কোরআন এবং হাদিসের আলোকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গোসল ফরজ বা সুন্নত হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। এটি কেবল দেহের পরিচ্ছন্নতার প্রতীক নয়, বরং আত্মিক পবিত্রতারও প্রতিফলন। এই ব্লগপোস্টে আমরা গোসল ফরজ হওয়ার কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
গোসল ফরজ হওয়ার কারণ কয়টি?
গোসল ফরজ হওয়ার ৭ টি কারণ রয়েছে। আমরা এখানে বিস্তারি আলোচনা করছি। প্রতিটি কারণের সাথে প্রয়াজনীয় হাদিস ও ঠিকা সন্নিবেশিত করব। এখানে যদিও বিশেষ কোনো মাযহাব উল্লেখ নেই, তবে বেশিভাগ বিধান হানাফি মাযহারের আলোকে আলোচিত।
প্রথম কারণ : মনি বের হওয়া (জাগ্রত অবস্থায় বা ঘুমের মধ্যে)
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“যদি তোমরা অপবিত্র (জুনুবি) হও, তাহলে পূর্ণরূপে পবিত্র হয়ে নাও।” (সূরা মায়েদা: ৬)
আরও বলেন:
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না বুঝতে পার যে তোমরা কী বলছ। এবং অপবিত্র (জুনুবি) অবস্থায়ও নয়, যতক্ষণ না গোসল করো. তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও, ।” (সূরা নিসা: ৪৩)
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“পানি তখনই ফরজ হয়, যখন মনি বের হয়।” (সহীহ মুসলিম)
তিনি আরও বলেন:
“যখন তুমি পানি প্রবাহিত করো (মনি নির্গত কর), তখন গোসল করো।” (সুনান আবু দাউদ)
দুটি গুরুত্বপূর্ণ নোট
১. নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য এই বিধান একই।
২. যদি মনি কোনো শারীরিক অসুস্থতা বা ঠাণ্ডার কারণে কোনো যৌন চেতনা ছাড়াই বের হয়, তাহলে গোসল ফরজ নয়। এটি অধিকাংশ আলেমের মত।
দ্বিতীয় কারণ : যৌন মিলন (মনি বের না হলেও)
যখন পুরুষের লিঙ্গ নারীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে, তখন উভয়ের উপর গোসল ফরজ হয়, মনি বের হোক বা না হোক।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“যখন সে তার স্ত্রীর চার অঙ্গের মধ্যে অবস্থান করে এবং মিলন সম্পন্ন করে, তখন গোসল ফরজ হয়ে যায়, যদিও মনি নির্গত না হয়।” (সহীহ মুসলিম)
আরও বলেন:
“আমি এবং এই নারী (আয়েশা রা.) এমনটি করি এবং তারপর গোসল করি।”
বিশষ পয়েন্ট
নারী-পুরুষের সংস্পর্শের পর গোসলের বিধান
যদি একজন পুরুষ তার লিঙ্গ নারীর লজ্জাস্থান ছোঁয় কিন্তু প্রবেশ না করে, তবে উভয়ের উপর গোসল ফরজ নয়। ইব্রাহিম নাখাঈ (রহ.)-এর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রশ্ন করা হয়েছিল:
যদি কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে সহবাস ছাড়া উত্তেজিত করে এবং বীর্যপাত ঘটে, তবে কী করতে হবে? তিনি বলেন: “পুরুষটি গোসল করবে, কিন্তু স্ত্রীকে গোসল করতে হবে না; বরং যে অংশে বীর্য লেগেছে তা ধুয়ে ফেলবে।”
আংশিক প্রবেশ এবং বীর্যপাত
যদি একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে আংশিক প্রবেশ করে এবং তার বীর্য স্ত্রীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে কিন্তু স্ত্রী বীর্যপাত না করে, তবে স্ত্রীর উপর গোসল ফরজ নয়। ইমাম নববী (রহ.) বলেন:
“যদি কোনো নারী তার যৌনাঙ্গে বা পশ্চাদ্দেশে বীর্য প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং পরে তা বের হয়ে আসে, তবে তার জন্য গোসল ফরজ নয়। এই মতটিই অধিকাংশ আলেমের মতে সঠিক।”
সহবাসের পর বীর্য বের হওয়ার পরবর্তী বিধান:
যদি একজন নারী সহবাসের পর গোসল করেন এবং পরে তার যৌনাঙ্গ থেকে পুরুষের বীর্য বের হয়, তবে তার জন্য পুনরায় গোসল ফরজ নয়। তবে কি তাকে ওজু করতে হবে? অধিকাংশ আলেমদের মতে,
“যেহেতু এটি একাধিক রাস্তা থেকে বের হয়েছে (যদিও এটি পবিত্র), তাই ওজু করতে হবে।”
ইবন হাযম (রহ.) বলেন: “ওজু কেবল তার নিজের অবস্থার জন্য প্রযোজ্য, অন্য কারো জন্য নয়। পুরুষের বীর্য নারীর যৌনাঙ্গ থেকে বের হওয়া তার নিজস্ব কোনো অপরাধ বা অপবিত্রতা নয়।”
অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বা স্বামী:
যদি কোনো পুরুষ তার অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বা কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কোনো নারীকে সহবাস করে, তবে উভয়ের জন্য গোসল ফরজ।
ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন: “আয়েশা (রা.) কি নবী ﷺ-এর সাথে সহবাসের পর গোসল করতেন না?”
পানি না থাকলেও স্ত্রীর স্বামীর আহ্বানে সাড়া দেওয়া:
যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে সহবাসের জন্য ডাকেন, তবে স্ত্রী পানি না থাকার অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রহ.) বলেন: “স্ত্রী স্বামীর আহ্বানে বাধা দিতে পারে না। বরং স্বামী সহবাস করবেন, এবং স্ত্রী গোসল করতে না পারলে তায়াম্মুম করে নামাজ আদায় করবে।”
তৃতীয় কারণ : হায়েজ এবং চতুর্থ কারণ: নিফাস
হায়েজ (ঋতুস্রাব) এবং নিফাস (প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাব) উভয় অবস্থার শেষে গোসল ফরজ হয়।
রাসুলুল্লাহ ﷺ ফাতিমা বিনতে আবু হুবাইশকে বলেন:
“যখন ঋতুস্রাব শুরু হয়, তখন নামাজ ছেড়ে দাও। আর যখন তা শেষ হয়, তখন গোসল করো এবং নামাজ আদায় করো।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
নিফাস হায়েজের মতোই মহিলাদের গোসল ফরজ হওয়ার কারণ, এক্ষেত্রে উভয়ের বিধান এক।
পঞ্চম কারণ: কাফিরের ইসলাম গ্রহণ করার পর গোসলের বিধান
কোনো কাফির ইসলাম গ্রহণ করলে তার উপর গোসল ফরজ হওয়া নিয়ে আলেমদের মধ্যে তিনটি মতামত রয়েছে:
প্রথম মত
কাফির মুসলমান হলে সর্বাবস্থায় গোসল ফরজ। এই মতটি মালিক, আহমদ, আবু সাওর, ইবন হাযম এবং ইবন মুনজির ও খাত্তাবির পছন্দের মত।
তারা নিম্নলিখিত দলিল উপস্থাপন করেছেন:
১. কাইস ইবন আসিম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
“যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন নবী করিম ﷺ তাকে পানি ও সিদর দিয়ে গোসল করার আদেশ দেন।” (সহীহ হাদিস, আদেশ মূলত ফরজের জন্য প্রযোজ্য।)
২. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, থুমামা ইবন উসাল (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন:
“তাকে অমুক গোত্রের বাগানে নিয়ে যাও এবং তাকে গোসল করার আদেশ দাও।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
দ্বিতীয় মত
কাফিরের জন্য ইসলাম গ্রহণের পর গোসল করা মুস্তাহাব (সুন্নত)। তবে যদি সে ইসলাম গ্রহণের আগে অপবিত্র (জুনুব) অবস্থায় থাকে, তাহলে তার উপর গোসল ফরজ হবে। এটি শাফেয়ি এবং হানাফি মাজহাবের একটি মত।
তৃতীয় মত
কাফিরের উপর ইসলাম গ্রহণের পর কোনো অবস্থাতেই গোসল ফরজ নয়। এটি আবু হানিফার মত।
বিষয়ে পর্যালোচনা
এ বিষয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, কাফিরের উপর গোসলের বাধ্যবাধকতা আরও বেশি সুস্পষ্ট। কারণ কিছু ব্যক্তির প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এটি প্রচারিত হয়েছে। এমন ধারণা যে অন্যদের প্রতি এই নির্দেশ ছিল না, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এটি কেবল নির্দেশ পাওয়া না যাওয়ার বিষয়, যা নির্দেশ না থাকার প্রমাণ নয়।
অতএব, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, কাফির—সে মূল কাফির হোক বা মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগকারী)—ইসলাম গ্রহণ করলে তার জন্য গোসল করা আবশ্যক।
এটি সাহাবাদের মধ্যে পরিচিত একটি বিষয় ছিল। যেমন, আবু হুরাইরার মায়ের ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে:
“তিনি (আবু হুরাইরার মা) গোসল করেন এবং বর্ম পরিধান করেন…” (সহীহ মুসলিম)
এছাড়াও উসাইদ ইবন হুযাইরের ইসলাম গ্রহণের কাহিনি এ বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করে।
আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞানী।
গোসল ফরজ হওয়ার ষষ্ঠ কারণ: জুমার নামাজের গোসল
জুমার দিন গোসল করা ফরজ এবং এর ত্যাগ করা পাপ। অধিকাংশ আলেমদের মতে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
এ মতটি আবু হুরাইরা (রা.), আম্মার ইবন ইয়াসির (রা.), আবু সাইদ খুদরি (রা.), হাসান বসরি এবং মালিক ও আহমদের একটি বর্ণনার পাশাপাশি ইবন হাযমের মত।
প্রমাণসমূহ
১. আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জুমার দিন গোসল করা ফরজ।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
২. ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“তোমাদের মধ্যে যারা জুমার নামাজে উপস্থিত হবে, তারা যেন গোসল করে আসে।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
৩. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সাত দিনে অন্তত একবার গোসল করা কর্তব্য, যাতে সে তার মাথা ও দেহ ধুয়ে পরিষ্কার করে।” (সহীহ মুসলিম)
গোসল ফরজ হওয়ার সপ্তম কারণ: মৃত্যু
মৃত্যু গোসল ফরজ হওয়ার একটি বিশেষ কারণ। তবে এটি মৃত ব্যক্তির জন্য নয়, বরং জীবিত মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য, যারা মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাবে।