প্রত্যেক মানুষই চায় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সুগঠিত দেহের অধিকারী হতে। উচ্চতা (লম্বা হওয়া) এমন একটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য, যা অনেকের কাছে আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের প্রতীক। অনেকেই লম্বা হওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে ঝোঁকেন। তবে একজন মুমিনের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তাআলাই আমাদের আকৃতি নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা দেন, তাতেই কল্যাণ রয়েছে। তবুও, কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে, কোনো কিছু অর্জনের জন্য বৈধ প্রচেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
এই ব্লগপোস্টে আমরা লম্বা হওয়ার জন্য কোনো সহিহ ও প্রমাণিত দোয়া রয়েছে কি না, তা বিশ্লেষণ করব। পাশাপাশি, ইসলামের দৃষ্টিতে আকৃতি ও সৌন্দর্যের প্রকৃত গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করব।
লম্বা হওয়ার জন্য পড়তে পারেন এমন কিছু দোয়া
যদিও নির্দিষ্টভাবে “লম্বা হওয়ার জন্য” সহিহ হাদিসে কোনো দোয়া পাওয়া যায় না, তবে শরীরের বৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ কামনায় কিছু সাধারণ দোয়া পড়া যেতে পারে। নিম্নে কয়েকটি দোয়া দেওয়া হলো—
১. আকার ও গঠনের জন্য নবী মূসা (আ.)-এর দোয়া
নবী মূসা (আ.) স্বীয় গঠন ও বাগ্মীতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন:
📖 দোয়া:
رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي يَفْقَهُوا قَوْلِي
উচ্চারণ: “রাব্বি শ্রাহ্ লি সাদ্রি, ওয়া ইয়াস্সির লি আম্রি, ওয়াহ্লুল উক্দাতাম মিন লিসানি, ইয়াফ্কাহু কাওলি।”
অর্থ: “হে আমার রব! আমার অন্তর প্রশস্ত করে দিন, আমার কাজ সহজ করে দিন, এবং আমার ভাষার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।”
📚 (সূরা ত্বাহা: ২৫-২৮)
🔹 উপকারিতা: যদিও এটি বিশেষভাবে লম্বা হওয়ার জন্য নয়, তবে আল্লাহর কাছে আকৃতি ও দেহের কল্যাণ কামনার জন্য এটি পড়া যেতে পারে।
২. আল্লাহর দেওয়া আকৃতি ও গঠনের প্রতি সন্তুষ্টির দোয়া
📖 দোয়া:
اللَّهُمَّ أَحْسَنْتَ خَلْقِي فَأَحْسِنْ خُلُقِي
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা আহ্সান্তা খাল্কি ফা আহ্সিন্ খুলুকি।”
অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সুন্দর আকৃতি দিয়েছেন, তাই আমার চরিত্রও সুন্দর করে দিন।”
📚 (সুনান ইবনে মাজাহ: ৭৫৯)
🔹 উপকারিতা: এই দোয়ার মাধ্যমে আমরা দেহ ও চরিত্র উভয়ের সৌন্দর্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারি।
৩. সুস্বাস্থ্য ও উন্নতির জন্য দোয়া
📖 দোয়া:
اللَّهُمَّ زِدْنِي عِلْمًا وَجِسْمًا وَحُسْنًا
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা যিদনি ‘ইল্মান্, ওয়া জিস্মান্, ওয়া হুস্নান্।”
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমাকে জ্ঞান, শারীরিক বৃদ্ধি ও সৌন্দর্যে উন্নতি দিন।”
🔹 উপকারিতা: যদিও সরাসরি হাদিসে নেই, তবে এই অর্থবোধক দোয়া ব্যক্তিগত চাওয়া হিসেবে আল্লাহর কাছে করা যেতে পারে।
৪. বরকত ও উন্নতির জন্য রাসূল (ﷺ)-এর শিক্ষা অনুযায়ী দোয়া
📖 দোয়া:
اللَّهُمَّ بَارِكْ لِي فِي جَسَدِي وَزِدْنِي فِي قُوَّتِي
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা বারিক্ লি ফি জাসাদি, ওয়া যিদনি ফি কুওওয়াতি।”
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমার দেহে বরকত দান করুন এবং আমার শক্তি বৃদ্ধি করুন।”
🔹 উপকারিতা: শারীরিক বৃদ্ধি ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য এটি উপকারী হতে পারে।
ইসলামে লম্বা হওয়ার গুরুত্ব
ইসলামে মানুষের উচ্চতা বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের তুলনায় আন্তরিকতা, তাকওয়া ও চরিত্রের সৌন্দর্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে লম্বা হওয়া বা সুন্দর আকৃতি পাওয়া আল্লাহর নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। কুরআন ও হাদিসে দেখা যায়, শারীরিক আকৃতি নিয়ে অহংকার না করে, বরং আল্লাহর দেওয়া গঠনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং নৈতিক গুণাবলির দিকে মনোযোগ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
১. উচ্চতা ও শারীরিক গঠনের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
🔹 আল্লাহই সৃষ্টির আকৃতি নির্ধারণ করেন
আল্লাহ তাআলা বলেন: “তিনিই তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন এবং তোমাদের আকৃতিকে সুন্দর করেছেন।”
📖 (সূরা গাফির: ৬৪)
🔹 মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তাকওয়ার ভিত্তিতে: কোনো ব্যক্তি লম্বা বা খাটো হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠ বা নিম্ন নয়, বরং তার তাকওয়া ও আমলের ভিত্তিতেই মর্যাদা নির্ধারিত হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।” 📖 (সূরা হুজুরাত: ১৩)
🔹 নবী ﷺ-এর সাহাবীদের উচ্চতা: ইসলামের ইতিহাসে সাহাবীদের মধ্যে কেউ লম্বা ছিলেন, আবার কেউ খাটো ছিলেন। কিন্তু রাসূল ﷺ কাউকে তার উচ্চতা বা বাহ্যিক গঠনের কারণে বিচার করেননি। বরং তিনি তাকওয়া ও সৎকর্মের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
২. লম্বা হওয়া কি ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ?
ইসলামে লম্বা হওয়া সরাসরি কোনো ইবাদত বা পূণ্যের বিষয় নয়, তবে শারীরিক বৃদ্ধি ও শক্তির মাধ্যমে ভালো কাজ করা সম্ভব হলে তা প্রশংসনীয় হতে পারে।
✅ শরীর সবল থাকলে ইবাদত ও দাওয়াতের কাজে সুবিধা হয়।
নবী ﷺ বলেছেন: “শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের তুলনায় আল্লাহর কাছে অধিক উত্তম ও প্রিয়।” 📚 (সহিহ মুসলিম: ২৬৬৪)
✅ যুদ্ধে ও কঠিন কাজে লম্বা বা শক্তিশালী শরীর সহায়ক হতে পারে। যেমন, ইসলামী ইতিহাসে বিখ্যাত সাহাবি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন লম্বা ও শক্তিশালী। এতে তিনি যুদ্ধ ও প্রশাসনিক কাজে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন।
❌ তবে বাহ্যিক সৌন্দর্য বা উচ্চতা নিয়ে অহংকার করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসূল ﷺ বলেন: “যার অন্তরে ذرّة (সরিষা পরিমাণ) অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহিহ মুসলিম: ৯১)
৩. ইসলামের শিক্ষা: আল্লাহর দেওয়া গঠনে সন্তুষ্ট থাকা
যদিও কেউ লম্বা হতে চায়, তবে ইসলামের শিক্ষা হলো— আল্লাহর দেওয়া আকৃতি ও অবয়বের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। নবী ﷺ আমাদের এই দোয়া শিখিয়েছেন:
اللَّهُمَّ أَحْسَنْتَ خَلْقِي فَأَحْسِنْ خُلُقِي
📝 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আহ্সান্তা খাল্কি ফা আহ্সিন্ খুলুকি।
অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সুন্দর আকৃতি দিয়েছেন, তাই আমার চরিত্রও সুন্দর করে দিন।”
📚 (সুনান ইবনে মাজাহ: ৭৫৯)
✅ এই দোয়া থেকে বোঝা যায়, বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে চরিত্রের সৌন্দর্যই আসল।
উপসংহার
ইসলামে লম্বা হওয়া বা বাহ্যিক আকৃতির গুরুত্ব নেই, বরং তাকওয়া, নৈতিকতা ও ইবাদতের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লম্বা হওয়ার ইচ্ছা যদি স্বাস্থ্য বা সুস্থতার জন্য হয়, তবে তা বৈধ। তবে যদি তা অহংকার বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য হয়, তবে তা অনর্থক মনোভাবের পরিচায়ক।
📌 মূল শিক্ষা:
- লম্বা বা খাটো হওয়া আল্লাহর ইচ্ছাধীন।
- তাকওয়া ও চরিত্রের সৌন্দর্যই মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নির্ধারণ করে।
- বাহ্যিক গঠন নিয়ে অহংকার করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- সুস্থতা ও শক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা যেতে পারে।
🔹 তাই, বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ গুণাবলির উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত—এই শিক্ষাই ইসলাম আমাদের দেয়। 🤍