বাই সালাম কি? তার শর্ত ও বিস্তারিত আলোচনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় “বাই সালাম” (Bay’ Salam) একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রচলিত। এটি এমন একটি বাণিজ্য চুক্তি, যেখানে ক্রেতা পণ্যের মূল্য আগাম প্রদান করে এবং বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইসলামের অর্থনৈতিক নীতিমালায় এটি একটি বৈধ এবং হালাল বাণিজ্য প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রবন্ধে, আমরা বাই সালাম কি? এর সংজ্ঞা, বৈধতা, শর্তাবলী, প্রয়োজনীয়তা এবং এর সাথে সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো।

বাই সালাম কি । সংজ্ঞা

বাই সালামের সংজ্ঞা: বাই সালামের সংজ্ঞায় বলা হয়,

السلم أو السلف : بيع آجل بعاجل، أو بيع شيء موصوف في الذمة أي أنه يتقدم فيه رأس المال، ويتأخر المثمن لأجل،

‘বাই সালাম হলো নগদের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রয়। বা নির্দিষ্ট গুণবাচক কোনো বস্তু বিক্রয় আবশ্যক করে নেওয়া। অথাৎ সেখানে মূলধন আগে আদায় করে দেওয়া হয় আর পণ্য পরবর্তীতে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা হয়। (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু : ৪/৩৬৯)

বাই সালামের শর্ত

আইম্মায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে ছয়টি শর্তের ভিত্তিতে বাইয়ে সালাম শুদ্ধ হবে। সেই শর্তগুলো হলো, পণ্যের প্রকার জানা থাকা, গুণ জানা থাকা, পরিমাণ জানা থাকা, সময় নির্ধারিত থাকা, রাসুল মালের পরিমাণ নির্ধারিত থাকা, মালামাল হস্তান্তরের স্থান নির্দিষ্ট থাকা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম মতবিরোধ করেছেন। নিচে হানাফি মাযহাব মতে একটু বিস্তারিত আলোচনা করছি।

রা’সুল মালের ( মূলধনের) সাথে সম্পর্কীত শর্তাবলি

  • এক: রা’সুল মালের প্রকার জানা থাকা। তা টাকা হবে, নাকি সোনা-রূপা হবে, নাকি চাল গম ডাল হবে, নাকি লোহা কাপড় হবে ইত্যাদি নির্ধারণ করা। যেহেতু সালাম হচ্ছে ক্রয় বিক্রয় চুক্তি তাই মুদ্রা ও তার গুণগতমান নির্দিষ্ট হতে হবে। যাতে ঝগড়ার অবকাশ বাকি না থাকে।
  • দুই: রা’সুল মালের পরিমাণ উল্লেখ থাকা। চাই তা ওজন হিসাবি বস্তু হোক বা সংখ্যা হিসাবি বস্তু হোক। কাজেই অনির্দিষ্টভাবে যদি বলা হয় এই চালের স্তুপ বা এই টাকার বান্ডিলের বিনিময়ে সালাম করবো তাহলে তা শুদ্ধ হবে না।
  • তিন: রা’সুল মাল তাৎক্ষণিক আদায় করে দেওয়া এবং বিক্রেতার হস্তগত হয়ে যাওয়া। যদি চুক্তির সময় রা’সুল মাল আদায় করা না হয় তাহলে এই চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। কেননা রাসুল মাল বাকিতে আদায় কারার শর্ত রাখা হলে পণ্য ও তার মূল্য উভয়টি বাকি হয়ে যাবে। আর বাকির বিনিময়ে বাকি ক্রয় বিক্রয় করা বৈধ নয়।

সালামের পণ্যের সাথে সম্পর্কীত শর্ত

  • এক: পণ্যের জাত জানা থাকা। যেমন ধান বা গম বা কাপড় বা জুতা ইত্যাদি নির্দিষ্ট থাকা।
  • দুই: পণ্যের প্রকার জানা থাকা। যেমন ইরি ধান বা বুরো ধান বা পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানী জানা থাকা।
  • তিন: তার গুণগতমান জানা থাকা। যেমন তা হাই কোয়ালিটির হবে না কি মিডিয়াম বা নরমাল কোয়ালিটির হবে তা জানা থাকা।
  • চার: পরিমাণ নির্ধারিত থাকা। ওজনি বস্তু হলে কতো কেজি, সংখ্যা হিসাবি হলে বিশেষ সংখ্যা, গজ হিসাবি হলে কতো গজ হবে তা নির্দিষ্ট থাকা। যাতে পণ্যের মধ্যে কোনো ধরণের অস্পষ্টতা না থাকে। যা বিবাদের দিকে ধাবিত করবে।
  • পাঁচ: পণ্য এমন হওয়া যা নির্দিষ্ট করার দ্বারা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তাই পণ্য যদি এমন হয় যা নির্দিষ্ট করলে অবিকল সেই পণ্য নির্দিষ্ট হবে না যেমন দিরহাম দিনার টাকা, তাহলে এর উপর সালাম হবে না।
  • ছয়: পণ্য বাকিতে আদায়ের শর্ত থাকতে হবে। কেননা সালাম হচ্ছে বাকিতে পণ্য আদায় করার নাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালামকে বাকির সাথে শর্তযুক্ত করে দিয়েছেন। তাই সালামে পণ্য বাকিতে আদায় পাওয়া যেতে হবে।
  • সাত: সালামের পণ্য চুক্তির সময় থেকে আদায় করা পর্যন্ত তার প্রকার কোয়ালিটি ও গুণগতমান সহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারে বিদ্যমান থাকা। অর্থাৎ পণ্য এমন না হওয়া তার প্রচলন বা মওজুদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
  • আট: পরিবহন ব্যয় রয়েছে এমন পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্য কোন স্থানে হস্তান্তর করা হবে তা নির্দিষ্ট করা। যাতে পরিবহন ভাড়া বা এক শহর থেকে অন্য শহরে পণ্য আনার সরকারি ট্যাক্স ইত্যাদি খরচ নিয়ে বিবাদের অবকাশ না থাকে। (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু – ৪/৩৬০-৩৬৮/ আল হিদায়া : ৩/১৪৩-১৪৪)

বাই সালামের বৈধতা

বাই সালাম ইসলামি শরিয়াহর আলোকে একটি বৈধ চুক্তি। এটি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা অনুমোদিত।

কুরআনের ভিত্তি

“হে মুমিনগণ! তোমরা যখন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ লেনদেন কর, তখন তা লিখে নাও।” (সূরা আল-বাকারা: ২৮২)

বাই সালাম এর কুরআনিক ভিত্তি
বাই সালাম এর কুরআনিক ভিত্তি

হাদিসের ভিত্তি

ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আসেন, তখন মদিনার অধিবাসীরা সালামের মাধ্যমে ফলমূল অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয় করতো। তিনি তাদেরকে বললেন, ‘যারা সালাম চুক্তি করে, তারা ওজন, মাপ এবং নির্ধারিত সময় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখবে।’” (সহিহ বুখারি: ২২৪০)

বাই সালামের সুবিধা

১. কৃষকদের জন্য সহায়ক

  • কৃষকরা আগাম মূলধন পেয়ে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে।

২. বিনিয়োগের সুযোগ

  • বিনিয়োগকারীরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাদের পণ্য নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন।

৩. বাজার স্থিতিশীলতা

  • আগাম চুক্তি করার মাধ্যমে বাজারে সরবরাহের নিশ্চয়তা তৈরি হয়।

৪. ধার ও সুদের বিকল্প

  • এটি সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থার একটি কার্যকর বিকল্প।

বাই সালামের চ্যালেঞ্জ

১. পণ্য সরবরাহে বিলম্ব

  • বিক্রেতা নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

২. মান নিয়ন্ত্রণ

  • পণ্যের গুণগত মান নির্ধারিত না থাকলে বিরোধের সম্ভাবনা থাকে।

৩. অবিশ্বাস

  • চুক্তির দুই পক্ষের মধ্যে যদি বিশ্বাসের অভাব থাকে, তবে এটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা কঠিন।

আরো পড়ুন:

সাধারণ প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১: বাই সালাম কি শুধুমাত্র কৃষি পণ্যের জন্য প্রযোজ্য?

উত্তর: না, বাই সালাম কৃষি পণ্য ছাড়াও যেকোনো নির্ধারিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে এটি এমন পণ্যের জন্য হতে হবে যা সাধারণত বাজারে পাওয়া যায়।

প্রশ্ন ২: যদি বিক্রেতা সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কী হবে?

উত্তর: বিক্রেতা যদি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তবে ক্রেতার অর্থ ফেরত পাওয়ার অধিকার রয়েছে। প্রয়োজনে চুক্তি বাতিল করা যায়।

প্রশ্ন ৩: বাই সালাম কি ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ব্যবহৃত হয়?

উত্তর: হ্যাঁ, ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বাই সালাম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এটি মূলত কৃষি ও শিল্প খাতে অর্থায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়।

প্রশ্ন ৪: এই চুক্তি কি সুদের মতো মনে হয় না?

উত্তর: না, বাই সালাম সুদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে মূলধন বিনিয়োগ করা হয় এবং লাভ বা ক্ষতির অংশীদার হওয়া যায়।

প্রশ্ন ৫: বাই সালাম চুক্তি কি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে?

উত্তর: সাধারণত এটি স্বল্পমেয়াদি চুক্তি হিসেবে পরিচিত, তবে চুক্তির সময়কাল দুই পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হতে পারে।

উপসংহার

বাই সালাম একটি ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা পণ্যের আগাম মূল্য প্রদান এবং নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করে। এটি একদিকে যেমন ক্রেতাকে সুবিধা দেয়, তেমনি বিক্রেতার জন্যও মূলধনের ব্যবস্থা করে। তবে, এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে নির্ধারিত শর্তাবলী ও নীতিমালা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামী অর্থনীতিতে বাই সালামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও প্রাসঙ্গিক। যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থার একটি কার্যকর উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।


পোস্টটি শেয়ার করুন