আমাদের জীবনে চুরি, হারানো বা অজান্তেই কোনো প্রিয় বস্তু নিখোঁজ হয়ে যাওয়া—একটি দুঃখজনক কিন্তু প্রচলিত বাস্তবতা। কখনো মোবাইল, কখনো টাকা, আবার কখনো গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বা গাড়ি—এমন অনেক কিছুই হঠাৎ করে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অনেকেই এসব অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়ে, কারো বিরুদ্ধে সন্দেহে পড়ে যায়, আবার কেউ কেউ তদবির বা ঝাড়ফুঁক নামের সন্দেহজনক পথে আশ্রয় নেয়। কিন্তু – চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার তদবির রয়েছে।
কিন্তু আমরা কি জানি, ইসলামে এসব পরিস্থিতিতে করণীয় কী? হারানো বা চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার জন্য কুরআন ও হাদীসে এমন কিছু আমল, দোআ ও তাওয়াক্কুলমূলক দিকনির্দেশনা রয়েছে, যেগুলো পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর উপর নির্ভর করে এবং জায়েয পন্থায় সমাধান খুঁজে দেয়।
এই ব্লগপোস্টে আমরা জানব—
- চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার জন্য পরীক্ষিত কিছু ইসলামী তদবির ও দোআ।
- রাসূল (সা.) বা সাহাবাদের যুগে এ ধরনের সমস্যা সমাধানে কিভাবে আল্লাহর সাহায্য নেওয়া হতো।
- কিছু বাস্তব পরামর্শ যা আপনার জিনিস ফিরে পেতে সহায়ক হতে পারে ইনশাআল্লাহ।
পোস্টটি শুধুমাত্র তদবির নয়, বরং ঈমানি দৃষ্টিকোণ থেকে এক ধরনের তাওয়াক্কুল ও আত্মিক প্রশান্তির পথও দেখাবে। চলুন জেনে নেই আল্লাহর উপর নির্ভর করে হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার উপায়গুলো।
🔎 চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার পরীক্ষিত ইসলামী তদবির ও আমল
আল্লাহ তাআলা আমাদের পরীক্ষার জন্য নানা সময় সম্পদ হরণ করে নেন। কারও মাধ্যমে চুরি, আবার কখনো নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলা—উভয় অবস্থাতেই মুসলমানের কাজ হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া ও জায়েয উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। নিচে কিছু দোআ ও আমল দেওয়া হলো, যেগুলো বহু মুসলিমের জীবনে উপকারী প্রমাণিত হয়েছে:
🕋 ১. ইননালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন পাঠ করা
চুরি বা ক্ষতির সম্মুখীন হলে প্রথম করণীয় হচ্ছে সবর ও আল্লাহর স্মরণ।
📖 “الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ”
“যারা মুসিবতের সময় বলে – নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য, এবং নিশ্চয় আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।” 📘 সূরা বাকারা: ১৫৬
🔹 এই আয়াত শুধু মৃত্যুর সময় নয়, যেকোনো ক্ষতি বা মুসিবতের সময় পড়া সুন্নত এবং এটি বরকতের ও উপশমের চাবিকাঠি।
🌙 ২. সুরা ইয়াসিন পাঠের তদবির
তদবির পদ্ধতি:
- চুরি হওয়ার পর একান্ত নির্জনে, ওযু করে, হৃদয় স্থির রেখে একবার সুরা ইয়াসিন পূর্ণ পড়ে আল্লাহর কাছে জিনিস ফিরে পাওয়ার জন্য দোআ করুন।
- এভাবে ৩ দিন বা ৭ দিন পাঠ করুন।
🔸 অনেকে এই আমলের মাধ্যমে হারানো জিনিস ফিরে পেয়েছেন—তবে শর্ত হলো, বিশ্বাস ও আন্তরিকতা।
🌟 ৩. ইসমে আযম দ্বারা দোআ
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“আল্লাহর এমন একটি নাম আছে, যার দ্বারা দোআ করলে কবুল হয়, আর কিছু চাইলে তা দেওয়া হয়।”
📘 (তিরমিযী: ৩৪৭৫)
📖 একটি বিখ্যাত দোআ — যেটিকে অনেক আলেম ইসমে আযম মনে করেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدُ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، الْمَنَّانُ، بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ، يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ
🔹 এই দোআ পাঠ করে হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার জন্য অন্তর ভেঙে দোআ করুন। আল্লাহ চাইলে ব্যবস্থা করে দেবেন।
📿 ৪. ইয়া জামে‘– اسم الله الجَامِعُ নামের জিকির
الجامعُ অর্থ: যিনি বিচ্ছিন্ন জিনিসকে একত্র করেন।
🔸 হারানো বা ছিনতাই হওয়া জিনিস ফিরে পেতে প্রতিদিন ১০০ বার পড়ে বলুন:
“يَا جَامِعُ، اجْمَعْ بَيْنِي وَبَيْنَ ضَالَّتِي”
“হে জামে‘ (সবকিছুর সংযোগকারী), আমাকে আমার হারানো জিনিসের সাথে একত্র করুন।”
➤ এই জিকির নিয়মিত করলে অনেক সময় অদ্ভুতভাবে হারানো বস্তু ফিরে আসে।
🧭 ৫. দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে দোআ করা
যেকোনো প্রয়োজনের সময় সালাতুল হাজত অত্যন্ত কার্যকরী। হারানো বা চুরি হওয়া জিনিসের জন্য এটি খুবই উপকারী।
পদ্ধতি
- ওযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ুন।
- এরপর হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে দোআ করুন। রাসুল ( সা.) এর উপর দুরুদ পড়ুন।
- আল্লাহর কাছে আপনার অসহায়ত্ব ও চাহিদা খুলে বলুন।
🧠 কিছু বাস্তব পরামর্শ
✔️ চুরির বিষয়ে দ্রুত স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করুন
✔️ হারানো স্থানে পুনরায় খোঁজ করুন—অনেক সময় আমরা নিজের ভুলে চুরি ভাবি
✔️ সন্দেহ বা গীবত না করে আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন
✔️ নিজেকে গুনাহ থেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করুন—কারণ অনেক সময় গুনাহের কারণে আল্লাহ আমাদের কোনো নেয়ামত কেড়ে নেন।
📖 হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়ার জন্য হাদিসভিত্তিক দোআ
📜 আরবি দোআ:
اللَّهُمَّ رَادَّ الضَّالَّةِ، هَادِيَ الضَّلَالَةِ، ارْدُدْ عَلَيَّ ضَالَّتِي بِقُدْرَتِكَ وَسُلْطَانِكَ، فَإِنَّهَا مِنْ عَطَائِكَ وَفَضْلِكَ
📢 বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা রাদ্দাদ্দ্ব-দ্বাল্লাহ, হাদিয়াদ্দ্ব-দ্বলালাহ, উরদুদ ‘আলাইয়া দ্বাল্লাতী বি কুদরাতিকা ওয়া সুলত্বানিকা, ফাইন্নাহা মিন ‘আতাইকা ওয়া ফাদলিকা।
📚 বাংলা অনুবাদ: “হে হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেওয়ার মালিক, হে পথহারা লোকদের হিদায়াতদাতা, আপনার কুদরত ও ক্ষমতা দ্বারা আমার হারানো জিনিসটি ফিরিয়ে দিন। নিশ্চয়ই এটি আপনার দান ও অনুগ্রহ।”
📌 উৎস: এই দোআটি সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) ও তাবেয়ীগণ থেকে বর্ণিত। এটি হাদীস গ্রন্থে স্পষ্টভাবে সহীহ সূত্রে না এলেও বহু ইসলামী গ্রন্থ, আমলবহুল কিতাব এবং মাকতাবার দোআ বইগুলোতে এটি সুপরিচিত ও ব্যবহৃত। বিশেষ করে:
- “Hisnul Muslim” (Fortress of the Muslim) – দোআ ও যিকির সংকলনে এটি অন্তর্ভুক্ত
- ইমাম ইবনু আবিদ দুনিয়া এবং অন্যান্য সালাফের কিতাবে এই দোআর ব্যবহার পাওয়া যায়
☑️ কীভাবে ব্যবহার করবেন:
- হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই দোআ একাগ্রতায় পড়ে আল্লাহর কাছে চাওয়া
- ৩, ৭ বা ১০ বার পড়া ভালো
- পাঠ শেষে “ইয়া জামে‘ু, ইজ্জাম বাইনী ওয়া বাইন দাল্লাতী” — এই আল্লাহর নামের জিকিরও করতে পারেন
❗ টিপস:
- এই দোআতে কোনো শিরক নেই, কেবল আল্লাহর কাছে নির্ভরতা প্রকাশ
- তাবিজ বা অন্য কাউকে ভরসা না করে এটি পড়ে আত্মবিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল বজায় রাখুন
❌ ভুলপথ ও শিরকপূর্ণ তদবির থেকে সাবধানতা
চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার আশায় অনেকেই দুঃখ-কষ্টে পড়ে যান এবং তখন ভরসার জন্য আশ্রয় নেন এমন কিছু পন্থার, যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, শিরকপূর্ণ বা অন্তত সন্দেহপূর্ণ। এইসব পন্থা সাময়িক মানসিক সান্ত্বনা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ঈমান ও আত্মাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
নিচে কিছু প্রচলিত ভুলপথ তুলে ধরা হলো, যেগুলো থেকে মুসলিমদের সাবধান থাকা ফরজ:
❌ ১. জ্যোতিষি / গণক / তাবিজওয়ালার শরণাপন্ন হওয়া
অনেকে চুরি বা হারানো জিনিসের তথ্য জানতে গণক বা জ্যোতিষীর কাছে যান। কেউ তাবিজ নেওয়ার পরামর্শ দেয়—যা কেবল অনুমান, প্রতারণা বা জিনদের সাহায্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি।
📖 হাদীস:
“যে ব্যক্তি গণকের কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল, তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হয় না।”
📘 (মুসলিম: ২২৩০)
“যে ব্যক্তি গণকের কাছে গিয়ে তার কথা বিশ্বাস করল, সে মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ ধর্মকে অস্বীকার করল।” 📘 (আবু দাউদ: ৩৯০৪)
🛑 অর্থাৎ, এসব পন্থা কেবল অবৈধ নয়, বরং ঈমানের জন্য হুমকিস্বরূপ।
❌ ২. “চুরি ধরা তদবির” নামে অদ্ভুত কৌশল
যেমন:
- থালায় পানি নিয়ে ঘোরানো
- তেলের মধ্যে নাম লেখা কাগজ ভাসানো
- কোরআনের আয়াত উল্টোভাবে পড়া
- আগুনে নাম ফেলে চোরের নাম নির্ধারণ করা
এসব বিদআত, শিরক, জিনের সাহায্য বা মিথ্যা কল্পনার ফাঁদ। এগুলো কোরআন-হাদীস থেকে একেবারেই মুক্ত।
❌ ৩. জিন বা পীর-মুরশিদের মাধ্যম ব্যবহার করা
“আমার পীর বলে দিয়েছে কে চুরি করেছে” — এমন কথা সমাজে অনেক শোনা যায়। অথচ জিন, পীর বা অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে অদৃশ্য বিষয় জানার দাবি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেবল আল্লাহই আল গায়ব (অদৃশ্যের জ্ঞানী)।
📖 “গায়বের চাবি একমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে…”
📘 সূরা আন’আম: ৫৯
❌ ৪. সূরা বা আয়াত বিকৃত করে পড়া / সংখ্যা নির্দিষ্ট করে নিজে বানানো পদ্ধতি চালু করা
অনেকে বলেন, “সুরা ইয়াসিন ৪১ বার পড়ো, তারপর দরজায় তিনবার থু দাও”— এসব নবআবিষ্কৃত তদবির। শরিয়তে নির্দিষ্ট সংখ্যা বা কাজের বিধান না থাকলে তা বিদআত।
📌 ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি:
ইসলামে গায়ব জানার অনুমতি কোনো মানুষ বা জিনকে দেওয়া হয়নি। হারানো জিনিস ফিরে পেতে দোআ, যিকির ও আমল করতে বলা হয়েছে; কিন্তু অলৌকিক দাবি, শিরকি তদবির, বা জাদুর আশ্রয় নেওয়া সরাসরি কুফরি পথে ধাবিত করে।
✅ মুসলিমের করণীয়:
- নিজেকে আল্লাহর কাছে নত করুন
- তাওবা করুন, আল্লাহর কাছে দোআ করুন
- শরিয়তসম্মত দোআ ও আমল করুন
- হারাম তদবির থেকে দূরে থাকুন
- ধৈর্য ও আশার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যান
🤲 উপসংহার
চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পাওয়া মানুষের হাতে না, বরং আল্লাহর ইচ্ছা ও রহমতের উপর নির্ভর করে। ইসলাম আমাদের শিখায়—নিরাশ না হয়ে, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে বৈধ উপায়ে তদবির ও দোআ করতে। আল্লাহ চাইলে হারানো বস্তু এমনভাবে ফেরত আসবে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।