ইসলামে গুনাহ দুই প্রকার—কবিরা (বড়) গুনাহ ও সগিরা (ছোট) গুনাহ। কবিরা গুনাহ হলো সেই সব পাপ, যেগুলো কুরআন ও হাদিসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং যেগুলোর জন্য শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এসব গুনাহ মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ব্লগপোস্টে আমরা ৭০ টি কবিরা গুনাহের তালিকা তুলে ধরবো, যাতে আমরা নিজেদের জীবনকে শিরক, সুদ, মিথ্যা, প্রতারণা, অন্যায় হত্যা ইত্যাদি ভয়ংকর পাপ থেকে রক্ষা করতে পারি।
কিছু পাপ এমন আছে, যা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কবরের আজাবের কারণ হয় এবং কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন করে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এসব গুনাহ সম্পর্কে জানা, সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
৭০ টি কবিরা গুনাহের তালিকা
১. আল্লাহর সাথে শিরক করা
২. আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হওয়া
৩. আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ মনে করা
4. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে কসম খাওয়া
৫. জাদু করা
৬. হত্যা করা (ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া)
৭. সুদ খাওয়া
৮. ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা
৯. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
১০. অভিভাবকের অবাধ্য হওয়া
১১. অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ গ্রহণ করা
১২. ঘুষ দেওয়া ও গ্রহণ করা
১৩. রোজা ইচ্ছাকৃতভাবে ভঙ্গ করা
১৪. নামাজ ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেওয়া
১৫. হজ ফরজ হওয়ার পরও আদায় না করা
১৬. জাকাত না দেওয়া
১৭. ব্যভিচার করা
১৮. লওয়াত (সমকামিতা) করা
১৯. অন্যায়ভাবে মুসলিমদের সম্পদ লুট করা
২০. মিথ্যা অপবাদ দেওয়া
২১. অসৎ উপায়ে উপার্জন করা
২২. আত্মহত্যা করা
২৩. মদপান করা
২৪. যাদুকরদের সাহায্য নেওয়া
২৫. বিদআত প্রচার করা
২৬. নারীদের পুরুষদের মতো পোশাক পরা এবং পুরুষদের নারীদের মতো পোশাক পরা
২৭. হারাম সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা
২৮. অন্যায়ভাবে তালাক দেওয়া
২৯. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো
৩০. পিতামাতার অবাধ্যতা করা
৩১. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা
৩২. স্বামীকে অবজ্ঞা করা
৩৩. কৃপণতা করা
৩৪. দান করে লোক দেখানো
৩৫. ঈর্ষা ও হিংসা করা
৩৬. অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা
৩৭. অহংকার করা
৩৮. গিবত (পরনিন্দা) করা
৩৯. চোগলখুরি করা
৪০. কাউকে অকারণে কষ্ট দেওয়া
৪১. প্রতারণা করা
৪২. ওজন ও মাপে কম দেওয়া
৪৩. ন্যায়ের বিরুদ্ধে ফয়সালা দেওয়া
৪৪. অন্যের হক নষ্ট করা
৪৫. মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা
৪৬. অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো
৪৭. মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা
৪৮. আত্মসন্তুষ্টিতে মগ্ন থাকা
৪৯. দ্বীনের নামে মিথ্যা বলা
৫০. কাফেরদের অনুকরণ করা
৫১. শয়তানকে বন্ধু বানানো
৫২. জেনে-বুঝে ভুল ব্যাখ্যা করা
৫৩. আত্মগৌরব প্রকাশ করা
৫৪. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া
৫৫. মানুষকে নিয়ে উপহাস করা
৫৬. অলসতা করা এবং সময় নষ্ট করা
৫৭. হারাম পোশাক পরিধান করা
৫৮. স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে শাসন করা
৫৯. রাসূল ﷺ-কে অসম্মান করা
৬০. কবর পূজা করা
৬১. মুনাফেকি করা
৬২. মৃত ব্যক্তির নামে পশু জবাই করা
৬৩. সৃষ্টিকে অভিশাপ দেওয়া
৬৪. বিদ্রোহ করা
৬৫. মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা
৬৬. অন্যায়ভাবে চাকরি গ্রহণ করা
৬৭. কুরআন ও সুন্নাহকে উপহাস করা
৬৮. অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ছড়ানো
৬৯. আলেমদের অবজ্ঞা করা
৭০. অন্যায়ভাবে দাস-দাসীদের উপর নির্যাতন করা
কবিরা গুনাহগুলো কীভাবে প্রমাণিত হয়েছে?
কবিরা গুনাহগুলো কুরআন, সহিহ হাদিস ও ইসলামী স্কলারদের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণত, কোনো গুনাহকে কবিরা গুনাহ বলার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ রাখা হয়—
১. কুরআনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও শাস্তির বর্ণনা
যেসব গুনাহ সম্পর্কে কুরআনে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এসেছে এবং কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে কবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন—
🔹 শিরক সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না, কিন্তু এর বাইরে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।”
📖 (সূরা আন-নিসা: ৪৮)
🔹 সুদ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
“যারা সুদ খায়, তারা সেই ব্যক্তির মতো উঠে দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।”
📖 (সূরা আল-বাকারাহ: ২৭৫)
🔹 অন্যায়ভাবে হত্যা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
“যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার প্রতিদান জাহান্নাম—যেখানে সে চিরস্থায়ী হবে।”
📖 (সূরা আন-নিসা: ৯৩)
২. সহিহ হাদিসে কঠোর হুঁশিয়ারি
যেসব গুনাহ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ সরাসরি কঠোর শাস্তির কথা বলেছেন, সেগুলো কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন—
🔹 সাতটি ধ্বংসকারী পাপ সম্পর্কে তিনি বলেন:
“তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো— (১) আল্লাহর সাথে শরিক করা, (২) জাদু করা, (৩) হত্যাকাণ্ড, (৪) সুদ খাওয়া, (৫) ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, (৬) যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা, (৭) সতী-সাধ্বী নারীকে অপবাদ দেওয়া।” 📖 (সহিহ বুখারি: ২৭৬৬, সহিহ মুসলিম: ৮৯)
🔹 মিথ্যা সাক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন:
“মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরকের সমতুল্য।”📖 (সহিহ মুসলিম: ৮৭)
🔹 পিতামাতার অবাধ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন:
“পিতামাতার অবাধ্যতা অন্যতম বড় কবিরা গুনাহ।” 📖 (সহিহ বুখারি: ২৬৫৪)
৩. উলামায়ে কেরামের ব্যাখ্যা
কুরআন ও হাদিস বিশ্লেষণ করে ইসলামি স্কলারগণ কবিরা গুনাহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। ইমাম যাহাবি (রহ.) তার বিখ্যাত বই “আল-কাবায়ির” (الكبائر)-এ ৭০টি কবিরা গুনাহ তালিকাভুক্ত করেছেন।
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন:
“কোনো গুনাহ যদি কুরআন ও হাদিসে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারিসহ বর্ণিত হয়, তবে সেটি কবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য হবে।”
৪. গুনাহের ভয়াবহ পরিণতি
যেসব গুনাহের কারণে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে আজাবের সম্মুখীন হয়, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়, সেগুলো কবিরা গুনাহ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সারসংক্ষেপ:
✅ কুরআনের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও শাস্তির ঘোষণা
✅ সহিহ হাদিসে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি
✅ প্রসিদ্ধ ইসলামি স্কলারদের ব্যাখ্যা
✅ গুনাহের ভয়াবহ পরিণতি
এইসব প্রমাণের ভিত্তিতে ৭০টি কবিরা গুনাহ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব।
কবিরা গুনাহ থেকে বাঁচার উপায়
কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ইসলামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলো মেনে চললে একজন মুসলমান সহজেই বড় গুনাহ থেকে দূরে থাকতে পারেন এবং আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারেন। নিচে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো—
১. তাওহিদের ওপর অটল থাকা
👉 আল্লাহর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করা এবং শিরকসহ সব বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
📖 আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না, তবে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” 📖 (সূরা আন-নিসা: ৪৮)
২. খাঁটি তওবা করা
👉 গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে খাঁটি তওবা করা।
তওবার শর্ত তিনটি—
1️⃣ গুনাহ ছেড়ে দেওয়া
2️⃣ গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া
3️⃣ ভবিষ্যতে তা না করার দৃঢ় সংকল্প করা
📖 আল্লাহ বলেন:
“হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সূরা আত-তাহরীম: ৮)
৩. ফরজ ইবাদত ঠিকমতো আদায় করা
👉 পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়া, রোজা রাখা, জাকাত দেওয়া ও হজ আদায় করা।
📖 রাসূল ﷺ বলেছেন:
“নিশ্চয়ই নামাজ গুনাহ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আল-আঙ্কাবূত: ৪৫)
৪. আল্লাহর জিকির ও দোয়া করা
👉 নিয়মিত আল্লাহর জিকির করা এবং কবিরা গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য দোয়া করা।
📖 রাসূল ﷺ বলেন:
“যে ব্যক্তি দিনে ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ পড়ে, তার গুনাহ মাফ করা হয়, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মতো হয়।” (সহিহ বুখারি: ৬৪০৪)
৫. ভালো সঙ্গ বেছে নেওয়া
👉 খারাপ বন্ধু ও পরিবেশ এড়িয়ে চলা এবং নেককার ও দ্বীনদার লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করা। রাসূল ﷺ বলেছেন:
“মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের ওপর থাকে। তাই দেখো, তোমার বন্ধু কে?” (সুনান আবু দাউদ: ৪৮৩৩)
৬. কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা
👉 ইসলামী জ্ঞান অর্জন করলে কবিরা গুনাহ চেনা সহজ হয় এবং তা থেকে বাঁচা সম্ভব হয়। রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” (সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯)
৭. দুনিয়ার আসক্তি থেকে মুক্ত থাকা
👉 হারাম অর্থ, সুদ, ঘুষ, লোভ ও অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকা।
📖 আল্লাহ বলেন:
“দুনিয়ার জীবন কেবল এক খেলা ও আমোদ-প্রমোদ ছাড়া কিছুই নয়।” 📖 (সূরা আন-আম: ৩২)
৮. মৃত্যু ও আখিরাতের কথা চিন্তা করা
👉 মৃত্যু ও কিয়ামতের দিনের কঠিন শাস্তির কথা স্মরণ রাখা। রাসূল ﷺ বলেন:
“তোমরা বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করো, যা সব আনন্দকে ধ্বংস করে দেয়।” (সুনান ইবনে মাজাহ: ৪২৫৮)
৯. আল্লাহর রহমতের আশা করা
👉 কোনো পাপ হয়ে গেলে হতাশ না হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
📖 রাসূল ﷺ বলেন: “যে ব্যক্তি একবার ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।” (সহিহ মুসলিম: ২৭৪৮)
১০. অন্যদেরকে উপদেশ দেওয়া ও দাওয়াত দেওয়া
👉 কবিরা গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও নসিহা করতে হবে।
আল্লাহ বলেন:
“তোমাদের মধ্যে একটি দল অবশ্যই এমন হতে হবে, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে।” (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)
সংক্ষেপে মূল পয়েন্টগুলো
✅ তাওহিদের ওপর অটল থাকা
✅ খাঁটি তওবা করা
✅ ফরজ ইবাদত ঠিকমতো করা
✅ জিকির ও দোয়া করা
✅ ভালো সঙ্গ গ্রহণ করা
✅ ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা
✅ দুনিয়ার লোভ থেকে দূরে থাকা
✅ মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ রাখা
✅ আল্লাহর রহমতের আশা করা
✅ অন্যদের নসিহা করা
শেষ কথা
কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা একজন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বড় গুনাহ থেকে রক্ষা করুন এবং জান্নাতের পথে পরিচালিত করুন। আমিন! 🤲