আসমানী কিতাব বলতে মূলত সেই পবিত্র গ্রন্থগুলোকে বোঝানো হয়, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বিভিন্ন যুগে তাঁর নবীদের মাধ্যমে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য নাজিল করেছেন। এই কিতাবগুলো আল্লাহর কালাম, যা মানুষের জন্য জীবনযাপনের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।
আল্লাহ পৃথিবীতে বিভিন্ন যুগে চারটি আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন। এই কিতাবের নাম জানা এবং তার বাণী এবং সঠিক পথে চলা আমাদের কর্তব্য। কিতাবগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতা, আদর্শ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
চারটি আসমানী কিতাবের নাম
১. তাওরাত (Tawrat)
তাওরাত হযরত মুসা (আ.)-এর উপর নাজিল করা হয়েছিল। এটি ছিল ইহুদিদের জন্য প্রধান ধর্মগ্রন্থ, যা আল্লাহর বিধান এবং নৈতিক আদর্শসমূহ সংবলিত। তাওরাতে মানবজাতির জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ ۚ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّون وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُو مِن كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ ۚ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
অনুবাদ: “নিশ্চয়ই আমি তাওরাত নাজিল করেছি, তাতে হেদায়েত ও আলো ছিল..। (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৪৪)
২. যবূর (Zabur)
যবূর হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছিল। এটি মূলত আল্লাহর প্রশংসা, আরাধনা এবং বন্দনা নিয়ে রচিত একটি পবিত্র গ্রন্থ। যবূর ছিল ইসরাইলীদের ধর্মীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাদের জন্য নৈতিক আদর্শের প্রধান উৎস।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَىٰ نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِن بَعْدِهِ ۚ وَأَوْحَيْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَعِيسَىٰ وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهَارُونَ وَسُلَيْمَانَ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورً
অনুবাদ:“আর আমি দাউদকে দিয়েছিলাম যবূর।”
৩. ইঞ্জিল (Injil)
ইঞ্জিল হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছিল। এটি খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এবং আল্লাহর প্রেরিত বিভিন্ন নির্দেশনা এবং শিক্ষা সংবলিত। ইঞ্জিলে মানবজীবনের নৈতিক আদর্শ এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَقَفَّيْنَا عَلَىٰ آثَارِهِم بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ ۖ وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ
অনুবাদ: “আর আমি তার পরে ঈসা ইবনে মরিয়মকে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাঠিয়েছিলাম সত্যতার সাথে এবং তাকে দিয়েছিলাম ইঞ্জিল।”
৪. কুরআন (Quran)
কুরআন হচ্ছে শেষ এবং চূড়ান্ত আসমানী কিতাব, যা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাজিল হয়েছে। কুরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত বিধান ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান যা পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী কিতাবের সঠিক ও পরিপূর্ণ রূপ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ ۖ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ ۚ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ۚ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
অনুবাদ: “আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি সত্যতার সাথে, পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সত্যায়নকারী এবং তাদের জন্য রক্ষক হিসেবে।”
আসমানী কিতাবের গুরুত্ব
আসমানী কিতাবগুলো মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এগুলো মানুষের জন্য হেদায়েতের রাস্তা, যা তাকে সঠিক পথ দেখায় এবং জীবনযাত্রার নৈতিক মানদণ্ড প্রদান করে।
কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব
কুরআন আল্লাহর শেষ বাণী এবং চূড়ান্ত আসমানী কিতাব, যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের শিক্ষা সংবলিত। এটি সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য এবং এতে মানবজীবনের সকল দিকের দিকনির্দেশনা রয়েছে।
১০৪ খানা আসমানী কিতাব: আসল তথ্য
কিছু সূত্রে বলা হয় যে, আল্লাহ ১০৪ খানা আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন। তবে ইসলামের মূলধারায় মেনে নেয়া হয় যে, প্রধান চারটি কিতাব এবং কিছু সহীফা (ছোট গ্রন্থ) আল্লাহ নাজিল করেছেন।
আসমানী কিতাবগুলোর পরিবর্তন ও বিকৃতি
বিভিন্ন সময়ে, তাওরাত, যবূর ও ইঞ্জিলের কিছু অংশ বিকৃত করা হয়েছে। তবে, কুরআন আল্লাহর বিশেষ হেফাজতে আছে এবং এটি কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই আজ পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় আছে।
আসমানী কিতাবের শিক্ষা ও হেদায়েত
আসমানী কিতাবগুলো মানুষকে সঠিক পথে চলার নির্দেশ দেয় এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ করার তাগিদ দেয়।
বর্তমান যুগে আসমানী কিতাবগুলোর প্রাসঙ্গিকতা
আজকের যুগেও আসমানী কিতাবগুলোর শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশেষত, কুরআন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যা মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক।
কিছু প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১: চারটি আসমানী কিতাব কি?
- চারটি আসমানী কিতাব হলো তাওরাত, যবূর, ইঞ্জিল এবং কুরআন।
প্রশ্ন ২: কুরআন কি অন্যান্য আসমানী কিতাবের মতো?
- কুরআন অন্যান্য আসমানী কিতাবের তুলনায় চূড়ান্ত এবং সর্বোত্তম। এটি সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য এবং এর কোন বিকৃতি ঘটেনি।
প্রশ্ন ৩: তাওরাত কাদের উপর নাজিল হয়েছে?
- তাওরাত হযরত মুসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে।
প্রশ্ন ৪: ১০৪ খানা আসমানী কিতাবের ব্যাপারে কী বলা হয়েছে?
- কিছু সূত্রে বলা হয় ১০৪ খানা আসমানী কিতাব নাজিল হয়েছে, তবে ইসলামের মূলধারায় চারটি প্রধান কিতাব ও কিছু সহীফা স্বীকৃত।
প্রশ্ন ৫: আসমানী কিতাবের বিকৃতি কি ঘটেছে?
- হ্যাঁ, তাওরাত, যবূর ও ইঞ্জিলের কিছু অংশ বিকৃত হয়েছে। তবে, কুরআন আল্লাহর বিশেষ হেফাজতে আছে।
প্রশ্ন ৬: আসমানী কিতাবগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য কি?
- আসমানী কিতাবগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আল্লাহর পথে চলার নির্দেশনা প্রদান করা।
প্রশ্ন ৭: কেন কুরআন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য?
- কুরআনের শিক্ষা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য কারণ এটি সর্বশেষ আসমানী কিতাব এবং এতে মানবজীবনের সকল দিকের দিকনির্দেশনা রয়েছে।
প্রশ্ন ৮: আসমানী কিতাবগুলো এখনকার যুগে কীভাবে প্রাসঙ্গিক?
- আসমানী কিতাবগুলো এখনকার যুগেও নৈতিক ও আদর্শ জীবনযাপন করার জন্য প্রাসঙ্গিক।
প্রশ্ন ৯: কুরআনের হেফাজতের দায়িত্ব কে নিয়েছেন?
- কুরআনের হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন এবং এটি কোন পরিবর্তন ছাড়াই অবিকৃত রয়েছে।
প্রশ্ন ১০: কেন কুরআনকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বলা হয়?
- কুরআনে মানবজীবনের প্রতিটি দিকের পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা রয়েছে, যা একজন মানুষের সার্বিক জীবনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে।