মহিলাদের সিজদা করার নিয়ম নিয়ে দুটি মত বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রয়েছে। তবে এই দুটি মতের কোনটি সঠিক তা বুঝতে হলে এই মতামতের ভিত্তি বা দলিলগুলো আলোচনা আবশ্যক। আমরা এই পোস্টে উক্ত বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
সিজদার অঙ্গ সাতটি
সকল মাযহাব ও ইমামদের ঐক্যমতে সাতটি অঙ্গ নামাজের স্থানে লাগিয়ে সিজদা করতে হবে:
- কপাল।
- নাক।
- উভয় হাতের তালু।
- উভয় হাঁটু।
- উভয় পায়ের আঙ্গুলের মাথা।
কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘আমাকে আদেশ করা হয়েছে সাতটি অঙ্গের ওপর সিজদা করতে।
তবে পুরুষ ও মহিলার সিজদার ধরণ কী রকম হবে তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। আমার নিম্নে তাদের অভিমতগুলো আলোচনা করছি।
প্রথম অভিমত: মহিলাদের ও পুরুষের সিজদা করার নিয়ম এক ও অভিন্ন
পুরুষ এবং মহিলাদের সিজদা একই পদ্ধতিতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ পুরুষ এবং মহিলাদের নামাজের কোনো পার্থক্য বর্ণনা করেননি।
পদ্ধতি:
- কপাল, নাক, দুই হাত, দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের আঙ্গুল মাটিতে রাখতে হবে।
- সিজদায় যাওয়ার পর হাত শরীর থেকে আলাদা করে রাখতে হবে (যেমন: কনুই মাটিতে ঠেকবে না)।
- পেট উরু থেকে একটু দূরে থাকবে।
- পায়ের আঙ্গুল মাটির দিকে খাড়া থাকবে।
দ্বিতীয় অভিমত: মহিলা ও পুরুষের সিজদায় পার্থক্য রয়েছে
মহিলাদের সিজদার সময় শরীর সঙ্কুচিত রাখা উচিত, যেন এটি আরও শালীন এবং পর্দানুযায়ী হয়।
পদ্ধতি:
- সিজদার সময় হাত কাঁধ বা শরীরের কাছাকাছি রাখা।
- পেট উরুর সাথে লেগে থাকবে এবং কনুই মাটিতে রাখা যাবে।
- পায়ের পাতা একপাশে রেখে বা মাটির সাথে সোজা রেখে সিজদা করা।
- শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যতটা সম্ভব গুটিয়ে রাখা, যেন তা শালীন দেখায়।
উভয় মতের মধ্যে মূল পার্থক্য
বিষয় | প্রথম মত (কোনো পার্থক্য নেই) | দ্বিতীয় মত (শালীনতার জন্য ভিন্ন) |
---|---|---|
শরীরের ভঙ্গি | পেট ও হাত আলাদা থাকবে | পেট উরুর সাথে লাগানো থাকবে |
কনুই | মাটিতে ঠেকবে না | কনুই মাটিতে ঠেকানো যাবে |
পায়ের অবস্থান | পা মাটির সাথে সোজা থাকবে | পা একপাশে রাখা যাবে |
উদ্দেশ্য | পুরুষ ও মহিলার জন্য একই পদ্ধতি | মহিলাদের জন্য শালীনতা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত |
প্রথম অভিমত প্রমাণকারী রেফারেন্স
মহিলাদের নামাজ পুরুষের নামাজের মতো। এই বিষয়ে হাদিস ও ইমামদের মন্তব্য:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
صلوا كما رأيتموني أصلي
“তোমরা যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো, সেইভাবে নামাজ পড়ো।” (বুখারি)
এই হাদিসটি পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নামাজের সকল পদ্ধতি, সিজদা, বসা এবং অন্যান্য দিকের মধ্যে পুরুষ-মহিলার জন্য কোনো পার্থক্য নেই।
শায়খ আলবানি (রহ.) বলেছেন:
“নবী (ﷺ) থেকে নামাজের যে পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে, তা পুরুষ এবং মহিলা সকলের জন্য একই। হাদিসে মহিলাদের জন্য আলাদা কোনো নির্দেশনা নেই, বরং ‘তোমরা যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো, সেভাবে নামাজ পড়ো’ — এই সাধারণ নির্দেশনা মহিলাদেরও অন্তর্ভুক্ত।” (কিতাব: সিফাতু সালাতিন-নাবি : ইসলামকিউএ ডট ইনফো)
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
إنما النساء شقائق الرجال”
‘নারীরা হচ্ছে পুরুষদের সহোদর।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, দারেমি)
এযদিও কিছু স্কলার এই হাদিসের যঈফ (দুর্বল) হিসাবে উল্লেখ করেছেন, তবে এর মূল বক্তব্য হল, নারীরা পুরুষের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং সমান, বিশেষ করে ইসলামি বিধান পালনে।
এ বিষয়ে আল-খাত্তাবি বলেছেন:
ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে, যখন কোনো নির্দেশনায় সাধারণভাবে পুরুষদের সম্বোধন করা হয় তখন তা সাধারণত মহিলাদের জন্যও প্রযোজ্য। তবে যদি কোনো বিশেষ প্রমাণ (দলিল) দ্বার মহিলাদের আলাদা করা হয় তাহলে ভিন্ন কথা।
দ্বিতীয় অভিমতের রেফারেন্স
আল-বায়হাকি ( রাহি.) বলেছেন:
এই অভিমতের পক্ষে দুটি দুর্বল হাদিস বর্ণিত রয়েছে, যেগুলো দ্বারা প্রমাণ পেশ করা যায় না।
তৃতীয় হাদিস:
عن يزيد بن أبي حبيب ، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال : ( إذا سجدتما فضمَّا بعض اللحم إلى الأرض ؛ فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل )
ইয়াযিদ ইবন আবি হাবিব (রহ.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ দুইজন মহিলাকে নামাজ পড়তে দেখে বললেন: “যখন সিজদা করবে, তখন শরীরের কিছু অংশ মাটির সাথে ঘেঁষিয়ে রাখো, কারণ নারী এই বিধানে পুরুষের মতো নয়।” ( এই হাদিসটি আবু দাউদ (রহ.) “মারাসিল”-এ (১১৮ পৃষ্ঠা) এবং আল-বায়হাকি (২/২২৩) বর্ণনা করেছেন)
উভয় মতের রেফারেন্স পর্যালোচনা
আমরা দেখেছি প্রথম অভিমতটির পক্ষে শক্তিশালী দলিল রয়েছে। বিশেষত নারীরা সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তবে যদি স্পষ্ট কোনো দলিল দ্বারা তাদের ভিন্ন হুকুম দেওয়া হয় তাহলে ভিন্ন কথা।
অন্য পক্ষ থেকে নারীকে সিজদায় শরীর লাগিয়ে থাকতে হবে, অর্থাৎ সে তার পেটকে উরুর সাথে লাগিয়ে রাখবে এবং উরুকে পায়ের সাথে, কারণ নারীর জন্য আড়াল করা উত্তম। এই মতটির পক্ষে শক্তিশালী কোনো দলিল নেই। তাই প্রথম অভিমত খন্ডনকারী কোনো দলিল না থাকার কারণে এটাই গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়ত: সিজদায় নারীর শরীর সংকোচিত রাখার পক্ষের যুক্তি ছিলো এটা তাদের হিজাবের জন্য অধিক উপযুক্ত। কিন্তু কোনো যদি মহিলা একা নামাজ পড়েন, সাধারণত মহিলা একা তার বাড়িতে নামাজ পড়েন। সেখানে পুরুষদের উপস্থিতি না থাকে তাহলে এই যুক্তিরও কোনো শক্তিমত্তা থাকে না। কেননা সেখানে পুরুষদের মত সিজদা করলে স্তন ঝুলে থাকলে কারো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। (ইসলাম কিউএ ডট ইনফো)
সঠিক নিয়ম
মহিলাদের সিজদা করার সঠিক নিয়ম হচ্ছে পুরুষদের মতোই তারা সবকিছু করবে। তারা রুকু অবস্থায় পিঠ সোজা করবেন, সিজদার সময় পেট উরুর সঙ্গে লাগিয়ে রাখবে না এবং উরু পায়ের সঙ্গে লাগিয়ে রাখবে না। সে সিজদার সময় শরীর প্রসারিত করবেন। তারা দুই সিজদার মধ্যবর্তী বসার সময় এবং প্রথম ও শেষ তাশাহুদের সময় হাঁটুভাজ করে বসবেন। এটাই সঠিক নিয়ম।
শাইখ আলবানী (রহ.) তাঁর “সিফাতু সালাতিন নাবী ﷺ” গ্রন্থের শেষে বলেছেন:
“নবী ﷺ থেকে বর্ণিত নামাজের পদ্ধতিগুলো পুরুষ ও নারীদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। হাদিসে এমন কোনো প্রমাণ নেই যা নারীদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা নির্দেশ করে। বরং নবী ﷺ এর এই সাধারণ বাণী, ‘তোমরা যেমন আমাকে নামাজ পড়তে দেখো, তেমনই নামাজ পড়ো‘ — এ বক্তব্য পুরুষ এবং নারীদের উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে।” (সিফাতুস সালাহ, পৃ. ১৮৯)
বিশেষ সর্কতা
নারীরা সিজদা করার উল্লেখিত দুটি নিয়ম হচ্ছে উত্তম এবং অনুত্তম নিয়ে, অর্থাৎ আলেমদের একটি পক্ষ মতামত দিয়েছেন যে, নারীরা যদি সিজদার সময় তাদের অঙ্গগুলো সংকুচিত রাখেন তাহলে এটি তাদের জন্য উত্তম। আর অপরপক্ষ বলেছেন নারীরা সিজদার সময় তাদের অঙ্গগুলো প্রসারিত করে রাখবেন। যেভাবে হাদিসে এসেছে।
কিন্তু অনেকে মনে করেন যদি নারীরা সিজদার সময় তাদের অঙ্গগুলো প্রসারিত করেন, সংকুচিত করে না রাখেন তাহলে তাদের নামাজ হবে না। আবার এর উল্টোও অনেকে মনে করেন, অর্থাৎ যদি নারীরা সিজদার সময় তাদের অঙ্গগুলো সংকুচিত করে রাখেন, প্রসারিত না করেন তাহলে তাদের নামাজ হবে না। এই ধারণা ভুল। এই উভয় নিয়মের যে কোন একটি নিয়মে সিজদা করে নিলে তাদের সিজদা আদায় হয়ে যাবে। নামাজও হবে এতে কারো দ্বিমত নেই।
সামাধান
নারীর নামাজের পদ্ধতি সম্পর্কে শরীয়তে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো: নারীরা পুরুষদের মতোই নামাজের সব বিধান পালন করবেন। কারণ হাদিসে এসেছে: “তোমরা যেমন আমাকে নামাজ পড়তে দেখো, তেমনই নামাজ পড়ো”। এই সাধারণ নির্দেশনার আওতায় নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান।
গৃহে নামাজের পদ্ধতি
যদি কোনো নারী নিজ গৃহে নামাজ আদায় করেন, যেখানে তাকে কোনো পুরুষ দেখতে পাচ্ছে না, তবে তিনি পুরুষদের মতো রুকু, সিজদা, এবং বসার অবস্থান পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করবেন। অর্থাৎ, সিজদায় পেট উরুর সঙ্গে লাগিয়ে রাখবেন না, উরু পায়ের সঙ্গে সংযুক্ত রাখবেন না এবং রুকুতে পিঠ সোজা রাখবেন। এটাই শক্তিশালী হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নারীদের জন্য আদর্শ নামাজের পন্থা।
জনসম্মুখে নামাজের পদ্ধতি
যদি কোনো নারী জনসম্মুখে, যেমন হারাম শরিফে, নামাজ আদায় করেন, তবে তিনি চাইলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিছুটা সংকুচিত রাখতে পারেন। কারণ এই অবস্থায় পুরুষদের মতো রুকু বা সিজদা করতে গেলে তার বুক বা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দৃশ্যমান হতে পারে, যা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এ অবস্থায় তিনি তার শরীর ঢেকে রাখতে অঙ্গসংকুচিত পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন।
অসুবিধাজনিত কারণে পরিবর্তন
গৃহে থাকলেও যদি কোনো নারী রুকু বা সিজদায় পুরুষদের মতো অবস্থান নিতে শারীরিক অস্বস্তি বা অসুবিধা (যেমন: শারীরিক অসুস্থতা, অতিরিক্ত ওজন, বা অন্যান্য কারণ) অনুভব করেন, তাহলে তার জন্যও অঙ্গ সংকুচিত করে নামাজ আদায় করা বৈধ। এটি ইসলামের সহজ পন্থার একটি অংশ এবং বিশেষ অবস্থায় শরীয়ত এ ধরনের সহজতাকে অনুমোদন করে।
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট
১. নারীর জন্য নামাজে অঙ্গসংকুচিত করা একটি বিকল্প পদ্ধতি, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
২. গৃহে থাকলে বা একান্তে নামাজ পড়লে শক্তিশালী হাদিস অনুযায়ী পুরুষদের মতো নামাজ আদায় করাই উত্তম।
৩. শারীরিক বা মানসিক কোনো অসুবিধা থাকলে ইসলামের সহজ পন্থার আলোকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা যায়।
৪. নারী ও পুরুষের মধ্যে নামাজের মূল পদ্ধতিতে কোনো ভিন্নতা নেই, তবে পরিস্থিতিভেদে প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কিছু পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।