সর্বসম্মত মত অনুযায়ী ইসলামে পবিত্রতা (তাহারাত) একটি আবশ্যক কাজ। এর মধ্যে ফরজ হলো—পানি দিয়ে ওজু ও গোসল করা যথা: জানাবাত, হায়েজ ও নিফাসের পর। আর যখন পানি অনুপলব্ধ হয়, কিংবা ব্যবহার করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তখন তার বিকল্প হিসেবে তায়াম্মুম করা যায়। এছাড়া, অপবিত্রতা (নাজাসাত) দূর করাও বাধ্যতামূলক। পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে নিচের বিষয়গুলোতে ফিকহবিদগণ একমত হয়েছেন:
১. পবিত্র ও বিশুদ্ধ পানি (ماء طهور أو مطلق): দিয়ে পবিত্র হওয়া জায়েয। অর্থাৎ এমন পানি যেটিকে নিছক ‘পানি’ বলা হয়, কোনো বাড়তি বিশেষণ ছাড়াই—যেমন: ব্যবহৃত পানি, অথবা গোলাপজল ইত্যাদি বলা হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আমি আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি” (সূরা আল-ফুরকান, ২৫:৪৮)।
“তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য আকাশ থেকে তোমাদের ওপর পানি বর্ষণ করেছেন” (সূরা আল-আনফাল, ৮:১১)।
২. প্রস্রাব-পায়খানার মলদ্বার ও মূত্রদ্বার পরিষ্কারে কাগজ বা পাথর দিয়ে মুছে ফেলা জায়েয, যতক্ষণ না অপবিত্রতা অতিরিক্ত হয়ে যায়।
৩. তায়াম্মুম (মাটি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন) একটি শরিয়তসম্মত পদ্ধতি।
৪. মদে আসল বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে গেলে—যেমন তা ভিনেগারে রূপ নিলে—তা পবিত্র হয়ে যায়।
হানাফি মাযহাবে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম
পবিত্রতা অর্জনের উপরে উল্লেখিত মাধ্যমগুলো ব্যতীত অন্য কিছু মাধ্যম নিযে ফিকহবিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । নিচে হানাফি মাযহাবের মতামত তুলে ধরা হলো:
১. বিশুদ্ধ পানি (ماء مطلق)
যেকোনো বিশুদ্ধ পানি—even ব্যবহৃত হলেও—যেমন: বৃষ্টির পানি, নদী, সাগর, কূপ, ঝরনা, কিংবা বন্যার পানিতে—পবিত্রতা অর্জন করা যায়। কেননা, আল্লাহ বলেন, “আমি আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি” (আল-ফুরকান: ৪৮)।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
“পানি পবিত্র, কোনো কিছু তা অপবিত্র করে না, যতক্ষণ না তার রং, গন্ধ বা স্বাদ পরিবর্তিত হয়।”
এখানে ‘তাহুর’ মানে নিজে পবিত্র এবং অন্যকে পবিত্র করার উপযোগী।
২. অন্যান্য তরল পদার্থ
পবিত্র তরল পদার্থ (المائعات الطاهرة)
এগুলো হলো এমন তরল—
যেগুলো চিপে বের করা যায়, অথবা যেগুলো নাপাকী দূর করতে সক্ষম। এমন তরল পদার্থ দ্বারা হুকমী পবিত্রতা অর্জন হয় না; অর্থাৎ ওজু বা গোসল করা যায় না। হানাফি মাযহাবসহ অন্যান্য মাযহাবও এ বিষয়ে একমত। কারণ কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী, হুকমী পবিত্রতা অর্জন শুধু পানির মাধ্যমে হতে পারে। পানি সাধারণভাবে মানুষের জন্য সহজলভ্য।
তবে তার দ্বারা হাকীকী পবিত্রতা হয়
অর্থাৎ কাপড় বা শরীরের উপর বাস্তব নাপাকী থাকলে, এইসব তরল দিয়ে ধুলে তা পবিত্র হয়ে যায়। এ মতটি ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর অভিমত।
এই তালিকার তরলগুলো দিয়ে হাকীকী পবিত্রতা অর্জন সম্ভব
১. গোলাপ জল ও ফুলের নির্যাস
২. ভিনেগার (সিরকা)
৩. গাছ ও ফলে থেকে বের হওয়া রস (যেমন আনারের রস)
৪. ফুল (বাকলা/বীনস) রান্না করার পর পানি ঘন হয়ে গেলে তা
৫. যে কোনো তরল, যা চিপে বের করা যায়
৬. থুতু (যদি তা চেপে বের হয়)
✅ উদাহরণ:
- যদি বমিতে নাপাক হওয়া একটি আঙুল বা স্তন কোনো শিশু তিনবার চুষে ফেলে, তবে তা পবিত্র হয়ে যাবে।
- মদ পানকারী ব্যক্তি নিজের লালা বারবার গিলে ফেললে তার মুখ পবিত্র হয়ে যাবে।
যে সব তরল দিয়ে পবিত্রতা অর্জন হয় না
এইসব তরলের গঠন এমন যে, তা দিয়ে নাপাক বস্তু ধুয়ে ফেলার উপযুক্ত নয়, কারণ:
পবিত্রতার জন্য দরকার—নাপাক বস্তু থেকে অংশবিশেষ ধুয়ে ধুয়ে অপসারণ করা। এটা সম্ভব শুধু সেই তরল দিয়ে, যা চিপে বের হয় বা সহজে প্রবাহিত হয়।
এইসব তরলের তালিকা:
- মধু
- ঘি বা চর্বি
- তেল ও তেলেরজাতীয় পদার্থ
- দুধ (যদিও তা ছানা বা মাখনের পানি হয়)
- ঝোল বা তরকারির তরল অংশ।
পানি যদি অন্য কিছুতে মিশে যায়
পানি যদি অন্য কিছুতে মিশে গেলেও পবিত্রতা অর্জন জায়েয, যদি পানিতে কোনো পবিত্র জিনিস মিশে তার রং, গন্ধ, বা স্বাদ কিছুটা বদলে দেয় এবং তখনও তার তরলভাব ও পানি বলা যায় এমন অবস্থা বজায় থাকে।
যেমন:
- বৃষ্টির পানি
- যে পানি গাছ, মাটি, পাতা বা ডাল-পালার সঙ্গে মিশেছে
- সাবান, ছাই, জাফরান ইত্যাদিতে মেশা পানি, যদি তা তরল থাকে
তবে পানিতে মিশ্র বস্তু যদি এত বেশি হয়ে যায় যে, তা ঘন হওয়া ফলে সেটাকে আর পানি বলে চেনা যায় না, যেমন:
- জাফরান মিশে তা একেবারে রঙিন পানিতে পরিণত হলে।
- মাটি মিশে পানি পিচ্ছিল কাদা হয়ে গেলে।
- সাবান বা ছাই মিশে ঘন ঝোল হয়ে গেলে।
৩. দলক (الدلك) – ঘষে পবিত্র করা
🔹 দলক কী?
দলক অর্থ— নাপাক জিনিসকে শক্তভাবে মাটির উপর ঘষা, যাতে নাপাকির চিহ্ন বা বস্তুগত অংশ দূর হয়ে যায়।
এর অনুরূপ একটি পদ্ধতি হলো:
হাত বা কাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে কুঁচকে ফেলা (الحتّ)। এই পদ্ধতিতে নাপাক বস্তু ঝরে পড়ে।
যেসব বস্তু ঘষে পবিত্র করা যায়
জুতা, মোজার নিচের অংশ, স্যান্ডেল ইত্যাদি, যদি সেগুলো এমন কোনো নাজাসাতে নাপাক হয়ে যায়— যার বস্তুমূলক আকৃতি আছে (جرم), তাহলে তা ঘষে পবিত্র করা যায়।
🧱 جرم (জারম) বলতে বোঝানো হয়: যেসব নাপাকি শুকিয়ে গেলে দৃশ্যমান থাকে, যেমন—
- মল
- পশুর গোবর
- শুকনো রক্ত
- শুকনো বীর্য
- মাটি লেগে থাকা প্রস্রাব বা মদের ফোঁটা
👉 এগুলো শুকনো হোক বা ভেজা হোক, ঘষে তুলে ফেললে পবিত্র হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
إذا جاء أحدكم المسجد، فليقلب نعليه ولينظر فيهما، فإن رأى خَبَثاً (أذى أو قذراً)، فليمسحه بالأرض، ثم ليصل فيهما
“তোমাদের কেউ যখন মসজিদে আসে, সে যেন তার জুতার নিচটা উল্টিয়ে দেখে। যদি নাপাক কিছু দেখে, তাহলে যেন তা মাটিতে ঘষে মুছে ফেলে, তারপর ওই জুতা পায়ে নামাজ পড়ুক।” ( আহমদ ও আবু দাউদ)
[হাদীসটি ব্যাপক অর্থবোধক, এতে ভেজা বা শুকনোর পার্থক্য করা হয়নি]
🔹 সুতরাং ভেজা নাপাকিও ঘষে দূর করা জায়েয—এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য মত।
কিন্তু যদি নাপাকির বস্তুরূপ না থাকে (অর্থাৎ, একেবারে তরল হয়ে গেছে বা চিহ্ন নেই, তখন তিনবার পানি দিয়ে ধুতে হবে, এমনকি তা শুকিয়ে গেলেও।
প্রতি ধোয়ার পর:
- পানি ঝরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
- মোজা বা জুতা ভিজে থাকলেও সমস্যা নেই, তবে ভেজাভাব কেটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
- পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়া শর্ত নয়।
৪. নাপাকির চিহ্ন ঘষে (মুছে) দূর করা
যেসব বস্তু মসৃণ ও অভেদ্য জিনিস অর্থাৎ, ভিতরে কিছু ঢোকে না— তাতে যদি নাপাকি লাগে, তাহলে মুছে ফেললেই তা পবিত্র হয়ে যায়।
✅ যেমন বস্তু:
- তলোয়ার
- আয়না
- কাচ
- পালিশকৃত বা লেপা ধাতব পাত্র
- নখ
- হাড়
- চিনামাটির বাটি
- খাঁজবিহীন রুপার পাত ইত্যাদি
📌 এসব বস্তুর বৈশিষ্ট্য:
- এগুলোর মধ্যে নাপাকি ঢুকে যেতে পারে না।
- তাই শুধু ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে ফেললেই বাহ্যিক নাপাকি দূর হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাহাবিদের আমল
সাহাবিরা কাফেরদেরকে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করতেন, তলোয়ারে অনেক সময় রক্ত লাগানো থাকতো। এরপর তলোয়ারটি মুছে ফেলেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। এতে প্রমাণ হয়, নাপাকি মুছে ফেলেই পবিত্রতা অর্জন সম্ভব, যদি তা মসৃণ ও অভেদ্য জিনিসে থাকে।
🩸 হিজামার (শিঙ্গা বা রক্ত ঝরানোর) স্থান
যখন হিজামা করা হয়, তখন শরীরের এক স্থানে রক্ত বের হয়। সেই স্থান পবিত্র করার জন্য তিনটি পরিষ্কার ও ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে ফেললেই যথেষ্ট।
৫. রোদ বা হাওয়ায় শুকিয়ে নাপাকির চিহ্ন দূর হওয়া
যদি কোনো স্থায়ী বস্তু (যেমন: মাটি, গাছ, ঘাস, পাকা মেঝে ইত্যাদি) নাপাক হয়ে যায়, তবে রোদ বা বাতাসে শুকিয়ে গেলে এবং নাপাকির চিহ্ন (দাগ, গন্ধ) চলে গেলে— তখন সেগুলো পবিত্র হয়ে যায়। তবে এই পবিত্রতা শুধু নামাজ পড়ার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু তইয়াম্মুম করার জন্য যথেষ্ট নয়।
❌ কিন্তু নিচের জিনিসগুলো:
যেমন—
- কাপড়
- বিছানার চাদর
- পাটি
- দেহ
- যেকোনো স্থানান্তরযোগ্য জিনিস
👉 এগুলো শুকিয়ে গেলে পবিত্র হয় না, ধুতে হবে পানি দিয়ে।
এই হুকুমের ভিত্তি
🔸 ইসলামী একটি মূলনীতি
“مذكاة الأرض يبسها”
অর্থ: “পৃথিবী বা জমিনের জন্য পবিত্রতা হলো তার শুকিয়ে যাওয়া।”
🔸 হাদীস থেকেও প্রমাণ: ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন:
“আমি নবিজি ﷺ-এর যুগে মসজিদে রাত কাটাতাম, তখন কুকুরেরা এসে সেখানে পেশাব করত ও ঘোরাফেরা করত, কিন্তু সাহাবিরা মসজিদে কোনো কিছু ছিটাতেন না।” 📚 [সহীহ বুখারী]
নামাজ আর তইয়াম্মুমে পার্থক্য
🔸 নামাজের জন্য প্রয়োজন: শুধু পবিত্রতা (طهارة)
🔸 তইয়াম্মুমের জন্য প্রয়োজন: পবিত্র বস্তু (طهُورية), যেমন—পবিত্র মাটি
❗ শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে শুধু পবিত্রতা পাওয়া যায়, কিন্তু তা তইয়াম্মুমের যোগ্যতা অর্জন করে না।
৬. মাটি স্পর্শকারী লম্বা কাপড় দিয়ে হাঁটলে কাপড় পবিত্র হয়ে যায়
যে কাপড় মাটিতে ঘষা লাগে, যেমন—নারীদের লম্বা জামার পেছনের অংশ যদি পবিত্র ও নাপাক জায়গা দিয়ে হাঁটার সময় মাটি স্পর্শ করে, তাহলে বারবার হাঁটার ফলে কাপড় পবিত্র হয়ে যায়।
হাদীস প্রমাণ:
উম্মু সালমা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বললেন:
“আমি একজন মহিলা, আমার জামার পেছনের অংশ অনেক লম্বা হয়, আমি যখন নাপাক জায়গার উপর দিয়ে হাঁটি তখন কী হবে?”
রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন:
“তারপর যেসব জায়গা দিয়ে হাঁটবে, সেগুলোই তাকে পবিত্র করে দেবে।” 📚 (সহীহ – আবু দাউদ)
✅ হানাফি, মালিকি, হাম্বলি সব মাজহাব এই হুকুমের সাথে একমত।
৭. শুকিয়ে যাওয়া মানুষের বীর্য কাপড় থেকে ঘষে পবিত্র করা যায়
যদি মানুষের বীর্য কাপড়ে লাগে এবং তা শুকিয়ে যায়, তাহলে সেটিকে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করলেই কাপড় পবিত্র হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে রঙ বা দাগ থেকে গেলেও ক্ষতি নেই, যেমন পানি দিয়ে ধুলেও কখনও রঙ থেকে যায়। তবে বীর্য ভেজা অবস্থায় থাকলে বা এটি মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীর বীর্য তখন ধুতে হবে।
হাদীস প্রমাণ
◉ আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন:
“আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাপড় থেকে বীর্য শুকিয়ে গেলে ঘষে ফেলতাম, আর **ভিজে থাকলে ধুয়ে ফেলতাম।” 📚 (দারাকুতনী, সহীহ হাদীস)
৮. নদফ (ঝাঁকুনি দেওয়া)
যদি তুলা বা তুলার মতো কিছুতে অল্প পরিমাণে নাপাকি লাগে, তাহলে ঝাঁকিয়ে দেওয়া বা ঝাঁটি দিয়ে পরিষ্কার করলেই তা পবিত্র হয়ে যায়, যতক্ষণ না নাপাকির চিহ্ন দূর হয়ে যায়।
৯. তুচ্ছ অংশ বাদ দেওয়া (التقوير)
এটি এমন পদ্ধতি, যেখানে নাপাক অংশটুকু কেটে বা আলাদা করে বাদ দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পবিত্র করা হয়— ঘন বা জমাট বস্তুর মধ্যে লাগা নাপাকি, যেমন:
- ঘি
- আখের গুঁড়
- অন্যান্য জমাট খাদ্য
হাদীস প্রমাণ
মাইমূনা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন:
“একটি ইঁদুর ঘিয়ে পড়ে মারা যায়। রাসুলুল্লাহ ﷺ–কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন: ‘ওটিকে ও তার চারপাশের অংশ ফেলে দাও, আর বাকি অংশ খাও।’” 📚 (সহীহ হাদীস – বুখারী, মুসলিম)
✅ এই হুকুম সব মাজহাব একমত: যদি ঘি বা খাদ্যটি জমাট বা ঘন হয়, তাহলে শুধু নাপাকি ও তার চারপাশ বাদ দিলেই বাকি অংশ পবিত্র।
❌ কিন্তু যদি তরল জিনিসে নাপাকি পড়ে যেমন: তেল, গলানো ঘি তাহলে জমহুর উলামাদের মতে তা অপবিত্র হয়ে যায়, পুরোটা ফেলে দিতে হবে।
✅ ঘন/জমাট বস্তুতে নাপাকি লাগলে এর হুকুম
যদি বস্তুটি এমন হয়, যেটি ভেতরে ভেতরে নাপাকি শুষে নেয়নি, তাহলে তা পবিত্র করা সম্ভব।
যেমন:
- পাত্র,
- পাথর,
- ধাতব জিনিস
ইত্যাদি → এগুলিকে ধুয়ে পবিত্র করা যায়।
কিন্তু যদি সেটি এমন কিছু হয়, যা নাপাকি ভেতরে ভেতরে শুষে নিয়েছে, যেমন:
- কাঁচা মাংস
- গম
- কাঁচা মুরগি বা পশুর মাথা, পাকস্থলী
যদি সেগুলো আগেই ধুয়ে নেওয়া হয়, তাহলে রান্না করা যাবে। কিন্তু নাপাকি অবস্থায় সেদ্ধ বা রান্না হয়ে গেলে, তখন আর কোনোভাবেই পবিত্র করা যাবে না।
🔴 যেমন:
- যদি কাঁচা মাংস বা গরুর পাকস্থলী ধোয়ার আগে রান্না হয়ে যায় → আর পবিত্র হবে না
- মুরগি যদি পেট না কেটে পালক ছাড়ানোর জন্য সেদ্ধ করা হয় → তা পবিত্র হবে না
১০. বিভাজন ও বণ্টন
যখন কোনো বস্তুর একাংশে নাপাকি লাগে, তখন সেই অংশ আলাদা করে ফেললে বাকিটা পবিত্র হয়ে যায়। যেমন—
- গম বা যবের উপর যদি গাধা মূত্রত্যাগ করে,
- তারপর তার কিছু অংশ ধুয়ে ফেলা হয় বা বিক্রি, হেবা বা খাওয়া হয়,
- তাহলে বাকি অংশও পবিত্র হয়ে যায়।
➤ এভাবে নাপাক জিনিস হেবা দেওয়া হয় এমন ব্যক্তিকে, যে ব্যক্তি সেটাকে নাপাক মনে করে না, তাহলেও তা বৈধ।
📌 তবে মনে রাখতে হবে— বিভাজন, কেটে ফেলা, হেবা দেওয়া ইত্যাদি মূলত পবিত্র করার উপায় নয়,
বরং ইজতিহাদগত সুবিধার জন্য শিথিলতা দেওয়া হয়েছে।
১১. রূপান্তর (الاستحالة)
নাপাক বস্তু যদি রূপ পরিবর্তন করে অন্য কিছুতে পরিণত হয়, তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়।
✅ উদাহরণ:
- হরিণের রক্ত থেকে যদি মোশকের ঘ্রাণ বের হয় → তা পবিত্র
- মদ আপনা-আপনি বা প্রাকৃতিকভাবে ভিনেগারে পরিণত হলে → তা পবিত্র
- মৃত জানোয়ার লবণে পরিণত হলে
- কুকুর লবণের খনিতে পড়ে থেকে গলে গেলে
- গোবর পুড়ে ছাই হয়ে গেলে
- নাপাকি জমিতে পুঁতে রাখলে এবং সময়ের সাথে চিহ্ন চলে গেলে
📌 ইমাম মুহাম্মদের মতে, যখন নাপাকির গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য চলে যায়, তখন তা আর নাপাক থাকে না।
☑️ সব মাজহাব একমত:
- মদ যদি ভিনেগারে পরিণত হয়, তাহলে তা পবিত্র
- মদের পাত্রও পবিত্র, যদি ভিনেগারে পরিণত হয়
- এমনকি তা ছায়া থেকে রোদে নেওয়ার মাধ্যমেও হয়ে থাকুক না কেন
১২. চামড়া চেঁছে পরিষ্কার করা (الدباغ)
মৃত বা নাপাক জানোয়ারের চামড়া যদি দবাগ দেওয়া (চেঁছে ও শুকিয়ে) হয়, তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়। তবে এর ব্যতিক্রম:
- মানুষের চামড়া
- শুকরের চামড়া
- যেসব চামড়া দবাগ সহ্য করে না, যেমন ছোট সাপ বা ইঁদুরের চামড়া
📚 হাদীস:
“যে কোনো চামড়া দবাগ দেওয়া হলে তা পবিত্র হয়ে যায়।” রাসুল ﷺ একবার এক নারীর কাছ থেকে পানি চাইলেন। তিনি বললেন: “আমার কাছে শুধু এক মৃত জন্তুর চামড়ার পাত্রে পানি আছে।” রাসুল ﷺ জিজ্ঞেস করলেন: “তুমি কি এটিকে দবাগ দিয়েছো?” নারী বলল, “হ্যাঁ।” তিনি বললেন: “তাহলে দবাগ-ই তো এটিকে পবিত্র করেছে।”
১৩. শরঈ জবাই (الذكاة الشرعية)
- একজন মুসলিম বা ইহুদি/নাসারানি যদি কোনো জন্তু জবাই করে, তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়,
এমনকি সে জন্তু খাওয়া না-যাওয়ার উপযুক্ত হলেও।
➤ হানাফি মতে:
- খাওয়া যায় না এমন পশুর চামড়াও জবাইয়ের মাধ্যমে পবিত্র হয়,
- তবে তার মাংস বা চর্বি পবিত্র হয় না।
📚 হাদীস:
“চামড়ার দবাগ-ই হল তার জবাই।”
১৪. আগুন দ্বারা পবিত্রকরণ
আগুনে পুড়িয়ে দিলে যদি নাপাকি রূপান্তর হয়ে যায় বা চিহ্ন মুছে যায়, তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়।
✅ উদাহরণ:
- মাটির হাঁড়ি পোড়ানো
- গোবর ছাই হয়ে যাওয়া
- ভেড়ার মাথায় রক্ত লাগলে তা পুড়িয়ে দেওয়া
- তেল বা মাংস তিনবার আগুনে ফুটানো
📌 ইবনে আবেদীন বলেন:
“সবার ধারণা ঠিক নয় যে, যা-ই আগুনে পড়বে তা পবিত্র হবে। বরং শুধু যেটাতে নাপাকি রূপান্তর হয়ে যায়, সেটিই পবিত্র হয়।”
১৫. নাপাক কূপ পরিষ্কার করা
কোনো কূপে নাপাক কিছু পড়লে, তাহলে তা যতটুকু পরিমাণ পানি তোলা প্রয়োজন,
ততটুকু পানি তুলে ফেললেই কূপ পবিত্র হয়ে যায়।
📌 যদি সম্পূর্ণ পানি তুলে ফেলতে হয়, তাহলে যতদূর সম্ভব জলাধানের মুখ বন্ধ করে দেওয়া উচিত,
তারপর পুরো পানি তুলে ফেলা জরুরি।
➤ যদি পশু পড়ে যায়:
- যদি সেটা মূল থেকেই নাপাক (যেমন: শুকর) → সব পানি তুলতে হবে।
- হানাফি মতে: কুকুর নাপাক নয় মূলত, তাই তার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় আছে।
১৬. পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার মাধ্যমে পবিত্রতা
যদি কোনো ছোট পাত্রে বা হাউজে এক পাশে পানি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়, এতে যদি তিনবার পানি চলাচল করে, তাহলে সেটিকে পবিত্র ধোয়ার মতো ধরা হবে।
➤ ব্যবহার:
- গোসলখানার পাত্র বা
- কোনো বড় পাত্র, যেখানে পানি পড়ে গড়িয়ে পড়ে
১৭. জমি খোঁড়া (الحفر)
নাপাক জমির উপরের স্তর খুঁড়ে নিচে দিলে, এটাও পবিত্রতার একটি উপায়।
১৮. কাপড় বা শরীরের নির্দিষ্ট অংশ ধোয়া
যদি কেউ ভুলে যায় কোথায় নাপাকি লেগেছে, তাহলে পুরোটা না ধুয়ে কাপড়েরর একটি অংশ ধুলেই যথেষ্ট,
এবং এমনকি উপায় না জানলেও তা যথেষ্ট হয়ে যাবে।