পানি কত প্রকার ও কি কি? ৩টি বৈশিষ্ট্য ও বিস্তারিত আলোচনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

পানি মূলত সাত প্রকার, যার দ্বারা অজু, গোসল ইত্যাদি মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা যায়। এগুলো হলো— এমন সব পানি, যা আকাশ থেকে বর্ষিত হয়েছে বা পৃথিবী থেকে উৎসারিত হয়েছে।

পানি কত প্রকার বিস্তারিত

১. বৃষ্টির পানি

আল্লাহ তাআলা বলেন:

“আর আমরা আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি।” 📖 [সূরা ফুরকান, আয়াত ৪৮]

২. সমুদ্রের পানি

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত: এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন: “হে আল্লাহর রাসূল! সমুদ্রের পানি দিয়ে অজু করা যাবে?” তিনি (ﷺ) বললেন:

“সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং এর মৃত প্রাণী হালাল।” 📚 (সহীহ হাদীস)

➤ তবে মনে রাখতে হবে:

  • এমন পানি, যা প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ত হয়েছে (যেমন: সমুদ্রের পানি) → তা দ্বারা অজু বা গোসল জায়েয।
  • কিন্তু যে পানি তাতে লবণ গুলে লবণাক্ত করা হয়েছে, অথবা
  • এমন পানি যা গরমে জমে যায় এবং শীতে গলে →
    → সেগুলো মূল পানি থেকে পরিবর্তিত হওয়ায় তা দিয়ে পবিত্রতা অর্জন সঠিক নয়।

৩. নদীর পানি

যে পানি নদী বা ঝরনা থেকে আসে, তা পবিত্রতা অর্জনে বৈধ।

৪. কূপ বা পুকুরের পানি

কূপ (ইচ্ছাকৃত খনন করা পানির উৎস) থেকেও পানি গ্রহণ করে অজু, গোসল ইত্যাদি বৈধ।

৫. তুষার ও শিলাবৃষ্টি (বরফ ও গলা পানি)

আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রাঃ) বলেন:
নবী (ﷺ) দোআ করতেন:

“হে আল্লাহ! আমাকে তুষার, শিলাবৃষ্টি ও ঠান্ডা পানি দ্বারা পরিশুদ্ধ করো। হে আল্লাহ! আমাকে গুনাহ ও ভুলভ্রান্তি থেকে এমনভাবে পরিষ্কার করে দাও যেমন সাদা কাপড় থেকে ময়লা দূর করা হয়।” 📚 (সহীহ হাদীস)

৬. ঝরনার পানি

যে পানি কোনো ঝর্ণা বা প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্গত হয়, তা দ্বারা অজু বা গোসল বৈধ।

৭. প্রস্রবণ/উৎসের পানি

প্রাকৃতিকভাবে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা পানিও পবিত্রতা অর্জনে উপযোগী।

বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পানি এর প্রকার

শরীয়তের দৃষ্টিতে পানিকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে:

প্রথমত: পবিত্র ও পবিত্রকারী পানি, যা ব্যবহার করা অপছন্দনীয় নয়

এটি হলো নির্জলা বিশুদ্ধ পানি, যা এমন কোনো বস্তুর সংমিশ্রণে সীমিত হয়ে যায় না এবং যা অপবিত্রতা দূর করে এবং অজু বা গোসল বৈধ করে।

যেমন: যমযম পানি—যা দিয়ে অজু বা গোসল করলে অধিক সওয়াব লাভ হয়। আবু যার (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“আমার ঘরের ছাদ ফাটা হলো, তখন আমি মক্কায় ছিলাম; তখন জিবরীল (আ.) আমার বুক চিরলেন এবং যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করলেন।” [সহীহ হাদীস, মুসলিম, হা/১৬৩]

তবে যমযম পানি দিয়ে ইস্তিন্জা বা নাপাক দূরীকরণ করা মাকরূহ তাহরীমি (হারামের কাছাকাছি), কারণ এটি বরকতের জন্য ব্যবহারযোগ্য।

পানি পবিত্র ও পবিত্রকারী থাকে নিম্নোক্ত অবস্থায়:

১. যদি কোনো শুকনো পবিত্র বস্তু (যেমন: জাফরান, গাছের পাতা, আছনান) মিশে গিয়ে পানির রং বা গন্ধ বদলে ফেলে, কিন্তু পানির তরলতা বজায় থাকে এবং পানির নামের পরিবর্তন না হয়।

২. যদি কোনো তরল পবিত্র পদার্থ মেশে কিন্তু তার প্রভাব প্রাধান্য না পায় (যেমন: দুধ মিশে গেলে, তার রং বা স্বাদ না বদলালে তা বৈধ)।

৩. যদি তাতে রক্তহীন কীটপতঙ্গ (যেমন: মাছি, মশা, তেলাপোকা) মরে যায়।

৪. যদি তাতে জলজ প্রাণী মরে যেমন মাছ বা জলীয় কুকুর; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“সমুদ্রের পানি পবিত্র, এবং এর মৃত প্রাণী হালাল।”

৫. যদি ব্যবহৃত পানি বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে মিশে এবং বিশুদ্ধ পানি প্রাধান্য পায়।

৬. দীর্ঘ সময় ধরে জমে থেকে যদি পানির গন্ধ বা রং বদলে যায়, তবু তা পবিত্র থাকে।

৭. যদি তাতে জলজ ব্যাঙ মরে—তাহলে পানি অপবিত্র হয় না, তবে তা পান করা হারাম, কারণ ব্যাঙ খাওয়া হারাম।

দ্বিতীয়ত: পবিত্র ও পবিত্রকারী পানি, তবে তা ব্যবহার করা অপছন্দনীয় (যদি বিকল্প থাকে)

যে পানিতে বিড়াল, গৃহপালিত মুরগি বা শিকারি পাখি মুখ দিয়েছে, সে পানি দ্বারা অজু বা গোসল করা বৈধ হলেও বিকল্প থাকলে তা পরিহার করা উত্তম।

হাদীসে এসেছে:

আবু কাতাদাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিড়াল সম্পর্কে বলেছেন:

“এটি অপবিত্র নয়, বরং এটি তোমাদের মাঝে ঘোরাফেরা করে।” [আবু দাউদ, হা/৭৫]

তৃতীয়ত: এমন পানি যা নিজে পবিত্র, কিন্তু অন্যকে পবিত্র করার ক্ষমতা রাখে না

ক. ব্যবহৃত পানি:

এটি সেই পানি— যা দ্বারা অজু বা গোসল করে কোনো হাদস (অপবিত্র অবস্থা) দূর করা হয়েছে। যেমন:

  • অজুর ধৌত পানি,
  • গোসল শেষে শরীর থেকে ঝরানো পানি,
  • এমন পানি যা ইবাদতের নিয়তে শরীরে ব্যবহার করা হয়েছে—যেমন:
    • একটি অজুর পর আবার অজু করা,
    • খাওয়ার আগে হাত ধোয়া (ইবাদতের নিয়তে),
    • হায়েযা নারীর পক্ষ থেকে ফরজ নামাজের জন্য তাসবিহ পাঠের উদ্দেশ্যে অজু করা,
    • মিসওয়াক বা নাক মুখ ধোয়ার সুন্নতের মাধ্যমে আলাদা যে পানি বের হয়।

বেশিরভাগ ফিকহবিদের মতে: পানি শরীর থেকে যখনই বিচ্ছিন্ন হয়, তখনই তা ব্যবহৃত হিসেবে গণ্য হয়—even যদি তা নিচে পড়ে যাওয়ার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়।

খ. গাছ ও ফলমূলের ভিতরে থাকা পানি

যেমন: নারকেল পানি, আঙ্গুরের রস—এসব নিজে পবিত্র, কিন্তু এগুলোর দ্বারা অজু বা গোসল করা যায় না।

গ. পানি যেটি রান্না করে তার তরলতা (পানিসুলভতা) হারিয়েছে

যেমন: ছোলা, ডাল ইত্যাদি রান্নার পরে পাওয়া ঝোল, বা শুকনো কোনো বস্তু মিশে যাওয়ায় যে পানির তরলতা চলে গেছে।

ঘ. যে পানির নামই ‘পানি’ থাকে না, যদিও দেখতে তরল

যেমন: সাদা গুঁড়ো জাতীয় বা ভেষজ দ্রব্য (যেমন—লিকোরিস/মুলেঠি) মিশে গেলে পানির নাম হয়ে যায় অন্যকিছু। যদিও তা তরল থাকে, তবুও তা ‘পানি’ হিসেবে গণ্য হয় না, তাই অজু বা গোসল বৈধ নয়।

চতুর্থত: নাপাক পানি (الماء المتنجس)

নাপাক পানি দুই প্রকার:

ক. প্রবাহিত পানি (الماء الجاري)

এটি এমন পানি—যাকে মানুষ সাধারণভাবে প্রবাহিত পানি মনে করে। আরেক মত হলো: যেটি একটি খড়কুটো বহন করে নিতে পারে।

এ ধরণের পানি তখনই নাপাক হয়, যখন এর রঙ, গন্ধ বা স্বাদ—এই তিনটির যেকোনো একটিতে পরিবর্তন ঘটে কোনো অপবিত্র জিনিসের কারণে।

হাম্মামের পানির হাউস (ট্যাংকি বা চৌবাচ্চা) প্রবাহিত হিসেবে ধরা হয়—যদি কল ও ড্রেন খোলা থাকে, পানি প্রবাহমান থাকে, এবং পানি চলমান অবস্থায় তুলে ব্যবহার করা হয়। এতে পানি স্থির হয় না।

খ. স্থির পানি (الماء الراكد)

এটি দুই ভাগে বিভক্ত:

১. অল্প পরিমাণ পানি

এই পানি—যদি এতে কোনো অপবিত্র বস্তু পড়ে, তবে তা নাপাক হয়ে যায়—even যদি তার কোনো চিহ্ন (গন্ধ, রঙ, স্বাদ) না-ও দেখা যায়। কারণ, আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“তোমাদের কেউ যেন এমন পানিতে প্রস্রাব না করে যা স্থির, যা প্রবাহিত হয় না; তারপর সেখান থেকে গোসল করে।” 📚 (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

তবে এই পানি পবিত্র করা যায়—যদি তাতে পবিত্র পানি ঢেলে এমন পর্যায়ে নেওয়া হয় যে, তা প্রবাহিত হয়ে যায় এবং আর তাতে অপবিত্রতার চিহ্ন না থাকে।

২. বেশি পরিমাণ পানি

এটি এমন পানি—যার এক প্রান্ত না নাড়ালে অন্য প্রান্ত নড়ে না; অর্থাৎ পানি এত বেশি যে তা স্থির অবস্থায় থাকে।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন,

এটি ব্যবহারকারীর উপলব্ধি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।

হানাফি উলামাগণ এটি পরিমাপ করেছেন এমনভাবে:

  • দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ—প্রতিটি ১০x১০ কিরবাস হস্ত (ধরন) দ্বারা,
  • যা প্রায় ৪৯ বর্গমিটার পানির পৃষ্ঠ (surface area)।
  • গভীরতা এমন হবে যে—অঞ্জলি দিয়ে তুলে দেখলে নিচের মাটি দেখা যাবে না।

এই ধরণের পানির হুকুম হলো: এটি নাপাক হবে না যতক্ষণ না কোনো একটি বৈশিষ্ট্যে (রং, গন্ধ, স্বাদ) পরিবর্তন আসে। তবে যদি অপবিত্রতা দৃশ্যমান হয়, তাহলে তার সেই অংশ বাদ দিয়ে অন্য জায়গা থেকে অজু বা গোসল করতে হবে।

পঞ্চম: সন্দেহযুক্ত পবিত্র পানি

এটি এমন পানি—যা কোনো এমন প্রাণীর মুখের অবশিষ্ট পানি (سؤر), যার গোশত খাওয়া নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে, যেমন:

  • গৃহপালিত গাধা,
  • খচ্চর, যার মা গাধী (হাঁটি-বাঁটি গাধা)।

হুকুম (বিধান)

ক. যদি এই প্রকার পানি এর চেয়ে বেশি পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির সাথে মিশে যায়, তবে এটি পবিত্র ও পবিত্রকরণে সক্ষম হয়ে যায়।

খ. যদি বিশুদ্ধ পানি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়, তাহলে এই পানি দিয়ে অজু বা গোসল করা জায়েজ নয়।
আর যদি কোনো বিশুদ্ধ পানি না থাকে, তাহলে এই পানি দিয়ে অজু করে এবং পরবর্তীতে তায়াম্মুম করতে হবে, কারণ এখানে পবিত্রতার ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

গ. এই পানি দিয়ে শরীর বা কাপড় থেকে অপবিত্রতা (নাপাকী) দূর করা জায়েজ।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x