মাখরাজ ১৭ টি । হরফ উচ্চারণে বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করুন

শেয়ার করুন

আরবি হরফ উচ্চারণের জন্য সঠিক মাখরাজের (উচ্চারণ স্থান) গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন তিলাওয়াত ও সালাতের সঠিকতা নির্ভর করে মাখরাজের শুদ্ধতার উপর। যারা কুরআন পাঠ করেন তাদের জন্য মাখরাজ জানা অপরিহার্য। মাখরাজ ১৭ টি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে এই ব্লগপোস্টে।

মাখরাজ কী?

আরবি প্রতিটি অক্ষরের উচ্চারণ স্থানকে মাখরাজ বলে, অর্থাৎ যেখান থেকে অক্ষরটি উচ্চারিত হয়। কুরআনে প্রতিটি অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারণ করা আবশ্যক, কারণ উচ্চারণে ভুল হলে অর্থের পরিবর্তন হতে পারে।

আরো পড়ুন:

কেন মাখরাজ ১৭ টি?

মাখরাজ ১৭ টি উচ্চারণ স্থানকে বোঝায় যেখান থেকে ২৮টি আরবি অক্ষর উচ্চারিত হয়। এই ১৭টি স্থান বিভিন্ন অংশে বিভক্ত, যা সঠিক উচ্চারণ নিশ্চিত করে।

১৭ টি মাখরাজের বিবরণ । বিস্তারিত ব্যাখ্যা

আরবি ভাষায় প্রতিটি অক্ষরের উচ্চারণের সঠিক স্থান হিসাবে মাখরাজের ১৭টি স্থানকে প্রধানত পাঁচটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগের অধীনে নির্দিষ্ট সংখ্যা ও স্থান থেকে আরবি অক্ষর উচ্চারিত হয়। এখানে প্রতিটি মাখরাজ স্থান এবং সেখান থেকে উচ্চারিত অক্ষর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. জওফ (গলা এবং বক্ষ)

জওফ হলো মাখরাজের প্রথম বিভাগ, যা মূলত গলা এবং বক্ষের মধ্যে অবস্থিত। এই স্থান থেকে তিনটি বিশেষ বর্ণ উচ্চারিত হয়। এই তিনটি বর্ণকে হুরুফুল মদ্দাহ বা মদ্দের অক্ষর বলা হয়। এই বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় শ্বাসপ্রশ্বাসের উপর নির্ভরশীল।

  • আলিফ মাদ (ا): জওফের শ্বাসরন্ধ্রের উপর নির্ভর করে আলিফ মাদ উচ্চারিত হয়। এটি উচ্চারিত হয় যখন আলিফ শব্দের মাঝে বা শেষে আসে এবং তার আগে ফাতাহ থাকে।
  • ওয়াও মাদ (و): জওফের সাহায্যে ‘ওয়াও মাদ’ উচ্চারিত হয়। এটি উচ্চারণ করার সময় ঠোঁট গোলাকার হয় এবং শব্দের মাঝে বা শেষে আসে।
  • ইয়া মাদ (ي): ‘ইয়া মাদ’ উচ্চারণ করার জন্য জওফের উপর নির্ভর করতে হয়। এটি উচ্চারিত হয় যখন ইয়া শব্দের মধ্যে বা শেষে আসে এবং তার আগে কাসরা থাকে।

২. হালক (গলা)

হালক মাখরাজের দ্বিতীয় প্রধান বিভাগ, যা গলার মধ্যে অবস্থিত। গলা থেকে উচ্চারিত ছয়টি অক্ষর রয়েছে এবং এই অক্ষরগুলোকে হুরুফুল হালক বলা হয়। হালককে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে, যা হলো:

  1. অগভীর গলা (أقصى الحلق):
    • হামযা (ء): গলার গভীরতম অংশ থেকে উচ্চারিত হয়।
    • হা (ه): একইভাবে গলার গভীরতম অংশ থেকে উচ্চারিত হয়।
  2. মধ্যম গলা (وسط الحلق):
    • আয়িন (ع): গলার মধ্য অংশ থেকে উচ্চারিত হয়।
    • হা (ح): একইভাবে গলার মধ্য অংশ থেকে উচ্চারিত হয়।
  3. গলার শীর্ষ (أدنى الحلق):
    • গাইন (غ): গলার শীর্ষস্থান থেকে উচ্চারিত হয়।
    • খা (خ): একইভাবে গলার শীর্ষস্থান থেকে উচ্চারিত হয়।

৩. লিসান (জিহ্বা)

লিসান অর্থাৎ জিহ্বা থেকে উচ্চারিত হয় মাখরাজের সবচেয়ে বেশি অক্ষর। লিসানের বিভিন্ন অংশ থেকে ১০টি বর্ণ উচ্চারিত হয়, যা নিচে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:

  1. পিছনের জিহ্বা এবং তালুর উপরের অংশ:
    • ক্বাফ (ق): জিহ্বার পিছনের অংশ এবং তালুর উঁচু অংশের সাথে সংযোগ করে উচ্চারিত হয়।
    • কাফ (ك): একই স্থান থেকে উচ্চারিত হয়, কিন্তু কিছুটা সামনের দিকে।
  2. মধ্যম জিহ্বা:
    • জিম (ج): জিহ্বার মাঝখান থেকে উচ্চারিত হয়।
    • শীন (ش): একইভাবে উচ্চারিত হয়।
    • ইয়া (ي): একই স্থান থেকে উচ্চারিত হয়।
  3. জিহ্বার পার্শ্ববর্তী অংশ:
    • দাল (ض): জিহ্বার পার্শ্ব এবং উপরের দাঁতের মিলনে উচ্চারিত হয়।
  4. জিহ্বার আগের অংশ এবং সামনে দাঁত:
    • ল্যাম (ل): জিহ্বার সামনের অংশ এবং সামনের দাঁতের সাথে মিলিত হয়ে উচ্চারিত হয়।
    • নুন (ن): একইভাবে উচ্চারিত হয়।
    • রা (ر): একই স্থান থেকে উচ্চারিত হয়, তবে উচ্চারণে কম্পন থাকে।
  5. জিহ্বার আগের অংশ এবং দাঁতের সংযোগ:
    • ত (ت): জিহ্বার সামনের অংশ এবং সামনের দাঁতের মিলিত হওয়ার স্থান থেকে উচ্চারিত হয়।
    • দাল (د): একইভাবে উচ্চারিত হয়।
    • থা (ث): একই স্থান থেকে উচ্চারিত হয়, কিন্তু উচ্চারণে কিছুটা ভিন্নতা থাকে।

৪. শাফাতাইন (ঠোঁট)

শাফাতাইন অর্থাৎ ঠোঁট থেকে উচ্চারিত হয় চারটি বিশেষ বর্ণ। ঠোঁটের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এই বর্ণগুলো উচ্চারিত হয়।

  1. ওয়াও (و): ঠোঁট গোলাকার করে উচ্চারিত হয়।
  2. বা (ب): ঠোঁটের ওপরের এবং নিচের অংশের মিলনে উচ্চারিত হয়।
  3. মিম (م): একইভাবে উচ্চারিত হয়, কিন্তু ঠোঁটের সাথে নাকের কিছুটা ব্যবহার থাকে।
  4. ফা (ف): নিচের ঠোঁট এবং ওপরের দাঁতের সাথে মিলিত হয়ে উচ্চারিত হয়।

৫. খাইশুম (নাক)

খাইশুম অর্থাৎ নাক থেকে উচ্চারিত হয় মাখরাজের একটি বিশেষ বর্ণ।

  1. গুন্নাহ (غنة): এটি একটি বিশেষ নাসিকাধ্বনি যা সাধারণত নুন (ن) এবং মিম (م) এর উচ্চারণের সময় ঘটে। নাকের মধ্য দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের সাহায্যে এই ধ্বনি উচ্চারিত হয়, যা গুন্নাহ নামে পরিচিত।

মাখরাজের ভূমিকা

মাখরাজের মাধ্যমে প্রতিটি অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারণ করা সম্ভব হয়, যা কুরআনের সঠিক তিলাওয়াত এবং অন্যান্য ইসলামিক দোয়া এবং আমল এর শুদ্ধতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

কুরআন তিলাওয়াত এবং মাখরাজের সম্পর্ক

কুরআন তিলাওয়াতে শুদ্ধ উচ্চারণ অপরিহার্য। মাখরাজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে তিলাওয়াতের শুদ্ধতা বজায় রাখা সহজ হয় এবং অর্থ সঠিক থাকে।

১৭ টি মাখরাজে বিভক্ত অক্ষর

২৮টি আরবি অক্ষরকে এই ১৭টি মাখরাজ থেকে উচ্চারিত করা হয়। প্রতিটি অক্ষর একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে উচ্চারিত হয় যা তার সঠিক উচ্চারণ নির্ধারণ করে।

মাখরাজ শিখার উপায়

মাখরাজ শিখার জন্য উস্তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সর্বোত্তম উপায়। এছাড়া, অডিও ও ভিডিও রিসোর্স ব্যবহার করে নিজে নিজে অনুশীলন করাও উপকারী হতে পারে।

মাখরাজ শিখার গুরুত্ব

মাখরাজ সঠিকভাবে শেখা ইসলামিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া করা মাখরাজ জানার মাধ্যমেই সম্ভব।

মাখরাজ সম্পর্কে সাধারণ ভুল

অনেকেই মাখরাজ শিখার সময় ভুল করে থাকেন, যেমন: অক্ষরের সঠিক উচ্চারণ না জানা বা ভুল স্থান থেকে অক্ষর উচ্চারণ করা। সঠিকভাবে মাখরাজ শেখা এবং অনুশীলন এই ভুলগুলো সংশোধন করতে সাহায্য করে।

প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১: মাখরাজ ১৭ টি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর: মাখরাজ ১৭ টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এগুলো থেকে প্রতিটি আরবি অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারিত হয়, যা কুরআন তিলাওয়াতের শুদ্ধতার জন্য অপরিহার্য।

প্রশ্ন ২: মাখরাজ শিখতে কত সময় লাগে?

উত্তর: মাখরাজ শিখার সময় ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে কয়েক মাসের মধ্যে সঠিকভাবে মাখরাজ শিখা সম্ভব।

প্রশ্ন ৩: মাখরাজ শেখার জন্য কোন উস্তাদের কাছে যেতে হবে?

উত্তর: মাখরাজ শেখার জন্য একজন অভিজ্ঞ ক্বারী বা হাফিজের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সর্বোত্তম।

প্রশ্ন ৪: কি ভাবে মাখরাজের ভুল শুদ্ধ করা যায়?

উত্তর: মাখরাজের ভুল শুদ্ধ করতে হলে নির্দিষ্ট অক্ষরগুলোর সঠিক উচ্চারণ শিখা এবং নিয়মিত অনুশীলন করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন ৫: কোন অডিও বা ভিডিও রিসোর্স মাখরাজ শিখতে সহায়ক হতে পারে?

উত্তর: অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনেক ইসলামিক শিক্ষা সম্পর্কিত অডিও ও ভিডিও রিসোর্স আছে, যা মাখরাজ শিখতে সহায়ক হতে পারে।

প্রশ্ন ৬: বাচ্চাদের মাখরাজ শেখানোর উপায় কী?

উত্তর: বাচ্চাদের মাখরাজ শেখানোর জন্য তাদের সাথে খেলার ছলে শেখানো এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল রিসোর্স ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রশ্ন ৭: কি ভাবে মাখরাজ অনুশীলন করলে দ্রুত শিখা যায়?

উত্তর: মাখরাজ অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ধরে প্রতিটি অক্ষর উচ্চারণের অনুশীলন করা উচিত।

প্রশ্ন ৮: মাখরাজের সঠিকতা বজায় রাখার জন্য কী করা উচিত?

উত্তর: মাখরাজের সঠিকতা বজায় রাখতে নিয়মিত অনুশীলন এবং শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।

প্রশ্ন ৯: মাখরাজ শিখার জন্য কোন বইটি সবচেয়ে ভালো?

উত্তর: ‘তাজবিদুল কুরআন’ এবং ‘মাকামাতুল হুরূফ’ বইগুলো মাখরাজ শিখার জন্য ভালো রিসোর্স হতে পারে।

প্রশ্ন ১০: বড়দের জন্য মাখরাজ শিখা কঠিন কি?

উত্তর: বড়দের জন্য মাখরাজ শিখা কঠিন নয়, তবে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এটি সহজে শিখা সম্ভব।


শেয়ার করুন

Leave a Comment