মানুষের স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক ব্যাপার। কেউ স্বপ্ন দেখে আনন্দিত হয়, আবার কেউ ভয় পায় বা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইসলাম আমাদের স্বপ্ন সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে—কোন স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা, ভালো বা খারাপ স্বপ্ন দেখার পর দোয়া কী করতে হবে, এবং কোন আমল করা প্রয়োজন।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ স্বপ্নকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন:
- আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সুসংবাদসূচক ভালো স্বপ্ন।
- শয়তানের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি ও দুঃস্বপ্ন।
- ব্যক্তির নিজের কল্পনা ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ফলাফল।
ভালো স্বপ্ন দেখলে আনন্দিত হওয়া উচিত, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং কাছের নেককার মানুষদের সাথে শেয়ার করা যেতে পারে। আর খারাপ স্বপ্ন দেখলে ভয় না পেয়ে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু দোয়া ও আমল করা উচিত, যাতে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এই ব্লগপোস্টে আমরা জানবো—
- ভালো স্বপ্ন দেখলে কী করা উচিত।
- খারাপ স্বপ্ন দেখলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত।
- প্রাসঙ্গিক দোয়া ও সহীহ হাদিস।
স্বপ্ন দেখার পর দোয়া ও কারণীয়
আরবি:
الحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ هَذِهِ الرُّؤْيَا وَخَيْرِ مَا فِيهَا، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا فِيهَا
বাংলা উচ্চারণ: আলহামদু লিল্লাহি ওয়াস্-সালাতু ওয়াস্-সালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন খাইরি হাজিহির রু’ইয়া ওয়া খাইরি মা ফিহা, ওয়া আউযু বিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা ফিহা।
অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দরুদ ও সালাম তাঁর রাসূলের ওপর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে এই স্বপ্নের কল্যাণ ও এর মধ্যে যে কল্যাণ আছে তা প্রার্থনা করছি এবং এর অনিষ্ট ও এর মধ্যে যে অনিষ্ট আছে তা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।
মূল হাদিস
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا رَأَى أَحَدُكُمُ الرُّؤْيَا يُحِبُّهَا فَإِنَّهَا مِنَ اللَّهِ، فَلْيَحْمَدِ اللَّهَ عَلَيْهَا وَلْيُحَدِّثْ بِهَا، وَإِذَا رَأَى غَيْرَ ذَلِكَ مِمَّا يَكْرَهُ فَإِنَّهَا مِنَ الشَّيْطَانِ، فَلْيَسْتَعِذْ مِنْ شَرِّهَا، وَلَا يَذْكُرْهَا لِأَحَدٍ فَإِنَّهَا لَا تَضُرُّهُ
বাংলা অনুবাদ: আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “তোমাদের কেউ যদি এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে, তবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে এবং সে স্বপ্নের কথা অন্যদের জানায়। আর যদি সে এমন কিছু দেখে যা অপছন্দনীয়, তবে তা শয়তানের পক্ষ থেকে। সে যেন এর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং কাউকে তা না বলে, তাহলে তা তাকে কোনো ক্ষতি করবে না।”
হাদিসের সূত্র:
- সহিহ বুখারি: (সংখ্যা: ৭০৪৫)
- সহিহ মুসলিম: (সংখ্যা: ২২৬১)
খারাপ স্বপ্ন দেখার পর দোয়া
বাম দিকে তিনবার থুথু ফেলার পর নিচের দোয়াটি করতে হবে।
দোয়া:
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ
উচ্চারণ: আউযু বিখালিমাতিল্লাহিত্ তাম্মাতি মিন গাদ্বাবিহি ওয়া ইক্বাবিহি ওয়া শার্রি ইবাদিহি ওয়া মিন হামাজাতিশ্ শাইয়াত্বীনি ওয়া আই ইয়াহদুরুন।
অর্থ: আমি পরিপূর্ণ কল্যাণময় আল্লাহর বাণীর আশ্রয় চাই, তাঁর ক্রোধ, শাস্তি, তাঁর বান্দাদের অনিষ্ট, শয়তানদের কুমন্ত্রণা এবং তাদের উপস্থিতি থেকে।

📜 হাদিস:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ: “إِذَا رَأَى أَحَدُكُمُ الرُّؤْيَا يَكْرَهُهَا، فَلْيَبْصُقْ عَنْ يَسَارِهِ ثَلَاثًا، وَلْيَسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنْ شَرِّهَا، فَإِنَّهَا لَنْ تَضُرَّهُ.”
বাংলা অনুবাদ: আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যদি তোমাদের কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে, তবে সে যেন তার বাম দিকে তিনবার থুথু দেয় এবং আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। তাহলে সে স্বপ্ন তাকে কোনো ক্ষতি করবে না।”
হাদিস নাম্বার:
- সহিহ বুখারি: ৫০৪৫
- সহিহ মুসলিম:২২২৬১
ভালো ও খারাপ স্বপ্ন দেখার পর দোয়া পড়ার ফজিলত
স্বপ্ন সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ভালো স্বপ্নের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং কীভাবে খারাপ স্বপ্ন থেকে রক্ষা পেতে হবে। নিচে স্বপ্ন দেখার পর দোয়া পড়ার গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত উল্লেখ করা হলো—
১. ভালো স্বপ্নের দোয়া পড়ার ফজিলত
📌 আল্লাহর নেয়ামতের স্বীকৃতি: ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। তাই এই দোয়া পড়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি এবং তাঁর দেওয়া কল্যাণ কামনা করি।
📌 সুন্দর বাস্তবতার জন্য দোয়া: দোয়াটি পড়ার মাধ্যমে আমরা স্বপ্নের মধ্যে থাকা কল্যাণ আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।
📌 হতাশা থেকে বেঁচে থাকা: যদি কোনো স্বপ্নের অর্থ আমাদের বুঝতে অস্পষ্ট হয়, তাহলে এই দোয়া আমাদের অন্তরে প্রশান্তি এনে দেয় এবং অযথা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখে।
২. খারাপ স্বপ্নের দোয়া পড়ার ফজিলত
📌 শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তা: রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। এই দোয়া শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
📌 আতঙ্ক ও ভয় দূর করা: অনেক সময় দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ আতঙ্কিত হয়। দোয়া পড়লে মন শান্ত হয় এবং ভয় কেটে যায়।
📌 খারাপ স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয় না: হাদিসে এসেছে, যদি কেউ এই দোয়া পড়ে এবং কাউকে খারাপ স্বপ্নের কথা না বলে, তাহলে তা কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (সহিহ মুসলিম: ২২৬১)
📌 শয়তানের প্রভাব দুর্বল হয়ে যায়: খারাপ স্বপ্নের পর দোয়া করলে এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নির্দেশিত আমল (বাম দিকে তিনবার থুথু দেওয়া, আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া) করলে শয়তান আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
স্বপ্ন দেখার পর করণীয় বিষয়ে প্রশ্ন ও উত্তর
১. স্বপ্ন কয় প্রকার ও কী কী?
✅ উত্তর: হাদিসের আলোকে স্বপ্ন তিন প্রকার—
1️⃣ ভালো স্বপ্ন: এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং সুসংবাদ বহন করে।
2️⃣ খারাপ স্বপ্ন: এটি শয়তানের পক্ষ থেকে আসে এবং মানুষকে ভয় দেখায়।
3️⃣ মানসিক প্রভাব ও কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন: এটি মানুষের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন, কোনো প্রকৃত তাৎপর্য থাকে না।
২. ভালো স্বপ্ন দেখলে কী করণীয়?
✅ উত্তর:
📌 আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করা।
📌 স্বপ্নের ভালো দিকের জন্য দোয়া করা।
📌 নেককার ব্যক্তিদের সাথে শেয়ার করা (যদি প্রয়োজন মনে হয়)।
📌 খারাপ ব্যাখ্যা দেওয়া ব্যক্তিদের থেকে স্বপ্ন গোপন রাখা।
৩. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কী করা উচিত?
✅ উত্তর:
📌 “أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ” (আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রজীম) বলা।
📌 বাম দিকে তিনবার থুথু মারা (শুষ্কভাবে)।
📌 আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া ও দোয়া পড়া।
📌 স্বপ্নটি কারও কাছে প্রকাশ না করা।
📌 শয্যা পরিবর্তন করা বা পাশ পরিবর্তন করা।
📌 সম্ভব হলে উঠে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা।
৪. স্বপ্নের দোয়া পড়ার কী ফজিলত আছে?
✅ উত্তর:
📌 ভালো স্বপ্নের দোয়া পড়লে তা কল্যাণকর হয়ে ওঠে।
📌 খারাপ স্বপ্নের দোয়া পড়লে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
📌 মন প্রশান্ত হয় এবং অযথা দুশ্চিন্তা দূর হয়।
📌 খারাপ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না।
৫. স্বপ্ন কি সবসময় সত্য হয়?
✅ উত্তর:
📌 হ্যাঁ, ভালো স্বপ্ন সত্য হতে পারে, বিশেষত যদি এটি নেককার ব্যক্তির স্বপ্ন হয়।
📌 রাসূল ﷺ বলেছেন, “নবুয়ত বন্ধ হওয়ার পর ভালো স্বপ্নই একমাত্র সত্য ও শুভ সংবাদ।” (সহিহ বুখারি: ৬৯৮২)
📌 তবে সব স্বপ্নের বাস্তবতা নাও থাকতে পারে।
৬. রাতে দুঃস্বপ্ন এড়ানোর জন্য কী করতে হবে?
✅ উত্তর:
📌 রাতে ঘুমানোর আগে দোয়া, আয়াতুল কুরসি ও সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস পড়া।
📌 অজু করে ঘুমানো।
📌 ডান কাতে শুয়ে ঘুমানো এবং “বিসমিল্লাহ” বলে শোয়া।
📌 শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া পড়া।
৭. স্বপ্নের ব্যাখ্যা কাকে জিজ্ঞেস করা উচিত?
✅ উত্তর:
📌 বিজ্ঞ আলেম বা নেককার ব্যক্তিদের।
📌 এমন কাউকে নয়, যে ভুল বা খারাপ ব্যাখ্যা দিতে পারে।
৮. খারাপ স্বপ্ন বারবার দেখলে কী করা উচিত?
✅ উত্তর:
📌 শয়তানের ধোঁকা মনে করে আমল করা।
📌 রাতের দোয়া ও প্রতিরক্ষামূলক আমল জোরদার করা।
📌 বেশি বেশি ইস্তিগফার ও নফল নামাজ আদায় করা।
📌 প্রয়োজন হলে রুকইয়াহ (কুরআনিক চিকিৎসা) করা।
৯. স্বপ্ন কি ওহির অংশ?
✅ উত্তর: সাধারণ মানুষদের স্বপ্ন ওহি নয়। তবে নবীদের স্বপ্ন ওহি হতে পারে, যেমন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্বপ্নে ছেলে কুরবানির নির্দেশ পাওয়া। রাসুল ﷺ বলেছেন, “সৎকর্মশীল ব্যক্তির ভালো স্বপ্ন নবুয়তের অংশবিশেষ।” (সহিহ বুখারি: ৬৯৮৩)
১০. কেউ যদি খারাপ স্বপ্নের দোয়া ভুলে যায়, তবে কী করা উচিত?
✅ উত্তর: যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করা। বাম দিকে তিনবার থুথু মারা এবং পাশ পরিবর্তন করা। অন্যদের কাছে স্বপ্ন প্রকাশ না করা।