতে হাতের তালু ( কব্জি পর্যন্ত ) ধোয়া

উসমান (রা.)-এর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওযুর বিবরণে এসেছে:

“… অতঃপর তিনি তিনবার হাতের তালুতে পানি ঢেলে হাত ধুয়েছেন।” ( সহিহ বুখারি : ১৫৯)

৪. কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া ( এক হাতের তালু থেকে পানি নিয়ে )

আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.)-এর হাদিসে বর্ণিত:

“তিনি এক হাতের তালু থেকে পানি নিয়ে কুলি করতেন ও নাকে পানি দিতেন এবং এটি তিনবার করলেন।” ( সহিহ মুসলিম : ২৩৫)

৫. ভালোভাবে কুলি করা ও নাকের গভীরে পানি দেওয়া (রোজাদার ব্যতীত)

লাকীত ইবনে সাবিরাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“গভীরভাবে নাকে পানি টানো, তবে যদি রোজা থাকো তাহলে এটা করো না।” ( আবু দাউদ : ১৩২)

ওজুর সুন্নত ছবি
ওযুর সুন্নত ছবি

৬. ডান দিক থেকে শুরু করা

ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হাদিসে বর্ণিত:

“… অতঃপর তিনি পানি নিয়ে ডান হাত ধুলেন, তারপর পানি নিয়ে বাম হাত ধুলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন। তারপর পানি নিয়ে ডান পা ধুলেন এবং এরপর পানি নিয়ে বাম পা ধুলেন।” ( সহিহ বুখারি : ১৪০)

আরও এসেছে, হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন:

“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ডান দিককে পছন্দ করতেন: জুতা পরা, চুল আঁচড়ানো, ওজু করা এবং প্রতিটি কাজে।” ( সুহিহ বুখারি : ১৬৮)

৭. প্রতিটি অঙ্গ তিনবার করে ধোয়া

রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর থেকে সহীহ বর্ণনা এসেছে যে তিনি,

  • একবার একবার ধৌত করে ওজু করেছেন,
  • দু’বার দু’বার ধৌত করে ওজু করেছেন,
  • আর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ওযু হলো তিনবার তিনবার ধৌত করে অজু করা।
    উসমান (রা.) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.)-এর হাদিসে এই পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। ( সহিহ বুখারি : ১৫৬/১৫৭)

দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা

(ক) মাথা মাসাহ একবারই করতে হবে:

মাথা মাসাহ করার ক্ষেত্রে একবারই করা সুন্নত। ওযুর বর্ণনায় যে দ্বিগুণ বা তিনবার ধোয়ার কথা এসেছে, তা মাথা মাসাহের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেসব বর্ণনায় মাথা তিনবার মাসাহ করার কথা উল্লেখ রয়েছে, সেগুলো সহীহ নয়।আর যে বর্ণনায় দু’বার মাসাহ করার কথা এসেছে, সেটি এই কথার ব্যাখ্যা যে:

“তিনি (দুই হাতে) মাথার সামনে থেকে পেছনে নিয়ে গিয়ে আবার সামনে ফিরিয়ে আনলেন।”

(খ) তিনবারের বেশি ধোয়া মাকরূহ:

ওযুর অঙ্গ তিনবার ধোয়া পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ওযু। তিনবারের বেশি ধোয়া মাকরূহ। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“যে ব্যক্তি এর (তিনবার ধোয়ার) বেশি করে, সে সীমা লঙ্ঘন করে, অন্যায় এবং জুলুম করে।”

তবে এই বিধান তখন প্রযোজ্য, যখন তিনবার ধোয়ার মাধ্যমে অজু পরিপূর্ণ হয় যায়। যদি কোনো অঙ্গ ধোয়ার মধ্যে অসম্পূর্ণতা থাকে, তাহলে তা পূর্ণ করার জন্য তিনবারের বেশি ধোয়া বৈধ। কিন্তু যখন তিনবার বা তার কমের মাধ্যমে অজু সম্পূর্ণ হয়, তখন এর অতিরিক্ত ধোয়া মাকরূহ এবং এতে কোনো মতপার্থক্য নেই।

৮. ঘন দাড়ি খিলাল করা (পানির সাথে)

যদি দাড়ি এত ঘন হয় যে ত্বক দেখা যায় না, তবে বাইরের অংশ ধোয়া যথেষ্ট। তবে, দাড়ি আচড়ানো বা পানির মাধ্যমে ভেজানো সুন্নত। হাদিসে এসেছে, আনাস (রা.) বলেন:

“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যখন অজু করতেন, তখন এক মুঠো পানি নিয়ে থুতনির নিচে দিতেন এবং দাড়ি আচড়াতেন। তিনি বলতেন: ‘এভাবেই আমার প্রভু আমাকে আদেশ দিয়েছেন।’ ( আবু দাউদ : ১৪৫)

এই আদেশটি রেফায়া ইবনে রাফেয় (রা.)-এর হাদিস অনুযায়ী সুন্নত বা প্রিয় আমলের মধ্যে গণ্য।

৯. অঙ্গগুলো ঘষা

আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন:

“আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে অজু করতে দেখেছি। তিনি তাঁর বাহু ঘষছিলেন।” ( ইবনু হিব্বান : ১০৮২)

১০. হাত ও পায়ের আঙুলগুলো খিলাল করা (পানি পৌঁছানো কঠিন হলে)

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“ওযু সম্পূর্ণ করো, আঙুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পানি পৌঁছাও, আর রোজা না থাকলে নাকের গভীরে পানি টানো।” ( আবু দাউদ : ১৩২)

যদি আঙুল বা আঙুলের ফাঁকে পানি পৌঁছানো না হয়, তবে আঙুল ( এক হাতের আঙুল অন্য হাত / পায়ের আঙুলের ভেতর ঢুকিয়ে) আচড়ানো বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

১১. ফরজ স্থান থেকে বেশি ধোয়া

অজুতে পূর্ণতা আনতে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে ফরজ স্থান থেকে অতিরিক্ত ধোয়া সুন্নত।

  • মুখ ধোয়ার সময় কপালের সামনের অংশ পর্যন্ত ধোয়া (إطالة الغرة)
  • হাত ধোয়ার সময় কনুইয়ের ওপরে এবং পা ধোয়ার সময় গোড়ালির ওপরে পর্যন্ত ধোয়া (إطالة التحجيل)

আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“আমার উম্মত কিয়ামতের দিন উজ্জ্বল কপাল ও উজ্জ্বল হাত-পা নিয়ে উপস্থিত হবে, যা হবে অজুর চিহ্ন।”

আবু হুরাইরা (রা.) আরও বলেন:

“তোমাদের মধ্যে যার সাধ্য আছে, সে যেন এই উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে নেয়।” ( ( সহিহ বুখারি : ৩৬)

আরও এসেছে, আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন:

“রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে আমি বলতে শুনেছি: মুমিনের অলঙ্কার তার অজুর স্থান পর্যন্ত পৌঁছাবে।” ( সহিহ মুসলিম : ২৫০)

১২. পানির ব্যবহারে সংযমী হওয়া

অজু ও গোসলের সময় পানি নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা সুন্নত। হাদিসে এসেছে, আনাস (রা.) বলেন:

“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এক সা’ ( চার মুদ) থেকে পাঁচ মুদ পর্যন্ত পানি দিয়ে গোসল করতেন এবং এক মুদ পানি দিয়ে অজু করতেন।” ( সহিহ বুখারি : ২০১)

  • সা’: চার মুদ সমান।
  • মুদ: আধা লিটার বা তার কাছাকাছি।

আরো পড়ুন:

১৩. অজুর পর দোয়া পড়া

উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“তোমাদের কেউ যখন অজু সম্পন্ন করে, এরপর বলে:

(أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله)

অর্থাৎ, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসুল।’

তখন জান্নাতের আটটি দরজা তার জন্য খুলে দেওয়া হবে, এবং সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা, জান্নাতে প্রবেশ করবে।” ( সহিহ মুসলিম : ২৩৪)

১৪. অজুর পর দুই রাকাত নামাজ আদায় করা

উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) বলেন:

“আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে আমার মতো অজু করতে দেখেছি। এরপর তিনি বললেন: ‘যে ব্যক্তি আমার মতো অজু করে, তারপর দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে এবং সেই দু’রাকাতে আত্মসংলাপ করবে না (অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগী হবে না), তবে তার পূর্বকৃত যাবতীয় পাপ ক্ষমা করা হবে।’ (বুখারী : ১৬৪, মুসলিম : ২২৬)

অজুর পর অঙ্গ শুকানোর বিধান

অঙ্গ শুকানো বা মোছা বৈধ

অজুর পরে অঙ্গ শুকানো বা তোয়ালে দিয়ে মোছা বৈধ, কারণ এর নিষেধাজ্ঞার কোনো প্রমাণ নেই। শরীয়তের মূল নীতি হলো যা নিষিদ্ধ নয়, তা বৈধ।

যদি কেউ প্রশ্ন করে:

“মাইমুনা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) গোসলের পর তাঁকে একটি তোয়ালে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা ব্যবহার করেননি এবং হাত ঝেড়ে চলে যান।” ( সহিহ বুখারি : ২৭০ )

তাহলে উত্তর হবে:

এই ঘটনা বিশেষ প্রেক্ষাপট নির্দেশ করে। হয়তো তোয়ালে ব্যবহারের উপযোগী ছিল না, যেমন এটি অপরিষ্কার ছিল বা ভিজে যেতে পারে বলে তিনি তা ব্যবহার করেননি।

তবে, মাইমুনা (রা.)-এর তোয়ালে দেওয়া থেকে ধারণা করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) মাঝে মাঝে অঙ্গ শুকানোর জন্য তোয়ালে ব্যবহার করতেন। এ বিষয়টি আরও সমর্থিত যে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) একবার অজু করার পর একটি পশমের জামা উল্টে তা দিয়ে অঙ্গ মোছেন।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x