জীবনের পথচলায় প্রিয়জনের উপস্থিতি আমাদের জন্য এক অপূর্ব আশীর্বাদ। তাদের হাসি, সাফল্য, আর সুস্থতা আমাদের হৃদয় জুড়ে আনন্দের ঝর্ণা প্রবাহিত করে। কিন্তু যখন তারা অসুস্থ হয়, তখন আমাদের মন দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায় আল্লাহর কাছে করা বিনম্র প্রার্থনা। ইসলামে দোয়ার গুরুত্ব অপরিসীম; দোয়া হলো বান্দার হাতে থাকা এক মহান অস্ত্র, যার মাধ্যমে সে প্রতিকূলতাকে জয় করার চেষ্টা করে। প্রিয় মানুষের সুস্থতার জন্য দোয়া করা শুধু আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ নয়, বরং তা ইমানদারের অন্তরের গভীরতম সৌন্দর্যেরও প্রতিফলন। এ লেখায় আমরা জানবো, কীভাবে প্রিয়জনের সুস্থতার জন্য দোয়া করা যায়, ইসলাম আমাদের এ বিষয়ে কী শিক্ষা দেয়, এবং কোন দোয়াগুলো আমাদের হৃদয় থেকে উচ্চারিত হতে পারে প্রিয় মানুষের আরোগ্যের আশায়।
প্রিয় মানুষের সুস্থতার জন্য দোয়া
দোয়া: ভালোবাসার নিঃশব্দ ভাষা
প্রিয় মানুষের জন্য আমাদের হৃদয়ে যে মমতা ও ভালোবাসা গাঁথা থাকে, তা কখনো কখনো ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যখন তারা অসুস্থতার সাথে সংগ্রাম করে, তখন সেই ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দর প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য দোয়া করা। দোয়া হলো এমন এক পবিত্র মাধ্যম, যার দ্বারা আমরা আমাদের অসহায়ত্বের ঘোষণা দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার করুণার দরজায় মাথা নত করি।
ইসলামে প্রিয়জনের সুস্থতার জন্য দোয়া করার গুরুত্ব
ইসলাম আমাদের শেখায়, মুসলিম ভাই বা বোনের জন্য অদৃশ্যভাবে দোয়া করা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। প্রিয় মানুষের সুস্থতার জন্য দোয়া করলে, একজন ফেরেশতা আমাদের জন্যও অনুরূপ দোয়া করে থাকেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি তার অনুপস্থিত কোনো মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করে, একজন ফেরেশতা বলে: আমিন এবং তোমার জন্যও অনুরূপ প্রার্থনা।” (মুসলিম, হাদিস: ২৭৩২)
এছাড়া অসুস্থ ব্যক্তির জন্য দোয়া করা সুন্নাত। রাসূল (সা.) অসুস্থ সাহাবীদের কাছে যেতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন।
প্রিয় মানুষের সুস্থতার জন্য কিছু সুন্দর দোয়া
প্রিয়জনের সুস্থতার জন্য নিচের দোয়াগুলো করা যেতে পারে:
১. অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রাসূল (সা.)-এর দোয়া:
أَسْأَلُ اللّٰهَ الْعَظِيْمَ، رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ، أَنْ يَشْفِيَكَ
উচ্চারণ: আসআলুল্লাহাল আজীম, রব্বাল আরশিল আজীম, আইয়্যাশফিয়াকা।
অর্থ: “আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যিনি মহান আরশের প্রতিপালক, তিনি যেন আপনাকে আরোগ্য দান করেন।” (তিরমিযি, হাদিস: ২০৮৩)
এ দোয়াটি সাতবার পাঠ করলে ইনশাআল্লাহ আরোগ্য লাভ হয়, যেমন হাদিসে এসেছে।
২. সাধারণভাবে সুস্থতার জন্য দোয়া:
اللّهُمَّ اشْفِهِ شِفَاءً تَامًّا عَاجِلًا لَا يُغَادِرُ سَقَمًا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাশফিহি শিফাআন তাাম্মান আাজিলান লা ইউগাদিরু সাকামান।
অর্থ: “হে আল্লাহ! তাকে এমন পরিপূর্ণ আর দ্রুত সুস্থতা দান করুন, যাতে কোনো ব্যাধি অবশিষ্ট না থাকে।”
৩. প্রিয়জনের জন্য সার্বিক মঙ্গল ও সুস্থতার দোয়া:
اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ، أَذْهِبِ الْبَاسَ، اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي، لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা রাব্বান্ নাস, আযহিবিল বাস, ইশফি আনতাশ শাফি, লা শিফা’ ইল্লা শিফাউক, শিফাউন লা ইউগাদিরু সাকামা।
অর্থ: “হে মানুষের রব! ব্যথা দূর করে দিন, তাকে আরোগ্য দান করুন। আপনিই হচ্ছেন আরোগ্যদাতা। আপনার আরোগ্য ছাড়া কোনো আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দান করুন যাতে কোনো ব্যাধি অবশিষ্ট না থাকে।” (বুখারি, হাদিস: ৫৩৫১)
প্রিয়জনের সুস্থতার জন্য দোয়া করার সাথে সাথে করণীয় কিছু আমল
- তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা): মনে রাখা উচিত, সুস্থতা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। তাই চিকিৎসার পাশাপাশি দোয়া ও ভরসা দুটিই একসঙ্গে করতে হবে।
- সাদাকা প্রদান করা: অসুস্থতার বিপদ থেকে মুক্তির জন্য সদকা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসূল (সা.) বলেছেন: “সদকা রোগ নিরাময় করে।” (সহীহুল জামে, হাদিস: ৫১০৬)
- কুরআন তিলাওয়াত ও রুকিয়া করা: সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস পাঠ করে ফুঁ দেওয়া সুন্নাত।
- সবর ও ধৈর্য ধারণ: প্রিয়জনের অসুস্থতার সময় ধৈর্য ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধৈর্যের জন্য আল্লাহ তায়ালা বিশাল প্রতিদান রাখেন।
কিছু বাস্তব উদাহরণ
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুস্থ সাহাবীদের জন্য দোয়া করতেন
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির কাছে যেতেন, তিনি তাঁর হাত আক্রান্ত স্থানে রাখতেন এবং দোয়া করতেন:
“হে আল্লাহ! মানুষের রব! এই ব্যথা দূর করে দাও, আরোগ্য দাও। আপনিই একমাত্র আরোগ্যদানকারী। আপনার শেফা ছাড়া আর কোনো আরোগ্য নেই। এমন শেফা দান করুন যাতে কোনো ব্যাধি অবশিষ্ট না থাকে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩৫১)
➔ এই দোয়া তিনি অনেক সাহাবীদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে পাঠ করতেন, বিশেষ করে যারা কঠিন অসুস্থতায় আক্রান্ত হতেন।
২. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর সুস্থতার জন্য রাসূল (সা.)-এর দোয়া
এক যুদ্ধে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন রাসূল (সা.) তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন:
“হে আল্লাহ! সা’দকে সুস্থতা দান করো, তার কর্মকে উত্তম করো এবং তার তীর নিক্ষেপকে সফল করো।”
➔ পরবর্তীতে সা’দ (রা.) সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং মুসলিম সেনাবাহিনীর একজন বিখ্যাত যোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হন।
৩. রাসূল (সা.)-এর নিজের পরিবারের জন্য দোয়া
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্যও দোয়া করতেন। যেমন, যখন হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.) ছোট ছিলেন, তিনি তাদের মাথায় হাত রেখে দোয়া করতেন:
“আমি তোমাদেরকে আল্লাহর পরিপূর্ণ শব্দসমূহের মাধ্যমে সকল শয়তান, বিষাক্ত জন্তু ও কুদৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩৭১)
➔ এই দোয়া শুধু অসুস্থতার জন্য নয়, বরং শারীরিক ও আত্মিক নিরাপত্তার জন্যও একটি চমৎকার দোয়া।
৪. একবার রাসূল (সা.) নিজে অসুস্থ হলে জিবরাইল (আ.) এসে তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন জিবরাইল (আ.) এসে দোয়া করেছিলেন:
“হে মুহাম্মদ! আমি আল্লাহর নামে তোমাকে ঝাড়ফুঁক করছি; তিনি তোমাকে সব কষ্ট থেকে আরোগ্য দান করুন, সমস্ত শত্রুতা ও কুদৃষ্টি থেকে তোমাকে রক্ষা করুন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২১৮৬)
➔ এটি প্রমাণ করে, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ নবীকেও আল্লাহর করুণা চেয়ে দোয়া করা হয়েছে।
৫. সাহাবীরা অসুস্থ আত্মীয়-স্বজনের জন্য রাসূল (সা.)-এর কাছে দোয়ার অনুরোধ করতেন
অনেক সাহাবী তাঁদের অসুস্থ সন্তান বা আত্মীয়দের নিয়ে রাসূল (সা.)-এর কাছে আসতেন এবং তাঁর কাছে দোয়ার অনুরোধ করতেন। রাসূল (সা.) তখন তাদের জন্য দোয়া করতেন এবং কখনো কখনো পানি পড়ে দিতেন, কখনো হাত রেখে ঝাড়ফুঁক করতেন।
দোয়া করার শিষ্টাচার ও পদ্ধতি
➔ ১. আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ পাঠ করে শুরু করা
দোয়া শুরুতে আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা করা এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর দরুদ পাঠ করা।
➔ ২. হাত তুলে দোয়া করা
দোয়ার সময় দুই হাত উঠিয়ে বিনয়ের সাথে প্রার্থনা করা।
➔ ৩. আন্তরিকভাবে দোয়া করা
পূর্ণ মনোযোগ ও হৃদয়ের গভীরতা থেকে চাওয়া।
➔ ৪. দোয়া নির্দিষ্ট করে করা
সরাসরি ও স্পষ্ট ভাষায় প্রয়োজনীয় বিষয়ের জন্য দোয়া করা।
➔ ৫. তাওসুল করা (সুপারিশ করা)
আল্লাহর নাম, গুণ, অথবা নিজের সৎ আমলের মাধ্যমে দোয়া আরও গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা।
➔ ৬. বারবার ও দৃঢ়ভাবে দোয়া করা
একটি দোয়া তিনবার করে চাওয়া সুন্নাত।
➔ ৭. দোয়া কবুলের আশা এবং নম্রতা রাখা
আল্লাহর করুণা ও দয়া প্রত্যাশা করে দোয়া করা, নিরাশ না হওয়া।
উপসংহার
প্রিয় মানুষের জন্য দোয়া করা শুধু একটি ইবাদত নয়, বরং তা আমাদের ভালোবাসার প্রগাঢ় প্রকাশ। দোয়ার মাধ্যমে আমরা তাদের মঙ্গলের জন্য আসমানের দরজায় কড়া নাড়ি। মনে রাখতে হবে, দোয়া কখনো বিফলে যায় না; হয় আল্লাহ দোয়া কবুল করেন, অথবা আরও উত্তম কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন, অথবা কোনো অনিষ্ট দূর করে দেন। তাই আমাদের উচিত, প্রিয় মানুষের সুস্থতার জন্য নিয়মিত ও আন্তরিকভাবে দোয়া করা, তাদের পাশে থাকা এবং সবকিছুর আগে ও পরে আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।