ইসলামে তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। দাম্পত্যকহল অসহনীয় হয়ে উঠলে তালাক তার মিমাংসার উপায় হিসাবে বিবেচিত। তাই এমন একটি পদক্ষেপ যা সহজেই গ্রহণ করা উচিত নয় বরং সতর্কতার সাথে এবং ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী সেই পথে যাওয়া বাঞ্চণীয়। এই ব্লগপোস্টে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে তালাক দেওয়ার নিয়ম, প্রক্রিয়া এবং এর সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিশ্লেষণ করব।
তালাক: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
“তালাক” শব্দটি আরবি “তালাক” (طلاق) থেকে এসেছে, তার অর্থ “বিচ্ছেদ” বা “মুক্তি।” এটি ইসলামিক জীবনব্যবস্থায় দাম্পত্যজীবনের সাথে জড়িত একটি পদ্ধতি। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের সমাপ্তির সূচনা ঘটায়। তালাক ইসলামে অনুমোদিত হলেও এটি থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকা উচিত। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) তালাককে “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল বিষয়” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
কুরআনের আলোকে তালাক দেওয়ার নিয়ম
১. সতর্কতা ও ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা
কুরআন তালাকের আগে দাম্পত্য সম্পর্ক মেরামত করার চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
“আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।।” (সুরা আন-নিসা, ৪:৩৫)
২. তালাক দেওয়ার ধাপ
কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী তালাক দেওয়ার প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
- প্রথম তালাক: প্রথম তালাক ঘোষণার পর নারীর “ইদ্দত” (তিন মাসিক সময়কাল) পালন করা আবশ্যক। এই সময়ে স্বামী তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে এবং সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করতে পারে।
- দ্বিতীয় তালাক: যদি প্রথম তালাকের পরে পুনরায় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় এবং আবারও বিবাহে সমস্যা হয়, তাহলে দ্বিতীয় তালাক দেওয়া যেতে পারে। এর পরেও একই ইদ্দতের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
- তৃতীয় তালাক: তৃতীয় তালাকের মাধ্যমে বিবাহ চূড়ান্তভাবে ভেঙে যায় এবং পুনরায় বিবাহ সম্ভব হয় না, যদি না স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তারপর বৈধভাবে বিচ্ছিন্ন হন। এটি “তাহলিল” নামে পরিচিত।
আল্লাহ বলেন:
“তালাক দুইবার পর্যন্ত হতে পারে। এরপর হয়তো উত্তমভাবে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রাখা অথবা সৌজন্যের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া।” (সুরা আল-বাকারাহ, ২:২২৯)
হাদিসের আলোকে তালাক
তালাক দেওয়ার শরয়ি পদ্ধতি
মহানবী (সা.) বলেছেন, তালাক এমনভাবে দিতে হবে যাতে তা ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে হয়। তালাক দেওয়ার সময় মাসিক অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ। এটি “তালাক-বিদআ” নামে পরিচিত এবং ইসলামে এটি অপছন্দনীয়।
শরিয়ত তিন তুহুরে ( মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ অবস্থায় ) তিন বার তালাক দেওয়াকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। শুরু হবে এমন তুহুরে যে তুহুরে সহবাস হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় বার তালাক দেওয়ার পর রাজয়াত ( প্রত্যাবর্তন ) করার সুযোগ থাকবে। কিন্তু তৃতীয় বার তালাক দেওয়ার পর আর রাজয়াতের সুযোগ থাকবে না।
পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার দুইশত উনত্রিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
‘(রাজয়ি) তালাক দুইবার (দেওয়া যাবে)। অতপর (রাখতে চাইলে) উত্তম পন্থায় রাখবে অথবা ন্যায় সংগতভাবে বিদায় করে দিবে। …( দুইবার তালাক দেওয়ার পর) যদি তৃতীয়বার তালাক দিয়ে দেয় তাহলে এই স্ত্রী আর তার জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ না অন্য কোন স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।’
তিন তালাক দেওয়ার নিয়ম
আর এই তিন তালাক কখন কীভাবে দিতে হবে তার বর্ণনা এসেছে সুরা তালাকের প্রথম আয়াতে, সেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
‘হে নবি! তোমরা স্ত্রীলোকদের তালাক দিলে তাদেরকে তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও এবং ইদ্দতের সময়টা ঠিকমত গণনা করো।’
সহিহ বুখারি শরিফে রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এই আয়াতটির ব্যাখ্যা এসেছে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। ইবনে উমর (রাদি.) তাঁর স্ত্রীকে হায়েজ ( মাসিক ) অবস্থায় তালাক দেওয়ার পর উমর (রাদি.) রাসূল (সা.)কে এই কথাটি অবগত করলে রাসূল (সা.) বললেন:
‘তুমি তাকে নির্দেশ দাও সে যেন তার স্ত্রীকে রাজয়াত করে নেয়। অতপর সেই মহিলা (চলমান হায়েজ অতিবাহিত করে ) তুহুরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। অতপর মহিলা দ্বিতীয় হায়েজ অতিবাহিত করে তুহুরে পৌঁছে গেলে চাইলে স্পর্শ কারার আগে তালাক দিয়ে দিতে পারে। এটাই হলো ইদ্দত যার নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন।(বুখারি,৫২৫১)
উক্ত আয়াতের তাফসিরে আল্লামা ইবনুল কাসির (রাহ.) বলেন:
‘এখান থেকে ফুকাহায়ে কেরাম তালাককে সুন্নাহ ও বিদআহ দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তালাকে সুন্নাহ হলো মহিলাকে এমন তুহুরে তালাক দেওয়া যে তুহুরে তার সাথে স্বামী সহবাস করেনি। অথবা মহিলার গর্ভ স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তালাক দেওয়া। আর তালাকে বিদআহ হলো কোন মহিলাকে তার হায়েজ চলাকালীন সময়ে বা এমন তুহুরে তালাক দেওয়া যে তুহুরে সহবাস করেছে, এমতাবস্থায় যে, মহিলা গর্ভবতী কি-না তা জানা যায় না। আর (একসাথে) তিন তালাক দেওয়া এটা সুন্নত বা বিদআত কোনটিই নয়।’
তিন তালাক দেওয়ার পর সাংসার করা যাবে না
উল্লেখিত দুটি আয়াত ও হাদিস থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তিনবার তালাক দেওয়ার অধিকার রাখে। যার পদ্ধতি হলো প্রত্যেক তুহুরে (যে তুহুরে সহবাস হয়নি) একবার করে তালাক দেওয়া। প্রথম দু’বার তালাক দেওয়ার পর রাজয়াতের সুযোগ আছে কিন্তু তৃতীয় বার তালাক দিয়ে দিলে তখন আর রাজয়াতের সুযোগ নেই। তিন তালাক দেওয়ার পর তারা আর সংসার করতে পারবেন না।
আর এর বাহিরে যে পদ্ধতিতেই তালাক দেওয়া হোক সেটা শরিয়ত সম্মত পদ্ধতি নয়। চাই হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া হোক বা এক তুহুরে তিন তালাক দেওয়া হোক। এজন্যই রাসূল (সা.) কে যখন জানানো হয় এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছে তখন তিনি বলেছিলেন
‘ আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান থাকতে আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা হচ্ছে ?’ ( নাসাঈ,৩৪০১)।
তবে শরিয়ত বহির্ভূত পন্থায় তালাক দিলে তালাক পতিত হবে কি-না বা কয় তালাক পতিত হবে সে ব্যপারে কুরআনে স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এই আলোচনা থেকে কেবল আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বা হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া শরিয়া বর্হিভূত একটি কাজ।
হিল্লাহর প্রয়োজনীয়তা
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে তৃতীয় তালাকের পর একই স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে স্ত্রীকে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে বৈধ বিবাহ করতে হবে এবং সেই বিয়ে বৈধ উপায়ে ভেঙে যাওয়ার পরই তাদের পুনরায় বিবাহ সম্ভব। তবে এই দ্বিতীয় বিয়ে জালিয়াতি বা চুক্তিভিত্তিক বিয়ে নয় বরং স্বভাবিক বিয়ে অতপর তালাক হতে হবে।
প্রশ্নোত্তর
১. তালাক কি কেবল স্বামীর অধিকার?
না, স্ত্রীও “খুলা” এর মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুরোধ করতে পারেন। তবে এটি একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া এবং এতে স্বামীর সম্মতি প্রয়োজন।
২. তালাক কি তাৎক্ষণিক কার্যকর হয়?
না, তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য ইদ্দতকাল পালনের প্রয়োজন হয়। এটি সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার সুযোগ দেয়।
৩. তালাকের জন্য কি সাক্ষীর প্রয়োজন?
তালাক দেওয়ার সময় সাক্ষী রাখা জরুরী নয়, তবে উত্তম। কুরআন নির্দেশ দিয়েছে তালাক দেওয়ার সময় সাক্ষী রাখা উত্তম। আল্লাহ বলেন:
“…তোমাদের মধ্য থেকে ন্যায়পরায়ণ দুইজনকে সাক্ষী বানাবে। আর আল্লাহর জন্য সঠিক সাক্ষ্য দেবে।” (সুরা আত-তালাক, ৬৫:২)
৪. তালাক কি মাসিক অবস্থায় দেওয়া যায়?
না, মাসিক অবস্থায় তালাক দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। এটি হাদিস দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে। তালাক দেওয়ার নিয়ম মেনে তালাক দেওয়া আবশ্যক।
৫. তিন তালাক একবারে দিলে কী হয়?
একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া বিদআতি পদ্ধতি এবং এটি ইসলামে অপছন্দনীয়। অনেক ফকিহের মতে এটি একটি তালাক হিসেবে গণ্য হয়, তবে কিছু মত অনুযায়ী তিন তালাক কার্যকর হয়।
উপসংহার
তালাক একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত যা জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। তাই এটি নেওয়ার আগে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ করা আবশ্যক। ইসলামে তালাক বৈধ হলেও এটি সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিবেচিত। সম্পর্কের মীমাংসার চেষ্টা এবং ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করাই উত্তম। তালাকের বিষয়টি দাম্পত্য জীবনে ভারসাম্য এবং ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।