তাবিজ — একটি বহুল প্রচলিত শব্দ, যা মুসলিম সমাজে বহু শতাব্দী ধরে নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি সাধারণত এমন একটি বস্তু, যার মধ্যে কুরআনের আয়াত, দোয়া বা কোনো রহস্যময় লেখা থাকে, এবং মানুষ এটি ঝুলিয়ে রাখে বা সঙ্গে বহন করে — রোগমুক্তি, নিরাপত্তা, ভালোবাসা, বা নজর লাগা থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে। আমরা এই ব্লগপোস্টে লিখছি – তাবিজ লেখার নিয়ম । এটা জায়েজ না কি শিরক? বিস্তারিত।
📌 তাবিজ কী?
আরবি শব্দ “تعويذ” (taʿwīdh) থেকে এসেছে “তাবিজ”, যার অর্থ — আশ্রয় চাওয়া বা নিরাপত্তা লাভের জন্য কিছু পড়া বা লেখা। এটি কখনো গলায় পরিধানযোগ্য হয়ে থাকে, কখনো কাপড় বা চামড়ায় মোড়ানো অবস্থায় ঘরে টানিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় এটি কাগজে লেখা থেকে শুরু করে ধাতব পদার্থে খোদাই পর্যন্ত হয়ে থাকে।
❓ কেন মানুষ তাবিজ ব্যবহার করে?
- ভয় ও অনিশ্চয়তা: অজানা শক্তি, জ্বিন, বদনজর, হঠাৎ বিপদ – এসব থেকে বাঁচার জন্য মানুষ আশ্রয় খোঁজে দৃশ্যমান কোনো প্রতীক বা মাধ্যমের মধ্যে।
- চিকিৎসার বিকল্প: রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য যখন ওষুধ বা চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় না, তখন অনেকে তাবিজের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
- সাফল্য ও ভালোবাসা: কেউ কেউ বিশ্বাস করে, তাবিজ ব্যবহার করলে ব্যবসা বাড়ে, বিবাহ হয়, পরীক্ষায় সফলতা আসে – যদিও এগুলোর কোনো প্রমাণ নেই।
🧭 ইসলামী সমাজে তাবিজের প্রচলন ও বিতর্ক
তাবিজের ব্যবহার মুসলিম সমাজে ব্যাপক হলেও, এ নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরাতন। একদিকে কিছু আলেম কুরআনের আয়াত ও সহিহ দোয়া দিয়ে তৈরি তাবিজকে শর্তসাপেক্ষে বৈধ বলেন; অন্যদিকে বহু আলেম এটিকে শিরক ও বিদআত হিসেবে আখ্যায়িত করেন, বিশেষ করে যখন তাবিজে এমন কিছু লেখা থাকে যার অর্থ অস্পষ্ট, বা যেখানে জিন-পরী, সংখ্যা, প্রতীক ইত্যাদির ব্যবহার হয়।
এই দ্বিমত ও বিভ্রান্তির মধ্যেই জরুরি হয়ে দাঁড়ায় — তাবিজ লেখার নির্ভরযোগ্য, শরিয়তসম্মত নিয়ম জানা।
⚖️ শরিয়তের দৃষ্টিতে তাবিজ
📜 সহিহ হাদিস অনুযায়ী তাবিজের অনুমতি বা নিষেধ
তাবিজ সম্পর্কে নবী ﷺ–এর বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়, যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই তাবিজকে নিষেধ করেছেন। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস তুলে ধরা হলো:
🔹 হারাম তাবিজ সম্পর্কে হাদিস
“إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ”
“নিশ্চয়ই ঝাড়ফুঁক, তাবিজ ও প্রেম টানার জাদু — সব শিরক।” 📚 [সুনান আবু দাউদ, হাদিস: 3883 | সহিহ হিসেবে শায়খ আলবানী গ্রন্থিত]
এই হাদিসে ‘تمائم’ শব্দটি তাবিজ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা কুরআনের বাইরে এমন কিছুতে আশ্রয় নেয়, যা শরিয়ত অনুমোদন করে না। নবী ﷺ একে শিরক বলে চিহ্নিত করেছেন।
🔹 শিরক থেকে বাঁচাতে তাবিজ ছেঁড়ে দেওয়ার নির্দেশ
“من تعلق تميمة فقد أشرك”
“যে তাবিজ ঝুলায়, সে শিরক করল।” 📚 [মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: 17440 | সহিহ]
🔹 একটি ঘটনা
একবার সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) এক ব্যক্তির বাহুতে তাবিজ দেখে তা ছিঁড়ে ফেলে বলেন:
“তুমি যদি মারা যেতে তখন, তবে অবশ্যই শিরকের ওপর মারা যেতে।” 📚 [আবদুর রাজ্জাক, মুসান্নাফ: 9467]
এটি তাবিজের ভয়াবহতা বোঝাতে যথেষ্ট।
✅ কুরআনের আয়াত বা দোয়ার তাবিজ বৈধ কি না?
এখানে ফিকহবিদ ও মুহাদ্দিসদের মাঝে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। দুইটি দিক সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. অনুমোদনদাতা আলেমদের মত
কিছু আলেম বলেছেন, যদি তাবিজে কেবল কুরআনের আয়াত বা সহিহ দোয়া লেখা হয় এবং এর সঙ্গে কোনো শিরকি চিন্তা না থাকে — তবে তা বৈধ হতে পারে।
🔹 উদাহরণস্বরূপ, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বালের প্রাথমিক মত ছিল — কুরআনের আয়াতের তাবিজ বৈধ, তবে তিনি পরে মত পরিবর্তন করেন এবং নিষেধ করেন।
🔹 ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন:
“শরিয়ত সম্মত দোয়া যদি তাবিজে লেখা হয়, তবে তা নিষিদ্ধ নয় — কিন্তু পরিহার করাই উত্তম।”
২. বিরোধীদলীয় আলেমদের মত
অধিকাংশ সাহাবী ও ইমামগণ (যেমন: ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, ইমাম মালিক) কুরআনের আয়াত দিয়েও তাবিজ ঝোলানোকে পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ:
- মানুষ অনেক সময় তাবিজকে স্বয়ং শক্তিশালী ভাবতে শুরু করে।
- কুরআনের অবমাননার সম্ভাবনা থাকে (যেমন: অযু ছাড়া স্পর্শ, বাথরুমে যাওয়া ইত্যাদি)।
- আক্বিদায় বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে।
📌 সারকথা
তাবিজের ধরণ | শরিয়তের অবস্থান |
---|---|
জ্যোতিষ/সংখ্যা/জিন–সম্পর্কিত | হারাম ও শিরক |
কুরআনের আয়াত/দোয়া | মতভেদ আছে, তবে সতর্কতা জরুরি |
তাবিজকে উপাস্য ভাবা | স্পষ্ট শিরক |
✍️ তাবিজ লেখার অনুমোদিত শর্তসমূহ
তাবিজ লেখার বিষয়ে ইসলামী শরিয়তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে, যা অনুসরণ করলে তা শিরক থেকে মুক্ত এবং শরিয়ত সম্মত হতে পারে। এই শর্তগুলো নিম্নরূপ:
শুধু কুরআনের আয়াত ও সহিহ দোয়া ব্যবহার
তাবিজে কেবল কুরআনের আয়াত এবং সহিহ দোয়া ব্যবহার করতে হবে। কোনো কিছু লেখার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, যে আয়াত বা দোয়া লেখা হচ্ছে তা কোনো ধরনের বেদাত বা শিরক নয়। কুরআন বা সহিহ হাদিসে নির্দিষ্ট দোয়া যা রোগ, বিপদ বা বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য উল্লেখিত, সেগুলোই তাবিজে ব্যবহার করা উচিত।
উদাহরণস্বরূপ
আয়াতুল কুরসি (সুরা আল-বাকারা 2:255)
“اللّهُ لا إلهَ إلا هوَ الحَيُّ القَيُّومُ”
এই আয়াতটি সমস্ত বিপদ, বিপর্যয়, এবং শত্রু থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, তাই এটি তাবিজে লেখা যেতে পারে।
সুরা আল-ফালাক (113) ও সুরা আন-নাস (114)
এগুলোকে শয়তান, জ্বিন, এবং বদনজর থেকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য তাবিজে লেখা যেতে পারে।
শিরক-মুক্ত লেখা
তাবিজে লেখা বিষয়টি শিরক-মুক্ত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, কোনো ধরনের অলৌকিক শক্তি বা তন্ত্র-মন্ত্র সম্পর্কিত চিহ্ন, প্রতীক বা নাম ব্যবহার করা যাবে না।
উদাহরণস্বরূপ: কোনো পাথর, ধাতু বা বিশেষ সংখ্যার মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টা বা আধ্যাত্মিক শক্তির ধারণা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এতে শিরকের ধারণা তৈরি হয়, যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
যেমন, মানুষের ভাগ্য বা জীবনের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে জাদু বা অন্য যাদুবিদ্যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তা হারাম এবং শিরক হিসেবে গণ্য হবে।
অস্পষ্ট ও যাদুমূলক চিহ্ন বা সংখ্যা ব্যবহার নিষিদ্ধ
কোনো তাবিজে অস্পষ্ট, অজানা চিহ্ন বা যাদুমূলক সংখ্যা ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে যাদু, তন্ত্রমন্ত্র, বা কোনো রহস্যময় চিহ্ন বা সংখ্যা ব্যবহার করা হয়, যা একে আল্লাহ বা তাঁর বিধানের সাথে সম্পর্কিত না রাখে। এর মাধ্যমে শিরক বা বিদআতের ভয় তৈরি হয়।
তাবিজে লেখা কোনো ধরনের সংখ্যা বা চিহ্ন যদি মানুষের মনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, সে আল্লাহর পরিবর্তে সেই চিহ্নের দিকে আস্থা রাখতে শুরু করে, তবে তা স্পষ্ট শিরক হয়ে যায়।
বিপদের আশঙ্কায় লেখার পূর্বে কুরআনের শিক্ষা অনুসরণ করা
শরিয়তে তাবিজ লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা এবং তাবিজ ব্যবহারের মাধ্যমে যেন কোনোভাবেই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অভাব দেখা না যায়। তাবিজ ব্যবহার করা কেবল এক ধরনের নিরাপত্তার প্রতীক হতে পারে, কিন্তু মূলত আল্লাহর সাহায্য এবং তার অনুমতির মধ্যে সব কিছু নির্ভর করে। অতএব, কোনো বিপদ বা সমস্যা আসলে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা জরুরি।
তাবিজে যদি এই শর্তগুলো অনুসরণ করা হয়, তবে তা শরিয়ত সম্মত হতে পারে। তবে, যেহেতু তাবিজের ব্যবহারে অনেক সময় শরিয়ত বিরুদ্ধ চিন্তা ও প্রথা চলে আসে, তাই ইসলামি পরামর্শ গ্রহণ করা এবং সতর্কভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাবিজ লেখার নিয়ম
তাবিজ লেখার বিষয়ে ইসলামী শরিয়তে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত রয়েছে, যা অবশ্যই অনুসরণ করা উচিত। এগুলোর মাধ্যমে তাবিজ ব্যবহারের বিধান আরও স্পষ্ট হয় এবং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। নিচে এই নিয়মগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো:
১. কোন আয়াত বা দোয়া লেখা যেতে পারে
তাবিজে ব্যবহৃত আয়াত বা দোয়া অবশ্যই কুরআনের আয়াত বা সহিহ হাদিসের দোয়া হতে হবে। এর মধ্যে কিছু বিশেষ আয়াত এবং দোয়া রয়েছে, যেগুলো বিশেষ উদ্দেশ্যে তাবিজে লেখা যেতে পারে। যেমন:
- আয়াতুল কুরসি (সুরা আল-বাকারা 2:255): এই আয়াতটি বিপদ ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং একজনের ওপর আল্লাহর হেফাজত সৃষ্টি করে।
- সুরা আল-ফালাক (113) ও সুরা আন-নাস (114) : শয়তান, জ্বিন, এবং বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই দুই সুরা তাবিজে লেখা যায়।
- সুরা ইয়াসিন (36:58) :এই আয়াতটি রোগ, অসুখ ও বিপদ থেকে মুক্তির জন্য ব্যবহার করা যায়।
- সহিহ দোয়া : আল্লাহর নিকট বিশেষ সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য সহিহ হাদিসে উল্লেখিত দোয়াগুলোও তাবিজে লেখা যেতে পারে, যেমন:اللّهُمّ إني أسألك العافية (আল্লাহুম্মা ইন্নি আসাঅলুক আল-আফিয়া)
অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! আমি তুমিই সুস্থতা প্রার্থনা করছি।”
২. কাগজ, কালি, পরিবেশ – পবিত্রতা রক্ষা
তাবিজ লেখার সময় কাগজ, কালি এবং পরিবেশের পবিত্রতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। ইসলামে পবিত্রতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই তাবিজ লেখার জন্য:
- কাগজ: পরিষ্কার ও পবিত্র কাগজ ব্যবহার করা উচিত।
- কালি: যদি সম্ভব হয়, পবিত্র কালি (যেমন সীসা-মুক্ত কালি) ব্যবহার করা উচিত।
- পরিবেশ: তাবিজ লেখার স্থানও পবিত্র হওয়া উচিত। লেখার সময় অবশ্যই উন্নত অবস্থায়, নির্জন স্থানে বসে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে হবে। কেউ যেন এমন কাজে অশুচি বা অশ্রদ্ধাশীল না হয়, সে জন্য পুরো পরিবেশ এবং তার ব্যবহারযোগ্য বস্তুসমূহের শুদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি।
৩. লেখার পর ব্যবহারের নিয়ম: গলায় ঝুলানো, পানি দিয়ে খাওয়া ইত্যাদি
তাবিজ লেখার পর তাকে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। তবে, এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে শরিয়ত অনুযায়ী কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত:
- গলায় ঝুলানো: তাবিজটি যদি শারীরিক বিপদ থেকে রক্ষা বা নিরাপত্তা দিতে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা গলায় ঝুলানো যেতে পারে। তবে, গলায় ঝুলানোর ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে এটি কোনো শিরক সৃষ্টি করছে না, যেমন অলৌকিক শক্তির দিকে মনোনিবেশ করা।
- পানি দিয়ে খাওয়া: কিছু তাবিজ, বিশেষত কুরআনের আয়াত লিখিত তাবিজ, পানি দিয়ে ভিজিয়ে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে তাবিজের মাধ্যমে কুরআনের বরকত ও দোয়ার প্রশান্তি শরীর ও মনে প্রবাহিত হয়।
- অন্য শরীরের অংশে রাখা: কখনো কখনো, তাবিজ শরীরের বিশেষ অংশে, যেমন বুক, হাত বা পকেটে রাখা যেতে পারে, তবে অবশ্যই এর মধ্যে কোনো অশুচিতার সম্ভাবনা থাকা উচিত নয়।
- অন্য কোনো অলঙ্করণ বা জাদু ব্যবহার না করা: তাবিজে কোনো ধরনের অশুদ্ধ চিহ্ন, জাদু, তন্ত্র-মন্ত্র বা অলৌকিক শক্তির কোনো ধারণা রাখা যাবে না। তাবিজে ব্যবহৃত হতে হবে শুধুমাত্র কুরআন বা সহিহ হাদিসের দোয়া।
ভুল পদ্ধতিতে তাবিজ লেখার নিয়ম ও বিপদ
তাবিজ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভুল পদ্ধতি এবং শিরক বা যাদুর প্রতি বিশ্বাস এক ধরনের বিপদ ডেকে আনে। ইসলামে তাবিজের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখা এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা, তবে ভুল পদ্ধতিতে তাবিজ ব্যবহার করলে তার ফলাফল মারাত্মক হতে পারে। এমন কিছু পদ্ধতি রয়েছে যা ইসলামিক দৃষ্টিকোণে নিষিদ্ধ, এবং এগুলোর মাধ্যমে শিরক এবং কালোজাদুর দিকে প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। এসব ভুল পদ্ধতির কারণে মুসলমানরা আল্লাহর রাস্তা থেকে বিচ্যুত হতে পারে।
জিন, কালোজাদু, নাম-সংখ্যার তাবিজ
কিছু মানুষ জিন বা কালোজাদু দ্বারা তাবিজ তৈরি করার চেষ্টা করে। এগুলো ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। যেমন:
- জিনের মাধ্যমে তাবিজ বানানো: কোনো তাবিজে যদি জিন বা তান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার থাকে, তবে এটি শিরক হিসেবে গণ্য হবে এবং ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে যাবে। মুসলমানদের উচিত তাবিজের মাধ্যমে কোনো জিনের শক্তির প্রতি বিশ্বাস না রাখা।
- কালোজাদু ও যাদু সংক্রান্ত তাবিজ: কালোজাদু এবং যাদুর তাবিজে কিছু সংখ্যার সংমিশ্রণ, বিশেষ অক্ষর বা চিহ্ন থাকে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। এসব তাবিজ থেকে কেবলমাত্র গোমরাহি এবং ধর্মীয় শিরকই হতে পারে।
- নাম-সংখ্যার তাবিজ: কিছু তাবিজে অদ্ভুত সংখ্যার সংমিশ্রণ বা নামের মতো কিছু চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, যা কাল্পনিক শক্তির দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। এটা মুসলমানদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, কারণ এতে আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হতে পারে।
হাদিস দ্বারা নিষিদ্ধ তাবিজের রূপ
প্রচলিত অনেক তাবিজের মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা সরাসরি হাদিস দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস: এমন তাবিজ, যা কোনো ধরনের অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস জাগায়, ইসলামে তা গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করে, সে আমার উম্মতের মধ্যে নয়।” (সহিহ মুসলিম)
- অশুদ্ধ ও অবৈধ তাবিজ: যে তাবিজে কালোজাদু, তন্ত্র-মন্ত্র বা অশুদ্ধ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, তা শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ। এই ধরনের তাবিজ শিরক এবং অযথা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কহীন শক্তির দিকে মানুষকে প্রবণ করে।
উপসংহার ও পরামর্শ
তাবিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। শরিয়ত অনুযায়ী, তাবিজ ব্যবহার একান্তভাবে আল্লাহর সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত, তবে তাতে যাদু বা শিরকসহ কোনো তান্ত্রিক বিশ্বাস থাকতে পারবে না। ভুল পদ্ধতির মাধ্যমে তাবিজ ব্যবহার কেবলমাত্র ব্যক্তি এবং সমাজের মধ্যে অশান্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। মুসলমানদের উচিত:
- রুকইয়াহ (কুরআনিক চিকিৎসা): রুকইয়াহ হল কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা অসুস্থতা বা অপদেবতার প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি বৈধ উপায়। রুকইয়াহ-এর মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শান্তি পাওয়া সম্ভব।
- দু’আ ও কুরআনের মাধ্যমে আত্মরক্ষা: কুরআন এবং সহিহ হাদিসের দোয়া ও আয়াতগুলি প্রতিদিন পাঠ করা উচিত। এতে আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহর হেফাজত পাওয়া যায়।
- অন্ধ বিশ্বাস থেকে সতর্ক থাকা: তাবিজ বা যাদুর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস পরিহার করা উচিত। ইসলামে কোনো অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস রাখা, যা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কহীন, তা শিরক এবং হানিকারক। মুসলমানদের উচিত কেবল আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা এবং তাঁর পথেই চলা।