সুওর বা ঝুটা সম্পর্কিত বিধান । উচ্ছিষ্ট কয় প্রকার ও কী কী?

Share this post

ইসলামে পবিত্রতা একটি মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়। প্রতিদিনের ইবাদত, বিশেষত সালাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য ওজু বা গোসলের মাধ্যমে দেহ, কাপড় এবং ব্যবহার্য পানি পবিত্র রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেক সময় আমরা এমন পানির সম্মুখীন হই—যা কোনো প্রাণী বা মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে অবশিষ্ট থাকে। এই অবশিষ্ট পানি, যাকে ইসলামী পরিভাষায় “সুওর (السؤر)” বলা হয়, তা আদৌ পবিত্র কি না—এ নিয়ে দ্বিধা তৈরি হতে পারে।

সুওর বা ঝুটা এর অর্থ ও বিধান

সুওর (السّؤْر) এর ভাষাগত অর্থ: ‘সুওর’ বলতে বোঝায় কোনো কিছুর অবশিষ্ট বা বাকি অংশ। এটাকে ঝুটাও বলা হয়।

শরিয়তের পরিভাষায়: যে পানি কোনো মানুষ বা প্রাণী পান করার পর পাত্রে বা হাউজে অবশিষ্ট থাকে, সেটিকেই ‘সুওর’ বলা হয়।

সুওরের বিধান: প্রাণীর লালার সৃষ্টি তার গোশত থেকেই হয়, তাই কোনো প্রাণীর গোশত যদি পবিত্র হয়, তবে তার সুওরও পবিত্র হিসেবে গণ্য হবে।

সুওর মূলত চার প্রকার

প্রথমত: পবিত্র ও পবিত্রকারী সুওর

এগুলো এমন সুওর বা ঝুটা, যা নিজেও পবিত্র এবং অন্য কিছুকে পবিত্র করার ক্ষমতা রাখে। এই প্রকার সুওর পান করতে বা ওযু , গোসল ইত্যাদি করতে কোনো অসুবিধা নেই। সেগুলো হলো:

১. মানুষের সুওর, পুরুষ বা নারী, হায়েযা বা জানাবতগ্রস্ত, মুসলিম বা অমুসলিম – সকলের একই বিধান।

হাদীসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন:

“আমি হায়েযা অবস্থায় পান করতাম, তারপর নবী (সা.)-কে দিতাম, তিনি আমার মুখের স্থানে মুখ রেখে পান করতেন। আমি হাড় চুষে খেতাম, তারপর নবী (সা.)-কে দিতাম, তিনিও আমার মুখের স্থানে মুখ রাখতেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ٣٠٠)

২. যেসব প্রাণীর রক্ত তরল নয়, যেমন পোকা-মাকড়, মাছ ইত্যাদি, এদের ঝুটা নাপাক নয়।

৩. ঘোড়া এবং যেসব প্রাণীর গোশত হালাল, যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত: সম্পূর্ণ নাপাক সুওর

এগুলো এমন সুওর যা নিজেও নাপাক এবং অন্য কিছুকে নাপাক করে দেয়। সেগুলো হলো:

১. কুকুর ও শুকরের সুওর:

কারণ হাদীসে এসেছে:

“যদি কুকুর পাত্রে মুখ দেয়, তবে তা তিন, পাঁচ বা সাতবার ধুতে হবে।” (দারাকুতনী)

কুরআনে বলা হয়েছে:

“…অথবা শুকরের গোশত, নিশ্চয়ই তা অপবিত্র।” (সূরা আন’আম, আয়াত ১৪৫)

২. হিংস্র প্রাণীর সুওর

যেমন: শিয়াল, চিতা, বাঘ ইত্যাদি – যেগুলোর গোশত হালাল নয়।

৩. মদ পান করার কিছুক্ষণ পর পান করা ব্যক্তির সুওর

কেননা তখনো তার মুখে নাপাকি থাকতে পারে।

৪. এমন প্রাণীর সুওর যা নাপাক কিছু খাওয়ার ফলে তার মুখ নাপাক হয়েছে:

যেমন বিড়াল, মুরগি, উট, গরু ইত্যাদি – যদি জানা যায় তাদের মুখ নাপাক কিছুতে লাগানো হয়েছে, তবে তাদের সুওরও নাপাক হবে।

তৃতীয়ত: প্রয়োজনের তাগিদে পবিত্র (তবে মাকরূহ) সুওর

এগুলো এমন ঝুটা, যা পবিত্র হলেও ব্যবহার করা মাকরূহ, বিরত থাকা উত্তম, বিশেষ করে যখন বিকল্প পানি পাওয়া যায়। সেগুলো হলো:

১. বিড়াল ও খোলা ছেড়ে রাখা মুরগির সুওর

২. হিংস্র পাখির ঝুটা: যেমন বাজ, শকুন, কাক ইত্যাদি। কারণ তারা ঠোঁট দিয়ে পান করে, আর ঠোঁট হলো পবিত্র হাড়। তবে যেহেতু এদের গোশত নাপাক, তাই এদের সুওর মাকরূহ গণ্য হয়।

৩. বাসায় বসবাসকারী এমন প্রাণীর সুওর যাদের তরল রক্ত আছে:

যেমন ইঁদুর, সাপ ইত্যাদি। এদের গোশত হারাম হওয়ায় এদের সুওরও নাপাক হওয়ার কথা, কিন্তু যেহেতু তারা মানুষের ঘরে ঘোরাফেরা করে, তাই প্রয়োজনে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে—তবে অপছন্দনীয় রয়ে গেছে।

📌 মাকরূহ সুওর কাপড়ে লাগলে তা পরে নামাজ পড়াও মাকরূহ। তেমনি এরূপ পানি বহন করাও মাকরূহ।

চতুর্থত: পবিত্র কিন্তু সন্দেহযুক্ত সুওর

যেমন: খচ্চর ও গাধার সুওর।

কারণ এদের গোশতের হালাল হওয়া নিয়ে হাদীসগুলোতে মতবিরোধ রয়েছে। তবে হাদীসে আছে:

“নবী (সা.) মাদিনার গরমে একটি গাধায় চড়ে যেতেন, গাধার ঘাম তাঁর কাপড়ে লাগতো, এবং তিনি সেই কাপড়েই নামাজ পড়তেন।” (ইমাম মালিকের ‘আল-মুয়াত্তা’ অনুসারে)

তবে যদি পবিত্র পানি পাওয়া যায়, তাহলে এ পানি ব্যবহার না করাই উত্তম। আর যদি বিকল্প কিছু না থাকে, তাহলে:

  • প্রথমে এ পানি দিয়ে অজু করবে।
  • তারপর তায়াম্মুম করবে। অগ্রাধিকার পাবে অজু করা।

📌 ঘামের ক্ষেত্রেও একই বিধান: যেহেতু ঘামও গোশতেরই অংশ থেকে তৈরি হয়, তাই সেটা পানি মিশ্রিত হলেও তার হুকুম সুওরের মতই।

তাহাররী (التحرِّي): সন্দেহ দূর করতে চেষ্টা করা

তাহাররী অর্থ: লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো।

যদি কারো কাছে একাধিক পানির পাত্র থাকে

কিছু পবিত্র, কিছু অপবিত্র, এবং তার কাছে কোনো নিশ্চিত পবিত্র পানি নেই— তাহলে করণীয়:

১. যদি পবিত্র পাত্র বেশি হয়

তাহলে অজু ও পান করার জন্য নিজের ধারণা (তাহাররী) অনুযায়ী বেছে নিতে পারবে।

২. যদি অপবিত্র পাত্র বেশি হয়

তাহলে কেবল পান করার জন্য তাহাররী করবে, কিন্তু ওজু করার বদলে তায়াম্মুম করবে।

পোশাকের ক্ষেত্রেও একই

যদি তার সব পোশাকেই সন্দেহ থাকে এবং কোনো নিশ্চিত পবিত্র পোশাক না থাকে, তাহলে তাহাররী করে একটি বেছে নিয়ে নামাজ পড়বে।

তবে যদি পরে বুঝে ফেলে সে ভুল করেছিল, তাহলে নামাজ পুনরায় পড়তে হবে, সময়ের মধ্যে হোক বা পরে।

সন্দেহের ক্ষেত্রে মূলনীতি

যা নিশ্চিত ছিল, সেটিই ধরে নিতে হবে। যেমন: যদি একটি জবাইকৃত পশু পাওয়া যায়, কিন্তু জানি না সেটি মুসলিম জবাই করেছে না অমুসলিম, তাহলে ধরে নিতে হবে তা নাপাক, যতক্ষণ না প্রমাণ হয় যে মুসলিমই জবাই করেছে।

কিন্তু যদি কোথাও পানি পাওয়া যায় এবং সন্দেহ হয় তা নাপাক কিনা, তাহলে ধরে নিতে হবে এটা পবিত্র। কারণ পানি স্বাভাবিক অবস্থায় পবিত্র।

📌 আর যদি সন্দেহ হয় এমন কিছুর উৎসই অজানা— যেমন: কেউ জানে তার সম্পদের কিছু অংশ হারাম, কিন্তু কোন অংশ তা জানে না, তখন তার সাথে লেনদেন মাকরূহ।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x