পবিত্রতা (তাহারাত) ইসলামের মৌলিক একটি শর্ত, বিশেষত নামাজ ও ইবাদতের ক্ষেত্রে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে, যখন কাপড় অপবিত্র হয়ে পড়ে—তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রস্রাব লাগা। তাই তারা জানতে চান – কাপড়ে প্রস্রাব লাগলে কিভাবে পাক হবে? ছোট শিশুদের দেখভাল করা হোক বা অসাবধানতাবশত বয়স্কদের কাপড়ে প্রস্রাব লেগে যাওয়া—এটি একটি সাধারণ বিষয়।
অনেকেই এই অবস্থায় দ্বিধায় পড়ে যান: এখন এই কাপড় কি সম্পূর্ণ ধুতে হবে, না শুধু যেদিকে প্রস্রাব লেগেছে সেদিকটুকুই ধুলে চলবে? আর কতটুকু পরিমাণ প্রস্রাব কাপড়ে লাগলে তা নামাজের অযোগ্য হবে?
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করবো— কাপড়ে প্রস্রাব লাগলে কিভাবে পাক হবে? হানাফি মাযহাব অনুযায়ী এর বিধান কী, এবং এর পেছনে কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা কী বলে। যারা পবিত্রতা সম্পর্কে সচেতন, তাদের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক বিষয়।
🟢 কাপড়ে প্রস্রাব লাগলে কিভাবে পাক হবে?
🔰 পবিত্রতা বা তাহারাত: ইসলামে গুরুত্ব
ইসলামে নামাজসহ অধিকাংশ ইবাদতের পূর্বশর্ত হচ্ছে তাহারাত—অর্থাৎ শারীরিক, কাপড় এবং স্থান—এই তিনটি বিষয়কে পবিত্র রাখা।
📖 আল্লাহ বলেন:
“وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ”
অর্থ: “আর তোমার পোশাক পবিত্র রাখো।” — (সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৪)
🟡 প্রস্রাব: শরীয়তের দৃষ্টিতে কী?
হানাফি মাযহাবসহ অধিকাংশ ইমামগণের মতে, প্রস্রাব সম্পূর্ণরূপে নাপাক (نجس غليظ)।
📚 ইমাম কাসানী (রহ.) বলেন:
“والبول نجس بالإجماع”
অর্থ: “প্রস্রাব সর্বসম্মতভাবে নাপাক।” — (بدائع الصنائع، 1/84)
🔹 কাপড়ে প্রস্রাব লাগলে কী করণীয়?
✅ ১. নাপাকি কতটুকু হলে ধুতে হবে? (হানাফি মতে)
নাপাকি | পরিমাণ | হুকুম |
---|---|---|
কঠিন নাপাকি (مثل البول) | এক দিরহাম বা তার চেয়ে বেশি (প্রায় ৩.৫–৪.৫ সেন্টিমিটার ব্যাস) | নামাজ জায়েয নয় |
কঠিন নাপাকি | এক দিরহামের কম | নামাজ মাকরূহ (অপছন্দনীয়), ধুয়ে ফেলা উত্তম |
📚 হিদায়া-তে আছে:
“فإن كانت نجاسةً غليظةً ووقعت على ثوبه قدر الدرهم فصاعداً لم تجز صلاته”
— (الهداية، 1/49)
✅ ২. কিভাবে পাক করা হবে?
যদি প্রস্রাব কাপড়ে লেগে যায়, তাহলে তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে:
🔹 ক) নির্ধারণ করা — কতটুকু অংশে প্রস্রাব লেগেছে
- যদি তা কম হয়, তবুও উত্তম হবে তা ধুয়ে ফেলা।
🔹 খ) পানিতে ধুয়ে ফেলা
- কাপড়ের সেই অংশে ভালোভাবে পানি ঢেলে ধুতে হবে, যতক্ষণ না নাপাকির রং, গন্ধ ও আকার দূর হয়।
- ইমাম আবু হানিফার মতে, একবার ধুলে নাপাকি চলে গেলে সেটাই যথেষ্ট।
🔹 গ) ধোয়া শেষে নিংড়ে নেওয়া
- কাপড় থেকে পানি নিংড়ে ফেললে তাহারাত সম্পূর্ণ হয়।
📚 الفتاوى الهندية (১/৪৫):
“إذا أصابت النجاسة ثوباً فغسل الموضع حتى زالت النجاسة طهُر”
অর্থ: “যদি কাপড়ে নাপাকি লাগে এবং তা ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলা হয়, তবে তা পবিত্র হয়ে যাবে।”
✅ ৩. প্রস্রাব শুকিয়ে গেলে কী করণীয়?
- শুধু ঘষে ফেলা বা মুছে ফেলা যথেষ্ট নয়।
- ধোয়া আবশ্যক।
- শুকিয়ে গেলেও সে জায়গাটি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
✅ ৪. শিশুর প্রস্রাব লাগলে? (বালেগ না হওয়া শিশু)
🔸 ছেলে শিশুর প্রস্রাব (দুধপানকারী)
- হাদীস দ্বারা প্রমাণিত—ছোট ছেলে শিশুর তরল প্রস্রাবে শুধু পানি ছিটিয়ে দেওয়া (نضح) যথেষ্ট। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“يُغسل من بول الجارية، ويُنضَح من بول الغلام”
অর্থ: “মেয়েশিশুর প্রস্রাব ধুতে হবে, আর ছেলে শিশুর প্রস্রাবে পানি ছিটানো যথেষ্ট।”
— (সহীহ বুখারী: 223, সহীহ মুসলিম: 286)
🔹 তবে হানাফি মাযহাবের মত অনুযায়ী, ছেলে ও মেয়ে—উভয়ের প্রস্রাব ধোয়া লাগবে।
📚 কারণ তারা কিয়াস ও ইজমা অনুসরণ করেন।
🔶 কাপড় ধোয়ার বিকল্প কী আছে?
- যদি এমন কাপড় হয় যা ধোয়া যায় না (যেমন: জুতা, কম্বল), তাহলে পানি ছিটিয়ে, নিংড়ে বা রগড়ে পানি পৌঁছিয়ে দিলে পবিত্র হবে।
❓ কাপড়ে প্রস্রাব লেগে থাকলে নামাজ হবে?
❌ না, যদি এক দিরহামের সমপরিমাণ বা বেশি নাপাকি থাকে।
✅ হবে, যদি খুব অল্প পরিমাণ থাকে—কিন্তু ধুয়ে ফেলা উত্তম।
✅ সংক্ষিপ্তভাবে সারাংশ
প্রশ্ন | উত্তর |
---|---|
কাপড়ে প্রস্রাব লাগলে কি তা নাপাক হয়? | হ্যাঁ |
কতটুকু হলে নামাজ নাজায়েয? | এক দিরহামের সমপরিমাণ বা বেশি |
পবিত্র করার পদ্ধতি কী? | ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নিংড়ে ফেলা |
শিশুর প্রস্রাব লাগলে? | ধুতে হবে (হানাফি মতে) |
ধোয়ার বিকল্প আছে কি? | পানি ছিটানো/ভিজিয়ে দিলে চলবে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে |
🟩 উপসংহার
ইসলামে পবিত্রতা শুধু বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং তা ইবাদতের পূর্বশর্ত। কাপড়ে প্রস্রাব লাগা একটি সাধারণ ঘটনা, কিন্তু এর ইসলামী নির্দেশনা জানা অত্যন্ত জরুরি। হানাফি মাযহাব অনুযায়ী কাপড় পবিত্র করতে হলে, প্রস্রাবের স্থান সঠিকভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে, যেন রং, গন্ধ ও আকার কিছুই না থাকে। এতে নামাজও সহীহ হবে এবং পবিত্রতার আদবও বজায় থাকবে।
কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
❓ ১. কাপড়ে প্রস্রাব লেগে থাকলে কীভাবে বুঝব তা নাপাক হয়েছে?
📌 যদি তুমি নিজে দেখো, অনুভব করো বা জানো যে প্রস্রাব লেগেছে—তাহলে সে জায়গাটি নাপাক গণ্য হবে।
❌ শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে কাপড় নাপাক বলে গণ্য করা যাবে না।
📚 কায়দা:
“اليقين لا يزول بالشك”
অর্থ: “নিশ্চয়তা সন্দেহ দ্বারা বিলীন হয় না।”
✅ সুতরাং, যদি দৃঢ় প্রমাণ না থাকে, তবে কাপড় নাপাক বলার প্রয়োজন নেই। তবে পরিষ্কার করে ফেলা উত্তম।
❓ ২. কাপড় ধোয়ার পরেও যদি দাগ বা গন্ধ থেকে যায়?
📌 হানাফি মাযহাবের মতে:
- যদি প্রস্রাব লাগার স্থান ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা হয় এবং সেখানে নাপাকির প্রকৃত জিনিস (রং, ঘনত্ব, গন্ধ) দূর হয়ে যায়, তবে কাপড় পবিত্র গণ্য হবে—even যদি হালকা দাগ বা গন্ধ থেকে যায়।
📚 দালিল:
“فإن زال أثر النجاسة طَهُر، وإن بقي الأثر بعد الغسل ثلاثاً فهو عفو”
— (الفتاوى الهندية، 1/45)
🔸 তিনবার ধোয়ার পরেও দাগ রয়ে গেলে এবং তা নাপাকি না থাকে—তবে তা মাফযোগ্য।
❓ ৩. মেশিনে ধুলে কাপড় পাক হবে কি?
✅ হ্যাঁ, যদি নিচের তিনটি শর্ত পূরণ হয়:
- পানি কাপড়ের সব অংশে পৌঁছে।
- পানি কাপড় থেকে নিংড়ে বের হয়ে আসে (যেমন স্পিনে বা রিন্সে)।
- পানি প্রবাহিত হয়, এমনভাবে যে নাপাকি দূর হয়।
📌 আধুনিক ওয়াশিং মেশিন সাধারণত এই শর্তগুলো পূরণ করে। তাই মেশিনে ধোয়া কাপড় পবিত্র গণ্য হয় (হানাফি মতে)।
❓ ৪. কাপড় নাপাক অবস্থায় শুকালে বা ইস্ত্রি করলে কী হবে?
📌 শুধু শুকিয়ে যাওয়ায় বা ইস্ত্রি করার ফলে কাপড় পবিত্র হয় না।
🔺 কারণ, নাপাকি (নাজাসাত) পানি দিয়ে ধুয়ে দূর করতে হয়।
❌ ইস্ত্রির তাপে বা রোদে শুকালেও কাপড় তাহারাত পায় না যতক্ষণ না নাপাকি ধুয়ে ফেলা হয়।
📚 রেফারেন্স:
নাপাকি দূর করার জন্য পানি ব্যবহার করা ফরয — (الفتاوى الهندية 1/45)
❓ ৫. গাড়ির সিট বা সোফা নাপাক হলে কীভাবে পাক করব?
✅ নিচের পদ্ধতিতে পবিত্র করতে হবে:
- নাপাক অংশ চিহ্নিত করো।
- সেখানে ভালোমতো পানি ঢালো যতক্ষণ না ভিজে যায়।
- তারপর কাপড় বা টিস্যু দিয়ে চাপ দিয়ে বা স্পঞ্জ দিয়ে পানি টেনে বের করে নাও।
- এভাবে ২–৩ বার করলে তাহারাত সম্পন্ন হয়।
📌 সফা, বালিশ বা গাড়ির সিট ধোয়া না গেলেও—পানি প্রবাহিত করে এবং শুকিয়ে ফেললে তা পবিত্র হয়ে যাবে।
📚 দালিল:
“إذا لم يمكن الغسل، فيكفي النضح مع التجفيف”
— (فتاوى دار العلوم ديوبند، فقه العبادات)