নামাজ না পড়ার শাস্তি । দুনিয়া ও আখিরাতে । চার ইমামের অভিমত

পোস্টটি শেয়ার করুন

নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। নামাজ কায়েম করলে ঈমান থাকে, আর তা পরিত্যাগ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় বলে অনেক ইমাম মতামত দিয়েছেন। নামাজ রোজ পাঁচবার আমাদের নিয়ে যায় আল্লাহর সান্নিধ্যে। এটি অশ্লীলতা, অন্যায় এবং পাপাচার থেকে বিরত রাখে। কেন?

কারণ নামাজের পঠন ও ক্রিয়া আমাদের সচেতন রাখে — চলা-ফেরায়, গোপনে এবং প্রকাশ্যে আল্লাহর কথা আমাতের স্বরণ করিয়ে দেয়। নামাজ সর্বদা আমাদের মনে এই অনুভূতি জাগ্রত করে যে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের দেখছেন। এটি আমাদের দেহ ও আত্মাকে প্রশান্ত করে। হৃদয়কে দুনিয়ার দুশ্চিন্তা ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের সময় আসলে বেলাল (রাদি.)- কে বলতেন:

“হে বেলাল, নামাজের মাধ্যমে আমাদের শান্তি প্রদান কর।” (আবু দাউদ : ৪৯৮৫ )

এভাবেই আমাদের পূর্বসূরি সাহাবি, তাবেঈন এবং তাবেতাবেঈন— যারা রচনা করেছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। তারা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর অনুসরণে নামাজের প্রতি যত্নবান ছিলেন। তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করতেন। কখনো তাতে অবহেলা বা অলসতা করতেন না।

এরপর এলেন তাদের পরবর্তী শতাব্দীর উত্তরসূরিরা। তারা এলেন এমন এক যুগে, যেখানে ফিতনা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিলো। অন্যায় কাজগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। পাপ ও পূণ্যের সীমারেখা মুছে গেয়েছিলো। সেই যুগে সত্য মিথ্যায় এবং মিথ্যা সত্যে রূপ নিতে লাগলো। সুন্নতকে বিদআত এবং বিদআতকে সুন্নত হিসেবে গ্রহণ করা শুরু হলো। কুরআন ও সুন্নাহ উপর প্রাধান্য পেলো সমাজে রীতিনীতি ও কুপ্রথা।

ফলস্বরূপ, অনেক মানুষ নামাজ ত্যাগ করতে লাগলো। আল্লাহ যাদের প্রতি রহম করলেন, তারা ব্যতীত।

অনেক ব্যক্তি অলসতার কারণে, অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগ করতে লাগলেন। ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ত্যাগ করার প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পেতেই লাগলো। প্রশ্ন দেখা দিলো – যে ব্যক্তি নামাজ ত্যাগ করে তার বিধান কী? বা নামাজ না পড়ার শাস্তি কী?

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল তিন ধরনের লোককে নামাজ না পড়ার অনুমতি দিয়েছেন:

“পাগল, যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়; শিশুরা, যতক্ষণ না তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়; এবং ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে জেগে ওঠে।” ( আবু দাউদ – ৪৪০৩ )

সুতরাং এই তিন ধরনের ব্যক্তি ছাড়া যেই নামাজ ত্যাগ করবে, ইসলামে তার অবস্থান কী? সে কী মুসলিম থাকবে? ইসলামিক আলাদত তাকে কী ধরণের শাস্তি দিতে পারবে? মরণের পর তার শাস্তি কেমন হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকছে নিম্নে।

নামাজ না পড়ার ইহকালীন শাস্তি

উলামায়ে কেরাম নামাজ ত্যাগকারীর শাস্তি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। ইবনে হাজার হাইসামির আল-জাওয়াজির আন ইকতিরাফিল-কাবায়ের গ্রন্থে এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

নামাজ ত্যাগ করা একটি মহাপাপ। পাপের শাস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, পাপ মানুষকে নিজের মূল্যবোধ ভুলিয়ে দেয়।

ইমাম ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন: মানুষ নিজের মূল্যবোধ ভুলে গেলে সে নিজেকে অবহেলা করে এবং নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। তিনি আরও বলেন, পাপের আরেকটি শাস্তি হলো, এটি বিদ্যমান নেয়ামতগুলোকে ছিনিয়ে নেয় এবং আসন্ন নেয়ামতগুলোর পথ বন্ধ করে দেয়।

কারণ, আল্লাহ পক্ষ থেকে কেবল তারাই নেয়ামত লাভ করে যারা তাঁর আনুগত্যে করে। এই আনুগত্যেই রক্ষা ও আর হারানো নেয়ামতগুলো ফিরে পাওয়ার মাধ্যম।

পাপের আরেকটি শাস্তি হলো, সম্মানহানী এবং আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারানো। কারণ, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হলো সে, যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি। আর এটি আনুগত্যের মাধ্যমে অর্জিত হয়। যখন কেউ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তখন সে আল্লাহর দৃষ্টিতে হেয় হয়ে পড়ে এবং সৃষ্টির কাছেও তার মর্যাদা কমে যায়।

নামাজ ত্যাগকারীদের ক্ষেত্রে যে শাস্তিগুলো হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে: মৃত্যুকালে কষ্টকর অবস্থা, দুঃখময় জীবনযাপন। নিচের আয়াতটি থেকে আমরা এটি বুঝতে পারি:

وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى

“আর যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, তার জীবিকা সংকুচিত হবে এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাব।” (সূরা ত্বাহা: ১২৪)

ইসলামিক আদালতে শাস্তি

নামাজ বাধ্যতামূলক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে নামাজ পরিত্যাগকারী কাফির। সে নিঃসন্দেহে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। ইসলামিক আদালত তাকে ‘রদ্দা’ বা ইসলাম ত্যাগের শাস্তি হিসাবে হত্যা করতে পারবে। এটা সকল ইমাম ও ফকিহদের সর্বসম্মত অভিমত।

অন্যদিকে যে ব্যক্তি নামাজ ফরজ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কিন্তু অলসতা বা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে তা ত্যাগ করে, তাকে হাদিসে কাফির বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু আলেম এসব হাদিসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে নামাজ ত্যাগকারীকে কাফির বলেছেন।

এটি এক জামাত সাহাবায়ে কেরাম, ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল ও শাইখুল ইসলাম ইবন তায়মিয়ার অভিমত। ইসহাক ইবন রাহুয়াইহ (রহ.) উল্লেখ করেছেন, এটি আলেমদের সর্বসম্মত মত। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবন নাসর মারওয়াজি তার জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম গ্রন্থে বলেছেন: এটি আহলে হাদিসদের অধিকাংশের মত।

ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি (রহ.) এর অভিমত হলো – তাকে রিদ্দা বা ইসলাম ত্যাগকারী বলা যাবে না। তবে নামাজ ত্যাগকারীর শাস্তি হিসাবে তাকে হত্যা করা যাবে।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, নামাজ ত্যাগকারীকে কারাগারে রাখা হবে, যতক্ষণ না সে নামাজ আদায় করে।

মূল কথা: চার ইমামের তিনজনই ইচ্চাকৃত নামাজ পরিত্যাগকারীকে হত্যা করার পক্ষে মত দিয়েছেন। ইমাম আহমদ বলেছেন তাকে রিদ্দা বা ধর্ম ত্যাগকারী গণ্য করে হত্যা করা হবে। আর ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি বলেছেন, তাকে নামাজ ত্যাগের শাস্তি হিসাবে হত্যা করা হবে। রিদ্দা হিসাবে নয়।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. এর অভিমত অনুযায়ী : নামাজ ত্যাগকারী মারা জানাযা পড়াও জায়েয নেই। মুসলমানের কবরস্থানে তাকে দাফন করা যাবে না। স্ত্রী নামাজি হলে বেনামাজি স্বামীর সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। তার রক্ত সম্পর্কের লোকদের কাছ থেকে ওয়ারিশসূত্রে কোন সম্পদ পাবে না। আর যদি মৃত ব্যক্তিটি বেনামাজি হয় তাহলে তার সম্পদও তার নিকটাত্মীয়রা পাবে না। তার জবাইকৃত পশুর মাংস খাওয়া জায়েয নেই। মক্কা ও হারামের সীমানায় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ।

সারসংক্ষেপ

নামাজ ত্যাগকারীদের দুটি ধরণ রয়েছে:

১. যে ব্যক্তি নামাজের বাধ্যতামূলক হওয়া অস্বীকার করে: এ ব্যক্তি আলেমদের সর্বসম্মত মতে কাফির এবং ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। তাকে ধর্মত্যাগী (মুরতাদ) হিসেবে হত্যা করা হবে।

২. যে ব্যক্তি অলসতা বা গাফিলতির কারণে নামাজ ত্যাগ করে: এ ক্ষেত্রে আলেমদের মধ্যে দুইটি মত রয়েছে:

প্রথম মত: এ ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয় না। এটি অধিকাংশ আলেমদের মত। তবে তাকে নামাজ না পড়ার শাস্তি দেওয়া হবে।

দ্বিতীয় মত: এ ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। এটি ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মাযহাবে বিখ্যাত মত।

গ্রহণযোগ্য মত হলো: নামাজ ত্যাগকারীকে তওবার নির্দেশ দেওয়া হবে। যদি সে তওবা করে, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে।

নামাজ না পড়ার পরকালীন শাস্তি

মরণের পর নামাজ ত্যাগকারী জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামীদের সম্পর্কে বলেছেন:

مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ ۝ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ

“তোমাদের কী জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে: আমরা নামাজ আদায়কারীদের মধ্যে ছিলাম না।” (সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৪২-৪৩)

এটি প্রমাণ করে যে, যারা নামাজ ত্যাগ করে তারা জাহান্নামবাসী হবে।

নামাজ ত্যাগকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে কিনা, সেটা নির্ভর করে নামাজ ত্যাগের ধরণ এবং তার কুফরের প্রকারের উপর।

১. যে ব্যক্তি নামাজ বাধ্যতামূলক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে: এ ধরনের ব্যক্তি সম্পর্কে আলেমদের সর্বসম্মত মত হলো, সে বড় ধরনের কুফর (কুফর আকবর)-এ লিপ্ত। এর ফলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাযবে। এ ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

২. যে ব্যক্তি অলসতা বা গাফিলতির কারণে নামাজ ত্যাগ করে: এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ ফকিহদের মতে, এটি ছোট ধরনের কুফর (কুফর আসগার)। এটা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না।

জুমহুরের মতানুসারে, অলসতা বা গাফিলতির কারণে নামাজ ত্যাগকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না। কারণ তার কুফর ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায় না।


পোস্টটি শেয়ার করুন