স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা – ভালোবাসা একটি মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। যেমন খাবার প্রয়োজন পেটের ক্ষুধা মেটাতে, তেমনি ভালোবাসা প্রয়োজন মনকে সন্তুষ্ট করতে। তবে ক্ষুধার্ত হলে যেমন কোনো খাবার খেতে পারি না, তেমনি ভালোবাসা পেতে হলে কিছু নিয়ম ও ত্যাগ মেনে চলতে হয়।
বিশ্বের সকল মানুষই ভালোবাসা পেতে আগ্রহী। স্বামী-স্ত্রীও একে অপরের কাছ থেকে প্রকৃত ভালোবাসা পেতে চায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা সেই কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা পায় না। ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার জন্য একটি অনন্য দিক নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের বিবাহ কেবলমাত্র পার্থিব সুখে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইসলামের প্রতিটি নিয়ম বিশ্বের মঙ্গলার্থে প্রতিষ্ঠিত।
একইসঙ্গে, ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাকে পরকালীন মুক্তির পথ এবং পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই মুসলিম দাম্পত্য জীবন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি অনন্য পথ।
স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা এবং ভয়ানক অন্ধকার
আজকের বিশ্বে ভয়ানক অন্ধকার বিরাজ করছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমৃদ্ধ জীবনযাপন, নগ্ন লেখক এবং মডেলদের আধুনিক পতিতাবৃত্তি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে পৃথিবী থেকে ভালোবাসা নামক স্বর্ণ হরিণ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্রমাগত মতভেদ বিরাজ করছে। তারা একে অপরকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের জীবনযাপন এবং ভিডিও দেখার ফলে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী ছিল ভালোবাসার যৌথ নাম। এজন্য আজকের এই প্রবন্ধে, “স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত?” বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করছি। আমি আশা করি, সকলেই এই লেখাটি পড়ে উপকৃত হবেন।
স্বামী স্ত্রীর মধুর সম্পর্কের ৮টি উপায়
১. দুজনেরই সবসময় পরিষ্কার ও পবিত্র থাকা উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘পবিত্রতা ঈমানের অংশ।’ (সহীহ মুসলিম-২২৩)
কারণ স্বাভাবিকভাবে মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। তাই আপনার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পবিত্রতা আপনার সঙ্গীকে আকর্ষণ করবে। ফলে তার আপনার প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।
২. দুজনেরই অপ্রয়োজনীয় শরীরের লোম পরিষ্কার করা উচিত। যেমন বগল, নাভির নিচে লোম, নখ ইত্যাদি।
এসব বিষয় আপনার আবেগিক স্বাদকে উপস্থাপন করে; এগুলো অপবিত্র থাকলে আপনার সঙ্গীর নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। এটি ভালোবাসার পথে বাধা সৃষ্টি করবে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘পাঁচটি জিনিস মানুষের প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। খৎনা করা, নাভির নিচে লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা এবং মুচি করা।’ (সহীহ বুখারী-৫৬৯)
৩. ভালো সুগন্ধি ব্যবহার করা। সুগন্ধির বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, এটি আপনার সঙ্গীকে আবেগিকভাবে খুশি করতে কার্যকর। এতে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন: আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুগন্ধি দিতাম। তারপর তিনি তার স্ত্রীর কাছে যেতেন। (সহীহ বুখারী – ২৬৩)
৪. সঙ্গীর সামনে অন্য কারও সৌন্দর্যের প্রশংসা থেকে বিরত থাকা। এটি সঙ্গীকে বিরক্ত করতে পারে।
প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রশংসা শুনতে মানুষ ভালোবাসে। অন্য কারও প্রশংসা তার মন খারাপ করতে পারে।
৫. স্ত্রীর রূপের প্রশংসা করা। প্রায় সব মানুষই তাদের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে। আর প্রিয়জনের মুখ থেকে তা শুনে মন এবং শরীর খুশি হয়। এতে ভালোবাসার অনেক বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
৬. স্বামী-স্ত্রী একে অপরের মুখে খাবার দেওয়া। পানীয় পাত্রের অংশে ঠোঁট রেখে অপরজনের মুখ দিয়ে পানি পান করা।
৭. স্বামী-স্ত্রীর খেলা। যেমন ভলিবল, বাস্কেটবল, ক্যারাম ইত্যাদি। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করা।
৮. স্ত্রীকে ভালোবাসি বলা। একে অপরকে উপহার দেওয়া।
স্বামী স্ত্রীর গভীর প্রেম ও চরম আনন্দ
ইসলামে, সহবাসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। এটি ব্যর্থতার ছাড়াই ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর একটি কার্যকর উপায়। সহবাসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার পায়। এতে তারা কেবল শারীরিকভাবে একে অপরের মধ্যে প্রবেশ করে না, বরং মানসিকভাবে অনেক বেশি প্রবেশের সুযোগ পায়।
স্বামী স্ত্রী সহবাস ও গভীর প্রেমের বন্ধন
১. সহবাসের নিয়তকে পবিত্র রাখা। সহবাসের শুরুতে সওয়াবের নিয়ত করা।
যেমন চরিত্রকে বিপথগামীতা থেকে রক্ষা করা। সৎ সন্তান জন্মদান এবং পরকালে মুক্তি লাভ করা ইত্যাদি।
একজন সাহাবি রাসূলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের কেউ যদি তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, তাহলে কি সওয়াব পাওয়া যাবে?” রাসূলুল্লাহ বললেন, “তুমি কি মনে করো যে, যদি সে ব্যভিচার করে, তবে এটি পাপ হবে না? তাহলে হালাল সহবাসের জন্য সওয়াব কেন পাবে না?” (সহীহ মুসলিম – ৭২০)
২. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ধরে রাখতে সবসময় দোয়া করা। এমনকি সহবাসের সময়ও দোয়া করা উচিত। নিচের দোয়াটি সমন্বয়ের দোয়া হিসেবে পরিচিত।
بِسْمِ اللّهِ اللّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَ جَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا
উচ্চারণ – বিসমিল্লাহি, আল্লাহুম্মা জান্নিবানাশ-শায়তানা ওয় জান্নিবিশ-শায়তানা মা রাযাকতানা।
অনুবাদ – আল্লাহ তা’আলার নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ, আমাদের থেকে শয়তানকে দূরে রাখুন। এবং আমাদের সন্তানকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন। (সহীহ বুখারী – ১৪১)
৩. সহবাসের জন্য সর্বোত্তম আসন গ্রহণ করা। এই ক্ষেত্রে, প্রতিটি ব্যক্তি তার সুবিধা এবং ইচ্ছা অনুযায়ী আসন নিতে পারেন।
চাইলে শুয়ে বা বসে বা দাঁড়িয়ে। স্ত্রী স্বামীর উপরে থাকতে পারে। আপনি ইচ্ছা অনুযায়ী আসন নিতে পারেন।
নবীজির জীবন থেকে কিছু সুন্দর উদাহরণ
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার স্ত্রী আয়েশার সাথে গভীর ভালোবাসার একটি উদাহরণ স্থাপন করেছেন। যেমন, তিনি সবসময় আয়েশার সাথে মধুর ব্যবহার করতেন এবং তাকে বিশেষ যত্নে রাখতেন। নবীজির এই ভালোবাসা এবং যত্ন আমাদের জন্য একটি মডেল হতে পারে।
নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রায়ই তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতেন এবং তার খুশির জন্য নানা রকমের খেলা খেলতেন। একবার তিনি আয়েশাকে বলেছিলেন, “তুমি আমার জন্য সুগন্ধি ফুলের মতো।” (মুসলিম)
আবার একবার, যখন আয়েশা তার গলার হার হারিয়ে ফেলেছিলেন, নবীজি তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন এবং তাকে সাহস যুগিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালোবাসা এবং যত্নের একটি অসাধারণ উদাহরণ।
স্বামী স্ত্রীর একসাথে ভ্রমণ : ভালোবাসার বন্ধনের উপায়
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় করতে একসাথে ভ্রমণ করাও একটি কার্যকর উপায়। আমাদের প্রিয় নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রায়ই তার স্ত্রীর সাথে ভ্রমণে যেতেন এবং তাদের সময় কাটাতেন।
নবীজি যখন ভ্রমণে যেতেন, তখন তিনি লটারির মাধ্যমে তার স্ত্রীর নাম নির্বাচন করতেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি সঙ্গীর সাথে বিশেষ সময় কাটাতেন, যা তাদের ভালোবাসা আরও গভীর করত।
একবার, বাণু মুস্তালিকের যুদ্ধে নবীজি তার স্ত্রী আয়েশার সাথে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এই ভ্রমণে তারা অনেক সময় একসাথে কাটিয়েছিলেন এবং তাদের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ : ভালোবাসার ভিত্তি
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালো যোগাযোগ ভালোবাসার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একে অপরের সাথে খোলামেলা কথা বলা, নিজেদের অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা শেয়ার করা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর প্রতি ভালো।” (তিরমিজি)
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য : সুখী দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য ও বোঝাপড়া সুখী দাম্পত্য জীবনের অন্যতম চাবিকাঠি। একে অপরের মতামতকে সম্মান করা, পরস্পরের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং সমস্যাগুলি মিলে মিশে সমাধান করা উচিত।
পরকালে মুক্তির পথ
ইসলামে, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা কেবলমাত্র পার্থিব জীবনের জন্য নয়, বরং পরকালে মুক্তির পথ হিসেবেও বিবেচিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সঠিকভাবে ভালোবাসা ও সেবা করলে তা পরকালে তাদের মুক্তির কারণ হতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে একজন স্বামীর প্রতি দয়া প্রদর্শন করলে এবং স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করলে তা তার পরকালে মুক্তির কারণ হবে।” (সহীহ বুখারী)
সমাপ্তি
ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা একটি অনন্য ও পবিত্র সম্পর্ক। এটি কেবলমাত্র পার্থিব সুখের জন্য নয়, বরং পরকালীন মুক্তির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্মান, সামঞ্জস্য ও বোঝাপড়া একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি।
নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। তার দাম্পত্য জীবনের উদাহরণ আমাদের জন্য একটি আদর্শ হতে পারে। যদি আমরা তার আদর্শকে অনুসরণ করি, তবে আমাদের দাম্পত্য জীবন ভালোবাসায় পূর্ণ হবে এবং আমরা সুখী ও সফল দাম্পত্য জীবন যাপন করতে পারব।
আশা করি এই প্রবন্ধটি পড়ে আপনি ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার গুরুত্ব ও মানে বুঝতে পেরেছেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।