ওযু আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সালাত আদায়সহ বিভিন্ন ইবাদতের পূর্বশর্ত হলো ওযু। ওযু ভঙের অনেক কারণ রয়েছে। সেখান থেকে অনেকে প্রশ্ন করেন- পরপুরুষ দেখলে কি ওযু ভেঙে যায়? বিশেষ এই পরিস্থিতিতে নারীদের ওযু থাকবে না কি ভঙ্গ হয়ে যাবে। এই বিষয়টি কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হবে।
ওযুর সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
ওযু হলো পবিত্রতা অর্জনের একটি মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-
“হে মুমিনগণ, তোমরা যখন সালাতের জন্য দন্ডায়মান হবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করো এবং তোমাদের মাথা মসেহ করো এবং পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত করো।” (সুরা মায়িদা: ৬)
এই আয়াতের মাধ্যমে ওযুর বিধান স্পষ্ট করা হয়েছে এবং এর গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। সালাতসহ অন্যান্য ইবাদতগুলোর জন্য পবিত্রতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ওযু ভঙ্গের কারণসমূহ
শরিয়তে ওযু ভঙ্গের কারণগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- প্রস্রাব-পায়খানা ত্যাগ করা: প্রস্রাব বা পায়খানা ত্যাগ করলে ওযু ভেঙে যায়। (সহিহ বোখারি: ১৩৫)
- গ্যাস বা বাতাস নির্গমন: এটি স্পষ্টভাবে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। (সহিহ মুসলিম: ৩৬২)
- গভীর ঘুম: এমন ঘুম যাতে ইন্দ্রিয়শক্তি কাজ করে না। (তিরমিজি: ৯৬)
- নাপাক অবস্থায় রক্ত বা পুঁজ বের হওয়া।
- নারী-পুরুষের চর্মস্পর্শ (ভিন্ন মতামত রয়েছে)।
ওযু ভঙ্গের এই কারণগুলো হাদিস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তবে বিশেষভাবে পরপুরুষকে দেখার বিষয়ে কুরআন ও হাদিস কী বলে তা আমরা পর্যালোচনা করব।
পরপুরুষ দেখলে কি ওযু ভেঙে যায়?
না, পরপুরুষ দেখলে ওযু ভেঙে যায় না। অনেকেই মনে করেন যে, একজন নারী পরপুরুষের দিকে তাকালে তার ওযু ভেঙে যেতে পারে। তবে এই বিষয়ে শরিয়তের নির্ভরযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে বলা যায় যে, পরপুরুষকে দেখলে ওযু ভাঙে না।
কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা:
১. চোখের হিফাজতের নির্দেশ:
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন-
“মুমিন পুরুষদেরকে বলো যে, তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখবে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করবে। এটি তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সব কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।” (সুরা নূর: ৩০)
একইভাবে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে-
“এবং মুমিন নারীদের বলো, তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখবে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করবে…” (সুরা নূর: ৩১)
এই দুই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইসলাম দৃষ্টিকে সংযত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এখানে ওযু ভঙ্গের কোনো ইঙ্গিত নেই।
২. হাদিসের বর্ণনা:
হাদিসে প্রিয় নবী (সা.) বলেন-
“প্রথম দৃষ্টি তোমার জন্য মাফ, কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টি তোমার জন্য গুনাহ। (তিরমিজি: ২৭৭৭)
অর্থাৎ, যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে পরপুরুষ বা অপরিচিত নারীর প্রতি দৃষ্টি পড়ে, তবে এতে কোনো গুনাহ নেই। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকানো গুনাহর কাজ। তবুও এটিকে ওযু ভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়নি।
আরো পুড়ুন:
ওযু ভাঙার ব্যাপারে ভুল ধারণা
অনেক সময় সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যেমন:
- পরপুরুষ দেখলে ওযু ভেঙে যায়: এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কুরআন বা হাদিসে এমন কিছু বলা হয়নি।
- চোখের দ্বারা গুনাহ হলে ওযু করতে হয়: চোখ দিয়ে যদি গুনাহ করা হয়, তবে তা তাওবা ও ইস্তেগফার দ্বারা মাফ করতে হবে। কিন্তু এর জন্য নতুন করে ওযু করা ফরজ নয়।
পরপুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাতের ইসলামিক আদব
যদিও পরপুরুষকে দেখলে ওযু ভাঙে না, তবে ইসলামে পর্দার বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু আদব অনুসরণ করা জরুরী:
- দৃষ্টিকে সংযত রাখা: ইচ্ছাকৃতভাবে পরপুরুষ বা অপরিচিত নারীর দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা।
- পর্দা মেনে চলা: নারীদের জন্য পর্দা করা ফরজ। একইভাবে পুরুষদেরও শালীন পোশাক পরিধান করা উচিত।
- অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকা: পরপুরুষ বা অপরিচিত নারীর সাথে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলা অনুচিত।
- ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া: ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।
সংক্ষিপ্ত উত্তর
পরপুরুষকে দেখলে ওযু ভেঙে যায় না। কুরআন ও হাদিসে ওযু ভাঙার স্পষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু পরপুরুষ দেখা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে ইসলাম দৃষ্টিকে সংযত রাখার নির্দেশ দিয়েছে এবং পর্দার বিধানকে গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: পরপুরুষ দেখলে কি নতুন করে ওযু করতে হবে?
উত্তর: না, পরপুরুষ দেখলে ওযু ভাঙে না। এটি কুরআন বা হাদিসে ওযু ভাঙার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।
প্রশ্ন ২: চোখের দ্বারা গুনাহ করলে কি ওযু নষ্ট হয়?
উত্তর: না, চোখের দ্বারা গুনাহ হলে ওযু নষ্ট হয় না। তবে তাওবা করা উচিত এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
প্রশ্ন ৩: ইসলাম নারীদের জন্য কীভাবে দৃষ্টির সংযমের নির্দেশ দিয়েছে?
উত্তর: ইসলাম নারীদের দৃষ্টি নত রাখতে এবং পর্দা মেনে চলতে নির্দেশ দিয়েছে। (সুরা নূর: ৩১)
প্রশ্ন ৪: নারীরা যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে পরপুরুষকে দেখে ফেলে, তবে কী করা উচিত?
উত্তর: অনিচ্ছাকৃতভাবে দেখলে কোনো গুনাহ হয় না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
উপসংহার
পরপুরুষকে দেখলে ওযু ভেঙে যায় না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী ওযু ভাঙার কারণগুলো স্পষ্ট এবং পরপুরুষ দেখা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে আল্লাহর নির্দেশ মান্য করতে দৃষ্টিকে সংযত রাখা এবং পর্দার বিধান মেনে চলা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। ইসলামী জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে তাঁর বিধান পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।