ছোট ও সহজ দরুদ শরীফ পাঠ করা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ এবং ইসলামের অন্যতম বড় সুন্নাত। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কুরআনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরুদ পাঠের আদেশ দিয়েছেন:
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ কর।” (সূরা আল-আহযাব: ৫৬)
যারা বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করে। তবে অনেক সময় দেখা যায়, ব্যস্ততার কারণে কিংবা সহজভাবে দরুদ মুখস্থ না থাকায় অনেকে বেশি দরুদ পাঠ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ছোট ও সহজ দরুদগুলো জানা থাকলে যে কেউ খুব সহজেই তা পড়তে পারেন এবং এই বরকতময় আমলের মধ্যে থাকেন।
এই ব্লগপোস্টে আমরা সংক্ষিপ্ত ও সহজ কিছু দরুদ শরীফ নিয়ে আলোচনা করব, যা সহজেই মুখস্থ করা যায় এবং নিয়মিত আমল করা যায়।
১০ টি ছোট ও সহজ দরুদ শরীফ
আমরা যখন দরুদ শরীফ পাঠ করি, তখন আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য রহমতের দরজা খুলে দেন, আমাদের গুনাহ মাফ করে দেন এবং কিয়ামতের দিন নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুপারিশ লাভের সুযোগ করে দেন। এখানে ১০টি ছোট ও সহজ দরুদ দেওয়া হলো, যা আমরা প্রতিদিন বেশি বেশি পাঠ করতে পারি।
১. সর্বাধিক সংক্ষিপ্ত দরুদ
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ
🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ, মুহাম্মাদের ওপর দরুদ পাঠ করুন।
🔹 ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন।” (মুসলিম: ৪০৮)
২. সংক্ষিপ্ততম সালাত ও সালাম
আরবি:
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
🔹 উচ্চারণ: সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
🔹 অর্থ: আল্লাহ তাঁর ওপর শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।
🔹 ফজিলত: এটি নবীজির প্রতি দরুদ ও সালামের সংক্ষিপ্ততম রূপ, যা হাদিসে প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছে। এটি পাঠ করলে সুন্নত আদায় হয় এবং আল্লাহর রহমত লাভ হয়।
৩. দরুদে ইবরাহিমের সংক্ষিপ্ত অংশ
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ
🔹 বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর দরুদ বর্ষণ করুন।
🔹 ফজিলত: এটি দরুদে ইবরাহিমের সংক্ষিপ্ত রূপ। দরুদে ইবরাহিম হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম দরুদ, যা আমরা নামাজে পড়ি।
৪. সহজ দরুদ শরীফ
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى النَّبِيِّ
🔹 বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা আন্নাবিয়্যি।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ! নবীর ওপর দরুদ বর্ষণ করুন।
🔹 ফজিলত: সহজ হওয়ার কারণে এটি বারবার পাঠ করা সম্ভব, আর প্রত্যেক দরুদ পাঠের বিনিময়ে আল্লাহ ১০টি রহমত নাজিল করেন।
৫. দরুদে সালাম
📖 আরবি:
السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ
🔹 বাংলা উচ্চারণ: আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি সালাম বর্ষিত হোক।
🔹 ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কবর থেকে আমার প্রতি সালাম পাঠায়, আমি তার সালামের উত্তর দেই।” (আবু দাউদ: ২০৪১)
৬. দরুদে বরকত
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ
🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ, মুহাম্মাদের ওপর বরকত দান করুন।
🔹 ফজিলত: এটি নবীজির জন্য বরকতের দোয়া, যা পাঠ করলে আমল ও জীবনে বরকত আসে।
৭. দরুদে মাগফিরাত
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِنَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ
🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফির লিনাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের নবী মুহাম্মাদকে ক্ষমা করুন।
🔹 ফজিলত: এটি নবীজির জন্য মাগফিরাত চাওয়ার দোয়া, যা পাঠ করলে আল্লাহ আমাদের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দরজা খুলে দেন।
৮. দরুদে রহমত
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ ارْحَمْ مُحَمَّدًا
🔹 বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মারহাম মুহাম্মাদা।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ, মুহাম্মাদের ওপর রহম করুন।
🔹 ফজিলত: দরুদ পাঠ করা মানেই নবীজির প্রতি আল্লাহর রহমত কামনা করা, যা আমাদের নিজেদের জন্যও রহমতের কারণ হয়।
৯. দরুদে নূর
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ نُورِ الْهُدَى
🔹 বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদিন নূরিল হুদা।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের নেতা মুহাম্মাদ, যিনি হেদায়াতের আলো, তাঁর ওপর দরুদ বর্ষণ করুন।
🔹 ফজিলত: এটি নবীজির হেদায়াত ও আলো প্রদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একটি দরুদ।
১০. দরুদে জমজম
📖 আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ عَدَدَ مَا فِي عِلْمِ اللَّهِ
🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ, আদাদা মা ফি ইলমিল্লাহ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের নবী মুহাম্মাদের ওপর এতবার দরুদ ও সালাম বর্ষণ করুন, যতবার আপনার জ্ঞানে আছে।
🔹 ফজিলত: এই দরুদ পাঠ করলে অসংখ্য দরুদ পাঠের সওয়াব পাওয়া যায়, কারণ এতে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সমপরিমাণ দরুদ চাওয়া হয়েছে।
ছোট ও সহজ দরুদ শরীফ সম্পর্কে ৬টি প্রশ্ন ও উত্তর
১. দরুদ শরীফ পাঠের গুরুত্ব কী?
উত্তর: দরুদ শরীফ পাঠ করা একটি মহান ইবাদত। আল্লাহ তাআলা নিজে নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি দরুদ পাঠ করেন এবং আমাদেরও তা পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে দশটি রহমত দান করবেন। (মুসলিম: ৪০৮)
২. সবচেয়ে ছোট দরুদ কোনটি?
উত্তর: সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দরুদ হলো:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ
🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের ওপর দরুদ বর্ষণ করুন।
৩. দরুদ শরীফ পাঠ করলে কী কী ফজিলত পাওয়া যায়?
উত্তর: আল্লাহ তাআলা ১০ গুণ রহমত দান করেন।
- ১০টি গুনাহ মাফ করেন।
- ১০টি নেকি লেখা হয়।
- ফেরেশতারা তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করেন।
- কিয়ামতের দিন নবীজির সুপারিশ লাভ করা যায়। (আহমাদ: ১০০৬৪)
৪. দরুদ শরীফ কখন বেশি পাঠ করা উচিত?
🔹 উত্তর:
- নামাজের শেষ বৈঠকে (দরুদে ইবরাহিম)
- জুমার দিনে ও রাতে
- নবীজির নাম শুনলে
- দুঃখ-কষ্ট বা বিপদের সময়
- দোয়া করার আগে ও পরে
- কোনো কাজ শুরু করার আগে বরকতের জন্য
৫. দরুদ শরীফ পাঠের মাধ্যমে কি দোয়া কবুল হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, হাদিসে এসেছে যে, “যখন তোমরা আল্লাহর কাছে কিছু চাইবে, তখন নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ করো। কেননা, দরুদ কবুল হয় এবং দরুদসহ করা দোয়াও কবুল হয়।” (তিরমিজি: ৪৮৬)
৬. দরুদ শরীফ পাঠের মাধ্যমে কি গুনাহ মাফ হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে আমার প্রতি দরুদ পাঠ করবে, তার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (নাসাঈ: ১২৯৮)
সারসংক্ষেপ
দরুদ শরীফ পাঠ করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে অপার কল্যাণ বয়ে আনে। কুরআন ও হাদিসে দরুদ পাঠের ব্যাপারে সুস্পষ্ট উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এটি নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ এবং আমাদের গুনাহ মোচনের মাধ্যম।
এই ব্লগপোস্টে ১০টি ছোট ও সহজ দরুদ উল্লেখ করা হয়েছে, যা সহজেই মুখস্থ করে প্রতিদিন আমল করা যায়। দরুদ পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা ১০টি রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন এবং দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বিশেষত, নামাজ, জুমার দিন, দোয়ার আগে-পরে এবং নবীজির নাম শুনলে দরুদ পাঠ করার প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আমাদের উচিত প্রতিদিন বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ করা, যাতে আমাদের জীবনে বরকত আসে এবং কিয়ামতের দিন নবীজির সুপারিশ লাভ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই বরকতময় আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন। 🤲