মুদারাবা কাকে বলে? প্রকার । শর্ত । চুক্তিপত্র । হিসাব ও বিস্তারিত

পোস্টটি শেয়ার করুন

পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষের জীবনকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, আর দরিদ্র দিনদিন আরও দরিদ্র হচ্ছে। এর বিপরীতে, ইসলামিক অর্থনীতি অত্যন্ত কার্যকর। এই কারণেই ইসলামিক অর্থনীতির জনপ্রিয়তা ক্রমাগত বাড়ছে। মুদারাবা হল ইসলামিক অর্থনীতির একটি অনন্য মডেল। এই প্রবন্ধে মুদারাবা কাকে বলে? তার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি এটি মুদারাবা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী সকল পাঠকের জন্য উপকারী হবে।

মুদারাবা কাকে বলে?

মুদারাবার সংজ্ঞা: মুদারাবা বলা হয়- দুই বা তার অধিক ব্যক্তির মধ্যে নির্দিষ্টহারে লভ্যাংশ বণ্টনের শর্তে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। যেখানে একপক্ষ প্রদান করবে মূলধন আর অন্য পক্ষ দিবে শ্রম। ‘আল মুজামুল ওয়াসিত’ গ্রন্থে মুদারাবার সংজ্ঞায় বলা হয়:

(المضاربة) (في الشرع) عقد شركة في الربح بمال من رجل وعمل من آخر

অনুবাদ: শরিয়তের দৃষ্টিতে মুদারাবা হলো – কোনো একজন ব্যক্তির সম্পদ আর অন্যজনের শ্রমের বিনিময়ে লভ্যাংশে অংশীদারত্বমূলক চুক্তি। (আল মুজামুল ওয়াসিত, বাবু আদ-দোয়াদ – ১/৫৩৭)

মুদারাবা কাকে বলে
মুদারাবা কাকে বলে

মুদারাবাের প্রকার ও শর্তাবলি

ফুকাহায়ে কেরাম মুদারাবা বৈধ হওয়ার জন্য অনেক শর্ত উল্লেখ করেছেন। যার কিছু মুদারাবা চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা বা শব্দ প্রয়োগের সাথে সম্পর্কীত, কিছু চুক্তিকারীদের সাথে সম্পর্কীত, কিছু রা’সুল মাল বা মূলধনের সাথে সম্পর্কীত, কিছু ব্যবসার পদ্ধতির সাথে সম্পর্কীত, আবার কিছু মুনাফার সাথে সম্পর্কীত ইত্যাদি। প্রত্যেক ধরণের শর্তাবলি আলাদা আলাদা শিরোনামের অধীনে আলোচনা করছি।

মুদারাবা চুক্তিতে ব্যবহৃত ভাষার সাথে সম্পর্কীত শর্ত

মুদারাবা সংক্রান্ত আলোচনায় এমন শব্দ থাকতে হবে যা কেবল মুদারাবাকেই বুঝায়। তা অন্য অর্থের অবকাশ রাখে না। অর্থাৎ দ্ব্যর্থ অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার না করা। এই শব্দ বা ভাষার মাধ্যমে এক পক্ষ থেকে প্রস্তাব এবং অন্য পক্ষ থেকে তা কবুল সংঘটিত হবে।

যেমন রাব্বুল মাল মুদারিবকে বলবে, আমি তোমাকে এই অর্থ দিচ্ছি মুদারাবা ব্যবসা করার জন্য। অতপর মুদারিব তা গ্রহণ করবে। অথবা মুদারিব রাব্বুল মালকে বলবে আমাকে তুমি মুদারাবা ব্যবসা করার জন্য অর্থ দাও। অতপর রাব্বুল মাল এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে। কেননা একজন মানুষ অন্যজনকে অর্থ দেওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে।

তাই তাদের মধ্যে এই আর্থিক লেনদেন কী কারণে হচ্ছে তা সুস্পষ্ট থাকতে হবে। যাতে পরবর্তীতে বিবেদ সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ বাকি না থাকে। এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের মতামত উল্লেখ করে আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়:

” ذهب جمهور الفقهاء إلى أنه لا بد في المضاربة من الصيغة، وهي الإيجاب والقبول، وتنعقد بلفظ يدل على المضاربة“

অনুবাদ: ‘সংখ্যাগরিষ্ট ফিকাহবিদের নিকট মুদারাবার জন্য ভাষা (মুদারাবা সংক্রান্ত শব্দ প্রয়োগ) আবশ্যক। আর তা হলোÑ প্রস্তাব ও কবুল। এভাবে এমন কথার দ্বারাও মুদারাবা কার্যকর হবে যে কথা মুদারাবার অর্থ বহন করে।’ (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ : ৩৮/৪০)

মুদারাবা চুক্তিপত্র । চুক্তিকারীদের সাথে সম্পর্কীত শর্তাবলি

মুদারাবা চুক্তিকারী উভয় পক্ষ অর্থাৎ রাব্বুল মাল ও মুদারিবের মধ্যে এমন কিছু শর্ত থাকতে হয় যা মুদারাবা চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্য অপরিহার্য। যেমন রব্বুল মাল ও মুদারিবের মধ্যে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া ও প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা থাকা।

কেননা মুদারিব রাব্বুল মালের নির্দেশে ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে। যা রাব্বুল মালের পক্ষ থেকে মুদারিবকে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়ার অর্থ বহন করে। রাব্বুল মাল যেন একজন মুয়াক্কিল। তাই রাব্বুল মালের মধ্যে শর্ত আরোপ করা হবে, সে যেন এমন বৈশিষ্ট্যধারী হয় যার নিজের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য করার আহলিয়্যাত ( যোগ্যতা ) রয়েছে।

তাই পাগল বা অবোধ বাচ্চা মুদারিব নিয়োগ দিতে পারবে না। কেননা তাদের মধ্যে আকল না থাকার দরুন তারা নিজেরাই ব্যবসা বাণিজ্যের আহলিয়্যাতহীন অবস্থায় আছে। ঠিক তেমনিভাবে মুদারিবের মধ্যেও আকল থাকা শর্ত। কেননা মুদারিব উকিলের মতো। আর উকিলের মধ্যে আকল বা সুষ্ঠু বিবেক থাকা শর্ত। তাই পাগল বা অবুঝ বাচ্চা মুদারিব হতে পারবে না।

তবে বালেগ বা স্বাধীন হওয়া শর্ত নয়। তাই বুদ্ধিমান নাবালেগ বাচ্চা বা গোলাম ব্যক্তি রাব্বুল মাল বা মুদারিব হতে পারবে। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ : ৩৮/৪১-৪২)

অমুসলিম ব্যক্তির সাথে মুদারাবা করা যাবে কি না এ বিষয়ে ফিকাহবিদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হানাফি ও হাম্বলি মাযহাব মতে অমুলিম ব্যক্তির সাথে মুদারাবা করা যাবে। হানাফি আলেম কাসানি বলেন:

”لا يشترط إسلام رب المال أو المضارب، فتصح المضاربة بين أهل الذمة وبين المسلم والذمي والحربي المستأمن“

‘রাব্বুল মাল বা মুদারিব মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। তাই মুসলিম ও জিম্মি কাফের বা হারবি মুসতামিন কাফেরের মধ্যকার মুদারাবা শুদ্ধ হবে।’ (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ : ৩৮/৪১-৪২)

মূলধনের (রা’সুল মালের) সাথে সম্পর্কীত শর্তাবলি

রা’সুল মালের সাথে একাধিক শর্তারোপ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি শর্তকে আলাদাভাবে নিম্নে পেশ করা হলো।

প্রথম শর্ত: ফুকাহায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে রা’সুল মাল দিরহাম বা দিনার হতে হবে। অর্থাৎ রা’সুল মাল মুদ্রাজাতীয় হতে হবে। তাই বস্তুসামগ্রীকে রা’সুল মাল বানিয়ে মুদারাবা করা বৈধ নয়। এ ভাবে কোনো উপকার ভোগের সুযোগ দেওয়াকে রা’সুল মাল বানানো যাবে না। যেমন মুদারিবকে বলা হলো তুমি এই বাসা রা’সুল মাল হিসাবে নাও। অতপর তা ভাড়ায় খাটিয়ে যা লাভ করবে তা নির্দিষ্ট হারে আমাদের মধ্যে বণ্টন হবে।

দ্বিতীয় শর্ত: রা’সুল মাল নির্ধারিত থাকা। অর্থাৎ তার পরিমাণ, গুণাগুণ, প্রকার সবকিছু নির্দিষ্ট থাকা। যাতে অস্পষ্টতা দূর হয়ে যায় এবং ঝগড়ার দিকে ধাবিত হওয়ার অবকাশ না থাকে। সুতরাং রা’সুল মাল যদি নির্দিষ্ট না থাকে তাহলে মুদারাবা চুক্তি ফাসিদ বলে গণ্য হবে।

তৃতীয় শর্ত: রা’সুল মাল নগদ থাকতে হবে। সুতরাং রা’সুল মাল যদি বাকি থাকে তাহলে চুক্তি ফাসিদ হয়ে যাবে। রা’সুল মাল বাকি থাকার সুরত হলো যেমন রাব্বুল মালের কিছু পাওনা মুদারিবের কাছে আছে। তখন রাব্বুল মাল বললো তোমার হাতে আমার যে পাওনা রয়েছে তা মুদারাবা হিসাবে বিনোয়োগ করে নাও। মুনাফা যা হবে তার অর্ধেক তুমি আর অর্ধেক আমি নিবো।

রা’সুল মাল বাকি থাকার আরেকটি সুরত হলো যেমন রাব্বুল মাল মুদারিবকে বললো অমুকের কাছে আমার এতো টাকা পাওনা রয়েছে, তুমি এই টাকাগুলো উসুল করে মুদারাবা হিসাবে বিনিয়োগ করে নাও। এই সুরতটি শাফিয়ি হাম্বলি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকি ফুকাহায়ে কেরামের মতে জায়েজ নয়। তবে হানাফি এবং কিছু কিছু মালিকি ফিকাহবিদের মতে এই সুরতটি জায়েজ রয়েছে।

চতুর্থ শর্ত: রা’সুল মাল মুদারিবের হাতে অর্পণ করে দেওয়া। কেননা মুদারিব ব্যবসা বাণিজ্য করতে হলে তার হাতে টাকা থাকতে হবে। তাই রাব্বুল মাল যদি নিজের হাতে টাকা রেখে দিয়ে মুদারিবকে মুদারাবা করার কথা বলে বা রাব্বুল মাল নিজেও ব্যবসায় শামিল থাকবে বলে টাকা নিজের হাতে রেখে দেয়, তাহলে চুক্তি ফাসিদ হয়ে যাবে। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ : ৩৮/৪৩-৫০)

মুনাফার সাথে সম্পর্কীত শর্তাবলি

প্রথম শর্ত: রাব্বুল মাল ও মুদারিব মুনাফা থেকে কে কতো পার্সেন্ট ভাগ পাবে তা নির্দিষ্ট থাকা। কেননা মুদারাবার মধ্যে মূল চুক্তিই হয় মুনাফাকে কেন্দ্র করে। তাই মুনাফা কে কতো পাবে সেটা যদি অস্পষ্ট থাকে তাহলে চুক্তির মধ্যে ফাসাদ দেখা দেবে।

দ্বিতীয় শর্ত: মুনাফা থেকে রাব্বুল মাল ও মুদারিব কে কতো পাবে তা অংশ হিসাবে নির্ধারিত থাকা। যেমন অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ বা এক চর্তুথাংশ ইত্যাদি। কিন্তু যদি কোনো একটি পরিমাণ এক পক্ষের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া হয়, যেমন রাব্বুল মাল বা মুদারিব বললো, মুনাফা থেকে আমি এক হাজার নেওয়ার পর বাকি যা থাকবে সেগুলো তুমি নিবে, তাহলে চুক্তি ফাসিদ বলে গণ্য হবে।

কেননা হতে পারে সম্পূর্ণ মুনাফাই হবে এক হাজার। তখন এক পক্ষ সব মুনাফা নিয়ে যাবে আর অন্য পক্ষের ভাগে থাকবে শূন্য। অথচ মুদারাবা হলো মুনাফার মধ্যে রব্বুল মাল ও মুদারিবের মধ্যকার অংশীদারমূলক একটি চুক্তি। যে মুনাফা থেকে উভয় পক্ষ নির্দিষ্ট হারে অংশ পাওয়ার অধিকারী। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ ; ৩৮/৫৩-৫৫)

মুদারাবা বিনিয়োগ পদ্ধতি । ব্যবসাপন্থার সাথে সম্পর্কীত শর্তাবলি

ফুকাহায়ে কেরাম মুদারিবের মুদারাবা কর্ম শুদ্ধ হওয়ার জন্য মৌলিকভাবে কয়েকটি শর্তের কথা বলেছেন। যা বিদ্যমান থাকলে মুদারাবা শুদ্ধ হবে। অনথ্যায় ফাসিদ বলে গণ্য হবে। তা হলো, মুদারিবের কর্ম ব্যবসামূলক হতে হবে। রাব্বুল মাল মুদারিবকে ব্যবসার পন্থা সংর্কীণ করে দিতে পারবে না। মুদারিব চুক্তির দাবি পরিপন্থী কোনো কিছু করতে পারবে না। এই শর্তগুলো বিবেচনায় রেখে মুদারিবের কর্মকে চার প্রকারে ভাগ করা যায়।

প্রথম প্রকার: কোনো দিক নির্দেশনা ছাড়াই মুদারিবের যে সব ব্যবসাপন্থা অবলম্বন করা বৈধ। যেখানে রাব্বুল মাল মুদারিবকে কোন ধরণের ব্যবসা করবে, কোথায় করবে, কতো দিন পর্যন্ত করবে, কার সাথে করবে ইত্যাদি কিছুই ঠিক করে দেয়নি।

কেবল রাব্বুল মাল মুদারিবকে বলেছে আমার কাছ থেকে এই টাকা নিয়ে তুমি মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করো। লাভের এতো অংশ তুমি পাবে আর এতো অংশ আমি নিবো। এই প্রকার মুদারাবা চুক্তির ফলে মুদারিবের জন্য সর্বপ্রকার ব্যবসা করার এখতিয়ার থাকবে। অর্থাৎ সমাজে ব্যবসা বলতে যা বুঝায় তার সবকিছু সে করতে পারবে। তবে বাকিতে বিক্রয় করা বৈধ হবে কি না তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যদি অর্থ লোকসান হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে বৈধ না হওয়ার মতটিই প্রধান্য পাবে।

এভাবে এই সুরতে মুদারাবার অর্থ বা পণ্য নিয়ে মুদারিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে এক শহর থেকে অন্য শহরে সফর করতে পারবে কি না? তা নিয়ে সামান্য মতোবিরোধ থাকলেও গ্রহণযোগ্য অভিমত হলো সফর করতে পারবে। কেননা মুদারাবার অর্থই হলো সফর করা। আর সফর ছাড়া ভালো ব্যবসাও সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় প্রকার: মুদারিবের জন্য কেবল সেই কাজগুলোই করা বৈধ হবে যার উপর রাব্বুল মালের দিক নির্দেশনা রয়েছে। এই প্রকারের মধ্যে সে সব ব্যবসাপন্থা অন্তর্ভুক্ত থাকবে না যা স্বাভাবিকত ব্যবসাপন্থা বলে বিবেচিত হয় না। আর মুদারাবা চুক্তিও তাকে স্বার্বিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে না।

যেমন রাব্বুল মালের পক্ষ থেকে মুদারাবা হিসেবে প্রদত্ত অর্থ থেকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে মুদারিব যদি কোনো পণ্য কিনে নেয়, তাহলে অতিরিক্ত অর্থগুলো প্রদান করতে বা জামিন হতে রাব্বুল মাল বাধ্য থাকবে না। কেননা এই অতিরিক্ত অর্থ খরচের উপর রাব্বুল মালের অনুমতি নেই।

এভাবে মুদারিব যদি কোনো পণ্য ক্রয় করার সময় এমন অতিরিক্ত ঠকা খেয়ে বসে, যা স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য মানুষ খায় না, তাহলে এর দায়ও রাব্বুল মাল গ্রহণ করবে না। কেননা ব্যবসায় অল্প পরিমাণে ঠকা খাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে ঠকা খাওয়া অস্বাভাবিক।

অনুরূপভাবে মুদারিব যদি মুদারাবার অর্থের সাথে তার নিজের কিছু অর্থ বা অন্য কারো কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ যোগ করে নেয়, তাহলে এই অর্থগুলোর ব্যাপারে মুদারিব নিজে জামিন থাকবে। তার দায় রাব্বুল মাল বহন করবে না। কেননা এর উপর রাব্বুল মালের অনুমতি নেই।

তৃতীয় প্রকার: যেখানে মুদারিবকে কোনো দিক নির্দেশনা না দিয়ে কেবল বলা হয় তুমি বিবেক খাটিয়ে ব্যবসা করো। তখন মুদারিব মুদারাবার এই অর্থকে অন্যের কাছে মুদারাবা হিসাবে দিতে পরবে। অন্য কারো সাথে শরীক হয়ে ব্যবসা করতে পরবে। নিজের অর্থ যোগ করতে পারবে।

কিন্তু তোমার বিবেক খাটিয়ে ব্যবসা করো কথাটি বলা না হলে এর কোনোটিই বৈধ হতো না। তবে এই সুরতেও তার জন্য এমন কোনো কিছুই বৈধ নয়, যা সচরাচর সুষ্ঠু বিবেকবানরা করে না। যেমন অতিরক্তি ঠকা খাওয়া বা বাজার মূল্যের চেয়েও কম দামে পণ্য বিক্রি করে দেওয়া ইত্যাদি।

চতুর্থ প্রকার: যে কাজগুলো মুদারিবের জন্য মৌলিকভাবেই বৈধ নয়। ফুকাহায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে রক্ত, মৃত্যপ্রাণী, মদ ও শুকর ইত্যাদি শরিয়তে হারাম জিনিসের ব্যবসা করতে পারবে না। হারাম জিনিসের ক্রয় বিক্রয় ও তার থেকে অর্জিত মুনাফা সবকিছুই হারাম। তাই রাব্বুল মাল শর্ত করুক বা না করুক কোনোভাবেই তা ক্রয় বিক্রয় ও মুনাফা অর্জন করা বৈধ হবে না। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ : ৩৮/৫৫-৫৮)

যে সকল কারণে মুদারাবা বাতিল হবে । মুদারাবা চুক্তিকে ফাসিদকারী শর্তাবলি

এক: রাব্বুল মালও মুদারিবের সাথে মিলে ব্যবসা করবে বলে শর্ত করে নেওয়া। হানাফি, শাফিয়ি, মালিকি মাযহাব ও হাম্বলি মাযহাবের কিছু আলেমদের মতে এ রকম শর্ত করে নেওয়া হলে মুদারাবা চুক্তি ফাসিদ হয়ে যাবে। কেননা মুদারাবার মাল মুদারিবের হাতে আমানত হিসাবে থাকে। আর আমানত গ্রহীতার হাতে মাল হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত তা আমানত হিসাবে স্বীকৃতি পায় না।

তাই রাসুল মাল মুদারিবের হাতে সমর্পণ করার আগ পর্যন্ত মুদারাবা চুক্তি সম্পন্ন হবে না। রাব্বুল মাল মুদারিবের সাথে কাজ করবে বলে শর্ত করে নিলে রাসুল মাল মুদারিবের হাতে সমর্পণ পাওয়া যাবে না। কেননা এই সুরতে রাসুল মালের উপর রাব্বুল মালের হাত বাকি থেকে যায়। তাই চুক্তি ফাসিদ বলে গণ্য হবে।

দুই: কোনো এক পক্ষের জন্য লভ্যাংশ থেকে বিশেষ সংখ্যা গ্রহণের শর্ত করে নেওয়া। যেমন মুদারিব বা রাব্বুল মাল বললো লাভ্যাংশ থেকে আমি এক হাজার নেওয়ার পর বাকি যা থাকবে তা তুমি নিবে।

এরকম শর্ত ফাসিদ হওয়ার কারণ হলো অনেক সময় দেখা যাবে মুদারাবায় মুনাফাই হয়েছে এই পরিমাণ যা এক পক্ষের জন্য শর্ত করা হয়েছে। তখন সম্পূর্ণ লভ্যাংশ একজন নিয়ে যাবে আর অন্য জন খালি হাতে থাকতে হবে। অথচ মুদারাবা হলো লভ্যাংশে অংশীদারত্বমূলক একটি চুক্তি। যেখানে উভয় পক্ষের জন্য মুনাফা থেকে একটি অংশের মালিক হওয়া আবশ্যক।

তিন: মুদারিবের হাতে রাসুল মাল আমানত হিসাবে থাকা। কেননা মুদারিব হলো উকিলের মতো। তাই মুদারিবের অব্যবস্থাপনা বা গাফলতি ছাড়া যদি দুর্ঘটনা বশত মুদারাবার মাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় তাহলে মুদারিব তার ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাধ্য থাকবে না। সুতরাং রাব্বুল মাল যদি শর্ত করে নেয় যে, মুদারাবার মাল ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুদারিবকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। তাহলে চুক্তি ফাসিদ হয়ে যাবে।

তবে মাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে যদি মুদারিবের হাত থাকে, যেমন রাব্বুল মাল যে নিয়ম মেনে ব্যবসা করার শর্ত দিয়েছিল তা লঙ্গন করে বা তার পক্ষ থেকে গাফলতি বা কোনো অসাধু নীতি অবলম্বনের কারণে মাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ আদায় করবে। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ – ৩৮/৬২-৬৪)

কিছু শর্ত যা ফাসিদ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে

এক: মুদারাবাকে সময় বা অন্য কোনো শর্তের সাথে যুক্ত করে দেওয়া। এই বিষয়টি নিয়ে ফুকাহায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেক ফিকাহবিদ মুদারাবার সাথে সময় বা অন্য কোনো শর্তযুক্ত দেওয়াকে ফাসিদ বলে অবহিত করেছেন। কিন্তু হানাফি ও হাম্বলি মাযহাব মতে মুদারাবাকে নির্দিষ্ট সময় বা বিশেষ কোনো শর্তের সাথে যুক্ত করে দেওয়া শুদ্ধ আছে।

যেমন কেউ বললো – আমার এই দুই লক্ষ টাকা দিয়ে তুমি এক বছর পর্যন্ত মুদারাবা ব্যবসা করো। কেননা মুদারাবা হলো এমন একটি চুক্তি যা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর সাথে সম্পর্কীত। আর একটি পণ্য দ্বারা এক সময় লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকলেও অন্য সময় লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে।

তাই তার সাথে সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া বৈধ আছে। এ ভাবে মুদারাবার সাথে বিশেষ শর্তযুক্ত করে দেওয়া যাবে। যেমন রাব্বুল মাল মুদারিবকে শর্ত দিলো – চলমান মাস শেষে অমুক স্থান থেকে এই কোয়ালিটির পণ্য ক্রয় করতে হবে। তাহলে তা বৈধ হবে। কেননা ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুদারিব হলো রাব্বুল মালের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত উকিলের সমমান। তাই মুদারিবকেও শর্ত দেওয়া যাবে যেভাবে উকিলকে দেওয়া যায়।

দুই: রাব্বুল মাল বা মুদারিব একাধিক হওয়া। ফুকাহায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে একজন রাব্বুল মাল একাধিক মুদারিব নিয়োগ দিতে পারবে। সে প্রত্যেক মুদারিবকে আলাদা করে রাসুল মাল দিবে, তারা আলাদা আলাদাভাবে ব্যবসা করবে। এ ভাবে তাদের মধ্যে ঐক্যমত রয়েছে যে, যদি একজন রাব্বুল মাল একসাথে একাধিক মুদারিবের সাথে একই রাসুল মাল দ্বারা মুদারাবা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়,তাহলেও তা বৈধ হবে।

যেমন পাঁচ লক্ষ টাকা তিনজন ব্যক্তিকে দিয়ে বললো তোমরা তিনজন মিলে এই টাকা দ্বারা মুদারাবা ব্যবসা করো। লাভের অর্ধেক থেকে তোমরা সমানহারে বণ্টন করে নিবে আর বাকি অর্ধেক আমি নিবো। তাহলে চুক্তি বৈধ হবে, রাসুল মাল দ্বারা মুদারিবরা সম্মিলিতভাবে ব্যবসা করার অধিকার লাভ করবে এবং শর্ত মতো লাভের অর্ধেককে তাদের মধ্যে সমানহারে বণ্টন করে নিবে।

তবে একাধিক রাব্বুল মাল মিলে একজন মুদারিব নিয়োগ দিতে পারবে কি-না তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিকাহবিদ তা বৈধ রয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন। এই প্রকার মুদারাবার আরেকটি সুরত হলো, মুদারিব ও রাব্বুল মাল উভয় পক্ষ একাধিক হওয়া। এই সুরতটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মতে বৈধ হবে বলে অনুমান করা যায়। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ : ৩৮/৬৪-৬৫)

মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব । মুদারাবার লাভ ও ক্ষতির হিসাব নিকেশ

বিশুদ্ধ পন্থায় পরিচালিত মুদারাবা থেকে মুদারিব দু’টি অধিকার লাভ করবে। সে মুদারাবা ব্যবসা করতে গিয়ে খাওয়া থাকা ভাড়া ইত্যাদি বাবত যে অর্থ ব্যয় করেছে তা মুদারাবার অর্থ থেকে গ্রহণ করবে। আর মুদারাবার সময় শেষ হওয়ার পর মুনাফা থেকে তার নির্দিষ্ট অংশ বুঝে নিবে।

প্রথম অধিকার

মুদারিব মুদাবারা করতে গিয়ে থাকা খাওয়া পরিবহন ভাড়া ইত্যাদি কাজে যে অর্থ ব্যয় করবে তা মুদারাবার অর্থ থেকে গ্রহণ করবে। কিন্তু সেটা রা’সুল মাল থেকে গ্রহণ করবে না-কি মুনাফা থেকে গ্রহণ করবে? এই ব্যাপারটি নিয়ে উলামায়ে কেরাম মতবিরোধ করেছেন।

হানাফি আলেম কাসানি বলেন, তা রাসুল মাল থেকে গ্রহণ করবে। কেননা ব্যবসায় লাভ হওয়া বা না হওয়া উভয়টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই লাভের অর্থ থেকে যদি মুদারিবের এ-সব অর্থ গ্রহণ করার কথা বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে সমাজে মুদারাবার প্রয়োজন প্রকট অথচ যথেষ্ট পরিমাণে মুদারিব পাওয়া যাচ্ছে না।

কেননা মানুষ নিজের পকেটের টাকা লোকসান যাওয়ার রিক্স নিয়ে মুদারাবা ব্যবসা করতে খুব কমই আগ্রহী হবে। আর মুদারাবা ব্যবসায় যদি লাভ হয়, তাহলে রাসুল মাল থেকে এ-সব খরচপাতির অর্থ গ্রহণ করা যাবে না, বরং লাভের টাকা থেকে তা গ্রহণ করবে। যাতে ব্যয়ভার উভয়ের উপর বর্তায়।

দ্বিতীয় অধিকার

মুদারাবার কাজ আঞ্জাম দেওয়ার পর মুনাফা থেকে তার নির্ধারিত অংশ গ্রহণ করা। কাসানি বলেন, মুদারিব বিশুদ্ধ পন্থায় মুদারাবা কর্ম অঞ্জাম দেওয়ার পর যদি মুনাফা হাসিল হয় তাহলে তা পূর্ব নির্ধারিত অংশ হিসাবে বণ্টন হবে।

তবে মুনাফা বণ্টন শুদ্ধ হওয়ার শর্ত হলো, বণ্টনের পূর্বেই রাসুল মাল মালিকের হস্ততে ফিরিয়ে দেওয়া। সুতরাং মালিকের হাতে রাসুল মাল হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত মুনাফা বণ্টন শুদ্ধ নয়। এমনকি কেউ যদি রা’সুল মাল মালিকের হাতে হস্তান্তরের আগে মুনাফা বণ্টন করে নিজের অংশ গ্রহণ করে নেয়, অতপর মুদারিবের হাতেই রাসুল মাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তাহলে পূর্বের বণ্টিত মুনাফা ফিরিয়ে দিয়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত রাসুল মালের সাথে যোগ করতে হবে।

যতক্ষণ না রা’সুল মালের ক্ষতিপূর্ণ হয়ে যায়। এভাবে রা’সুল মালের কিছু অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় অথবা ব্যবসায় লোকসান হওয়ার কারণে রাসুল মালের পরিমাণে হ্রাস ঘটে য়ায়, তাহলে মুনাফা থেকে ক্ষতিপূরণ করতে হবে। ক্ষতিপূরণের পর যদি মুনাফা অবশিষ্ট থাকে তবে তা মুদারিব ও রাব্বুল মালের মধ্যে পূর্ব শর্ত অনুসারে বণ্টন হবে।

আর যদি বাকি না থাকে তবে মুদারিব কিছুই পাবে না। মনে করা হবে কোনো লাভই হয়নি। অর্থাৎ মুনাফা বণ্টন চূড়ান্তভাবে কার্যকর হতে হলে মালিক ও মুদারিব মিলে প্রথম চুক্তির হিসাবে নিকেশ শেষ করতে হবে।

অতপর যদি মালিকের হাতে মূলধন হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত হয় তাহলে ফিরিয়ে দিবে। আর যদি চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে তা করবে। এই হিসাব নিকেশ শেষ করার আগে মুনাফা বণ্টন চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে না। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ – ৩৮/৬৯-৭৫)


পোস্টটি শেয়ার করুন