সালাত শব্দের অর্থ কি? সালাত কাকে বলে? বিস্তারিত আলোচনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

(الصّلاة) সালাত শব্দটি আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত। সালাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ ও ব্যবহার রয়েছে। আমরা এই শব্দটির সকল অর্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।

সালাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ

  • দোয়া: সালাত অর্থ প্রার্থনা বা দোয়া। সালাতে কিয়াম, রুকু, সিজদা, জিকির এবং তাসবিহ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে এবং তাঁর রহমত ও ক্ষমা লাভের চেষ্টা করে।
  • বরকত ও কল্যাণ: সালাত মানে বরকত ও কল্যাণ। আল্লাহর প্রতি যথাযথভাবে নত হওয়া এবং তাঁর মহিমা ও গরিমাকে স্বীকার করার মধ্যে সর্বোচ্চ বরকত রয়েছে।
  • ক্ষমা: সালাতকে ক্ষমার মাধ্যম বলা হয়। এর প্রধান লক্ষ্য হলো বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভ করা এবং তাঁর অপার রহমত প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
  • রহমত ও প্রশংসা: আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
    “নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ পাঠান। হে মুমিনগণ, তোমরা নবীর প্রতি দরুদ এবং শান্তি প্রেরণ কর।” (সূরা আহযাব: ৫৬)
    এখানে আল্লাহর সালাত বলতে বোঝানো হয়েছে নবীর প্রতি আল্লাহর রহমত এবং তাঁর প্রশংসা।
  • মহিমা ও সম্মান: সালাত এমন একটি ইবাদত, যা আল্লাহর আদেশকে সম্মানিত করে এবং তাঁর গরিমাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করে।
  • সংশোধন: সালাতকে “তাসলিয়াহ” বা সংশোধন বলা হয়। এটি বান্দার আত্মাকে অন্যায়, বিকৃতি এবং কুপথ থেকে সংশোধন করে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
  • সম্পর্ক: সালাত শব্দটি “সিলা” থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সংযোগ বা সম্পর্ক। সালাত বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যে এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে। বান্দা সালাত ছেড়ে দিলে সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায় এবং জাহান্নামে পতিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন:
    “যে ব্যক্তি সালাত ত্যাগ করে, তার কোনো ধর্ম নেই।”
  • আল্লাহর নেয়ামত অব্যাহত রাখার মাধ্যম: সালাত এমন একটি ইবাদত, যা আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামত বান্দার ওপর অব্যাহত রাখে। আল্লাহ বলেন:
    “আপনার পরিবারকে সালাতের আদেশ দিন এবং এতে দৃঢ় থাকুন। আমরা আপনার কাছে রিজিক চাই না; আমরাই আপনাকে রিজিক দিই। আর পরিণাম তাকওয়াবানদের জন্য।” (সূরা ত্বাহা: ১৩২)

সালাত কাকে বলে? সালাতের সংজ্ঞা

শরিয়তের পরিভাষায় সালাত হলো – নির্ধারিত কিছু বাক্য ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য একটি ইবাদত। শুরু হয় তাকবির (আল্লাহু আকবর) দিয়ে এবং শেষ হয় তাসলিম (আসসালামু আলাইকুম) এর মাধ্যমে। সালাতের পঠিত অংশের মধ্যে রয়েছে কুরআন তিলাওয়াত, তাকবির, এবং তাসবিহ। আর সালাতে যেসব কাজ করা হয়, সেগুলো হলো দাঁড়ানো, রুকু, সিজদা, ইত্যাদি।

সালাত বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের একটি অন্যতম মাধ্যম। সালাতের মাধ্যমে বান্দা তাঁর সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় এবং তাঁর রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করে।

কুরআনে সালাত শব্দের ব্যবহার

সালাত এমন একটি উপাসনা যা সমস্ত আসমানি ধর্মে অনুমোদিত ছিলো। যদিও তা সম্পাদনের পদ্ধতি বিভিন্ন ধর্ম হিসাবে কিছুটা ভিন্নতা ছিলো। আল-কুরতুবি আল-কুশাইরি থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “আল্লাহ্‌ কোনো যুগই শাস্ত্রবিহীন রাখেননি, আর কোনো শাস্ত্রকেই প্রার্থনাবিহীন করেননি।” নিচের অংশে আমরা “সালাত” শব্দের ভাষাগত অর্থ এবং কুরআনে ব্যবহৃত বিভিন্ন অর্থ বোঝার চেষ্টা করব।

ভাষাগতভাবে “সালাত” শব্দটির দুইটি অর্থ রয়েছে

১. আগুন এবং তার সাথে সম্পর্কিত কোনো কিছু, যেমন জ্বর। বলা হয়,

صَلَيْتُ العود بالنار

“আমি কাঠ আগুনে দগ্ধ করেছি”।

২. বিশেষ উপাসনা। দোয়ার অর্থ প্রদান করে। যেমন, কবি আল-আশা বলেছেন:

تقول بنتي وقد قرَّبتُ مُرْتَحَلاً: يا رب جنِّبْ أبي الأوصاب والوجعا
عليكِ مثلُ الذي صَلَّيتِ فاغتمضي نوماً فإن لجنب المرء مضطجعا

কিছু ব্যক্তি বলেছেন, শারঈ প্রার্থনাকে “সালাত” বলা হয় কারণ এতে দোয়া অন্তর্ভুক্ত। অন্যরা বলেছেন, এটিকে “সালাত” বলা হয় কারণ এতে নত হওয়া ও সিজদা করা হয়। যা পিঠ বাঁকানোর সাথে সম্পর্কিত।

কুরআনে “সালাত” শব্দের ব্যবহার

কুরআনে “সালাত” শব্দটি প্রায় ১০০ বার এসেছে। সেখানে প্রায় ৮৫ স্থানে নাম হিসেবে এবং প্রায় ১৫ স্থানে ক্রিয়া হিসেবে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ:

সালাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ
সালাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ
  • নাম হিসেবে:

(البقرة:3) {الذين يؤمنون بالغيب ويقيمون الصلاة}

  • ক্রিয়া হিসেবে:

(القيامة:31) {فلا صدق ولا صلى}

কুরআনে সালাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ

১. ফরজ প্রার্থনা

وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوۃَ وَ ارۡكَعُوۡا مَعَ الرّٰكِعِیۡنَ ﴿۴۳

‘আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর। ( সুরা বাকারা : ৪৩)

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শব্দটি ফরজ প্রার্থনা নির্দেশ করে। আর সাধারণত জাকাতের সাথে সংযুক্ত।

২. আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া

هُوَ الَّذِیۡ یُصَلِّیۡ عَلَیۡكُمۡ وَ مَلٰٓئِكَتُهٗ لِیُخۡرِجَكُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ ؕ وَ كَانَ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَحِیۡمًا ﴿۴۳

‘তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করেন, আর তাঁর ফেরেশতারাও (তোমাদের জন্য) তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে আনার জন্যে। মু’মিনদের প্রতি তিনি পরম দয়ালু।’ ( সুরা আহযাব : ৪৩)

৩. আল্লাহর প্রশংসা

اِنَّ اللّٰهَ وَ مَلٰٓئِكَتَهٗ یُصَلُّوۡنَ عَلَی النَّبِیِّ ؕ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا صَلُّوۡا عَلَیۡهِ وَ سَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا

‘নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোয়া করেন। হে মুমিনগণ, তোমরা নবীর উপর দরূদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’ ( সুরা আহযাব : ৫৬)

আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রার্থনা মানে তাঁর বান্দাকে প্রশংসা করা।

৪. দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা:

خُذۡ مِنۡ اَمۡوَالِهِمۡ صَدَقَۃً تُطَهِّرُهُمۡ وَ تُزَكِّیۡهِمۡ بِهَا وَ صَلِّ عَلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

‘তাদের সম্পদ থেকে সদাকা নাও। এটার দ্বারা তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দোয়া কর। নিশ্চয় তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ ( সুরা তাওবা : ১০৩)

৫. কুরআন তিলাওয়াত:

وَ لَا تَجۡهَرۡ بِصَلَاتِكَ وَ لَا تُخَافِتۡ بِهَا وَ ابۡتَغِ بَیۡنَ ذٰلِكَ سَبِیۡلًا

 ‘তোমার সালাতে তিলাওয়াত উচ্চ করো না, আর তা খুব নীচুও করো না, এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর।’ ( সুরা আল ইসরা : ১১০)

৬. জানাজার নামাজ:

وَ لَا تُصَلِّ عَلٰۤی اَحَدٍ مِّنۡهُمۡ مَّاتَ اَبَدًا وَّ لَا تَقُمۡ عَلٰی قَبۡرِهٖ ؕ

‘আর তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তার উপর তুমি জানাযা পড়বে না এবং তার কবরের উপর দাঁড়াবে না।’ (সুরা তাওবা :৮৪)

৭. জুমার নামাজ:

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِكۡرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِكُمۡ خَیۡرٌ لَّكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۹﴾

‘হে মুমিনগণ, যখন জুমু‘আর নামাজের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। আর বেচা-কেনা বর্জন কর। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে। ( সুরা জুমুআ: ৯)

৮. গণপ্রার্থনা বা জামাত:

{وإذا ناديتم إلى الصلاة اتخذوها هزوا ولعبا}

‘আর যখন তোমরা সালাতের (জামাতের) আহবান কর তখন তারা ওর সাথে উপহাস করে; এর কারণ এই যে, তারা এরূপ লোক যারা মোটেই জ্ঞান রাখেনা।’ ( সুরা মায়িদা : ৫৮ )

৯. উপাসনালয়:

وَ لَوۡ لَا دَفۡعُ اللّٰهِ النَّاسَ بَعۡضَهُمۡ بِبَعۡضٍ لَّهُدِّمَتۡ صَوَامِعُ وَ بِیَعٌ وَّ صَلَوٰتٌ وَّ مَسٰجِدُ یُذۡكَرُ فِیۡهَا اسۡمُ اللّٰهِ كَثِیۡرًا ؕ

‘আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধস্ত হয়ে যেত খৃস্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইয়াহূদীদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়।’ (সুরা আল হাজ :৪০ )


পোস্টটি শেয়ার করুন