ইসলামে প্রতিটি বিষয়ের মতো সফরের ব্যাপারেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কুরআন ও হাদিসে মুসাফিরের সংজ্ঞা, করণীয়, এবং বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই ব্লগপোস্টে আমরা মুসাফির কাকে বলে? তার সাথে সম্পর্কিত বিধানগুলো বিষয়ে কুরআন এবং হাদিসের আলোকে একটি পরিপূর্ণ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।
মুসাফির কাকে বলে?
“মুসাফির” শব্দটি এসেছে আরবি “সফর” শব্দ থেকে, যার অর্থ ভ্রমণ। ইসলামিক পরিভাষায়, মুসাফির হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি নিজ এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে কমপক্ষে ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কিলোমিটার) বা এর বেশি দূরত্ব ভ্রমণ করেন এবং ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য সেখানে অবস্থানের নিয়ত করেন। এই দূরত্ব এবং সময়ের মাপকাঠি ইসলামী ফিকহে বিশেষভাবে উল্লেখিত।
ইমামদের অভিমত
কুরআন ও হাদীসে সফরের সাথে সালাত কসর করার অনুমোদন এসেছে। কিন্তু কী পরিমাণ দূরত্বের সফর বা ভ্রমন হলে কসর করতে পারবে, এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাই ফুকাহায়ে কেরাম ভিন্নভিন্ন অভিমত দিয়েছেন।
প্রথম অভিমত
অনেক ফুকাহায়ে কেরাম মনে করেন, এই বিষয়টি সফরকারী ব্যক্তির বিবেকের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। সে তার নিজ বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে যেখানে যাচ্ছে দূরত্ব বিবেচনায় তার কাছে এটি সফর মনে হলে সে মুসাফির হবে। তার সালাত কসর করা বৈধ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম তিন মাইলের দূরত্বে বের হয়ে কসর করেছেন বলে বিশুদ্ধ বিবরণ পাওয়া যায়। (সহীহ মুসলিম, মুসাফিরের সালাত অনুচ্ছেদ, নং ১৬১৫)
ইমাম আবু হানিফার অভিমত
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সহ অন্যান্য অনেক ফকিহের মতে, কোনো ব্যক্তি তার নিজ বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে অনুমানিক ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার দূরের কোনো এলাকা ভ্রমনের ইচ্ছায় বের হলে, সে নিজ এলাকা থেকে বের হওয়ার পর থেকে মুসাফির বলে গণ্য হবে এবং নিজ বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত মুসাফির থাকবে। নিজ এলাকা থেকে বের হওয়ার পর পথিমধ্যে এবং সে যে শহরে ভ্রমন করেছে উক্ত শহরে সালাত কসর করবে।
ইবনু আব্বাসসহ কতিপয় সাহাবা থেকে চার বুরদে কসর করা এবং এর নিচে কসর না করার নির্দেশ পাওয়া যায়। যার পরিমাণ অনুমানিক ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা থেকে বের হয়ে যুল-হুলাইফা নামক স্থানে গিয়ে সালাতে কসর করেছিলেন বলে বর্ণনা রয়েছে। (সহিহ বুখারি – ১০৩৯)
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لا تقصروا الصلاة في أقل من أربعة برد
“ মরা চার ‘বুরদ’ থেকে কম ভ্রমন করলে সালাতে কসর করো না। ” (বুলুগুল মারাম: ৪১০)
ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন,
كان ابن عمر وابن عباس رضي الله عنهم يقصران ويفطران في أربع برد وهي ستة عشر فرسخا
“ ইবনে উমার ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম চার ‘বুরদ’ অতিক্রম করলে সালাতে কসর করতেন এবং রোজা ছাড়তেন। আর (চার বুরদ হলো) ষোল ফারসাখ। ” (সহিহ বুখারি, বাব, ফি কাম ইউকসারুস সালাতু)
এক ‘বুরদ’ সমান ৪ ফারসাখ। সুতরাং ৪ ‘বুরদ’ সমান হবে ষোল ‘ফারসাখ’। আর এক ফারসাখে হয় ৩ মাইল সুতরাং ষোল ফারসাখে হবে ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার।
কুরআনের আলোকে মুসাফির
কুরআন মজিদে মুসাফিরদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা এবং কিছু বিধান শিথিল করার কথা বলা হয়েছে। যেমন:
১. নামাজ সংক্ষেপ করার অনুমতি:
“যদি তোমরা ভ্রমণে থাকো, তবে নামাজ সংক্ষেপ করার কোনো দোষ নেই…”
(সুরা নিসা, ৪:১০১)
২. রোজার শিথিলতা:
“যে ব্যক্তি অসুস্থ অথবা ভ্রমণে থাকে, সে অন্য দিনে রোজা পূর্ণ করুক।”
(সুরা আল-বাকারাহ, ২:১৮৫)
হাদিসের আলোকে মুসাফির
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসেও মুসাফিরদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন:
১.নামাজের সংক্ষেপ: সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ভ্রমণে নামাজ সংক্ষেপ করা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি দান। সুতরাং আল্লাহর দান গ্রহণ করো।” (সহিহ মুসলিম)
২.রোজা ভঙ্গের অনুমতি: আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
“আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সফরে ছিলাম। যারা রোজা রাখত, তারা অসুবিধায় পড়ত না, আর যারা রোজা ভঙ্গ করত, তারাও তিরস্কৃত হতো না।” (বুখারি ও মুসলিম)
মুসাফিরদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা
- নামাজে সহজতা: ইসলাম ধর্মে নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মুসাফিরদের জন্য নামাজে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে:
- কসর নামাজ: চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজ দুই রাকাত পড়া।
- জামা’ (একত্রে নামাজ পড়া): জোহর ও আসর, মাগরিব ও এশা একত্রে পড়া।
- রোজায় শিথিলতা: মুসাফিররা যদি রোজা রাখা কঠিন মনে করেন, তবে তারা তা ভেঙে ফেলতে পারেন এবং পরে কাজা করতে পারেন। এটি ইসলামের সহজ এবং ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।
- ফিতরা ও সদকা গ্রহণের অনুমতি: অভাবী মুসাফিররা যাকাত এবং সদকা গ্রহণ করতে পারেন, যদিও তারা স্বাভাবিক অবস্থায় অভাবী না হন।
সফরের শিষ্টাচার
মুসাফিরদের জন্য কিছু শিষ্টাচার ও আদব ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দেশিত হয়েছে।
১. সফরের আগে দোয়া: সফর শুরু করার আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
“সুবহানাল্লাধি সাখ্খারা লানা হা’জা… (তাসবিহ দোয়া)”
২. সহযাত্রী নির্বাচন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যখন তোমরা ভ্রমণে বের হও, তিন বা তার বেশি সংখ্যায় হও এবং তাদের মধ্যে একজনকে নেতা বানাও।” (আবু দাউদ)
৩. সতর্কতা ও নিরাপত্তা: ভ্রমণের সময় সবসময় সচেতন থাকা এবং সতর্কতার সঙ্গে চলা আবশ্যক।
৪. ফেরার সময় দ্রুত ফেরত আসা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যখন কেউ সফর সম্পন্ন করে, তখন তার পরিবারের কাছে দ্রুত ফিরে যাওয়া উচিত।” (সহিহ বুখারি)
আধুনিক যুগে মুসাফিরদের চ্যালেঞ্জ
আজকের যুগে ভ্রমণের মাধ্যম ও ধরণ অনেকটাই বদলে গেছে। বিমান, ট্রেন, এবং গাড়ি ভ্রমণ সহজ এবং দ্রুত করে তুলেছে। তবে কিছু সাধারণ প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জ মুসাফিরদের সামনে আসতে পারে:
- যাত্রাপথে নামাজ পড়া: যদি কোনো জায়গায় থামা সম্ভব না হয়, তবে নামাজ বসে বা ইশারা দিয়ে পড়া যায়।
- ভ্রমণে রোজা রাখা: যদি ভ্রমণের সময় রোজা রাখার মতো শারীরিক সামর্থ্য থাকে, তবে রোজা রাখা উত্তম।
প্রশ্নাবলি
১. মুসাফির কত দূরত্ব ভ্রমণ করলে নামাজ কসর করা যাবে?
ইসলামী ফিকহ অনুসারে, প্রায় ৭৮ কিলোমিটার বা ৪৮ মাইল ভ্রমণ করলে একজন মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।
২. মুসাফির কতদিন অবস্থান করলে নামাজ পূর্ণ পড়তে হবে?
যদি কোনো ব্যক্তি ১৫ দিন বা তার বেশি সময়ের জন্য কোনো স্থানে অবস্থান করে, তবে তিনি মুসাফির থাকবেন না এবং তাকে পূর্ণ নামাজ পড়তে হবে।
৩. মুসাফির কি তার কসর নামাজ জামাতে পড়তে পারে?
হ্যাঁ, মুসাফির ব্যক্তি জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে ইমাম যদি মুকিম হন, তবে তাকে ইমামের সঙ্গে পূর্ণ নামাজ পড়তে হবে।
৪. মুসাফির কি ভ্রমণে নফল নামাজ পড়তে পারবেন?
হ্যাঁ, মুসাফির ভ্রমণের সময় নফল নামাজ পড়তে পারেন। এটি তার ইচ্ছাধীন।
৫. রমজানে মুসাফির রোজা রাখবেন কি?
যদি রোজা রাখা তার জন্য কষ্টদায়ক না হয়, তবে রোজা রাখা উত্তম। তবে কষ্ট হলে পরে কাজা করার অনুমতি আছে।
উপসংহার
আমরা এই পোস্টে মুসাফির কাকে বলে? তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানে কিছুটা শিথিলতা জানতে পারলাম। কেননা ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যা মানুষের প্রতিটি প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে। মুসাফিরদের জন্য কুরআন ও হাদিসে প্রদত্ত সহজতা এরই একটি প্রমাণ। সফরের সময় এই বিধানগুলো মেনে চলা শুধু ইবাদত সহজ করে না, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমও হয়ে ওঠে।
মুসাফিরদের জন্য এই ইসলামী দিকনির্দেশনা জানার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর দান এবং রহমত সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।