হযরত সুলাইমান (আঃ) এর বিবাহ । একটি বিস্ময়কর অধ্যায়

পোস্টটি শেয়ার করুন

হযরত সুলাইমান (আ.), যিনি একজন মহান নবী এবং রাজা ছিলেন। ইসলামি ইতিহাসে তাঁর জ্ঞান, ন্যায়পরায়ণতা, এবং প্রজ্ঞার জন্য পরিচিত। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে অসাধারণ শিক্ষা। এখানে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর বিবাহ ও তাঁর স্ত্রীদের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করছি। কেননা তাঁর বিবাহিত জীবন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও আল্লাহর পথে চলার প্রেরণা ও গল্প

সুলাইমান (আঃ) এর বিবাহিত জীবনের প্রেক্ষাপট

হযরত সুলাইমান (আ.) ছিলেন নবী হযরত দাউদ (আ.)-এর পুত্র। তিনি কেবল নবী ছিলেন না, বরং অত্যন্ত প্রতিভাবান ও প্রভাবশালী শাসকও ছিলেন। তাঁর শাসনকালে, তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বিবাহ করেছিলেন। তাঁর বিবাহিত জীবনের ঘটনা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যা মুসলিমদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।

সুলাইমান (আঃ) এর বিশেষ গুণাবলী

আল্লাহ তাআলা হযরত সুলাইমান (আ.)-কে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন, যা অন্য কারও জন্য নির্ধারিত হয়নি। তিনি প্রার্থনা করেছিলেন,

“হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন এক রাজত্ব দান করুন, যা আমার পরে আর কারও জন্য উপযুক্ত না হয়” (সূরা সাদ: ৩৫)।

আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁকে অদ্বিতীয় ক্ষমতা ও রাজত্ব দান করেছিলেন।

বিশেষ ক্ষমতাসমূহ

১. জিন ও শয়তানদের নিয়ন্ত্রণ: সুলাইমান (আঃ) জিন ও শয়তানদের তাঁর কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারতেন। তাঁরা বড় বড় নির্মাণকাজ, পাত্র তৈরি, এবং অন্যান্য কঠিন কাজ সম্পন্ন করত।

২. বাতাসের নিয়ন্ত্রণ: তিনি বাতাসকে তাঁর ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারতেন। বাতাস তাঁকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত পৌঁছে দিত।

৩. পাখি ও প্রাণীদের ভাষা বোঝা: তিনি পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের ভাষা বুঝতেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা রাখতেন।

রাণী বিলকিস ও হযরত সুলাইমান আঃ এর বিবাহ

রাণী বিলকিস এবং হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর বিবাহ ইসলামী ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। কুরআনে এই বিষয়ে সরাসরি বিবাহের প্রসঙ্গ উল্লেখ না থাকলেও, তাফসীর ও ইসলামিক ঐতিহ্যের বর্ণনায় তাদের মধ্যে একটি সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে।

হযরত সুলাইমান (আঃ) এর বিবাহ ১
হযরত সুলাইমান (আঃ) এর বিবাহ । একটি প্রতীকী ছবি

কুরআনের বিবরণ

কুরআনের সূরা আন-নামল (২৭:২২-৪৪)-এ রাণী বিলকিস এবং হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে:

  • হুদহুদ পাখির বার্তা: হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর বাহিনীতে একটি পাখি ছিল, যার নাম ছিল হুদহুদ। সেই পাখি রাণী বিলকিসের রাজ্যের খবর নিয়ে আসে এবং জানায় যে তিনি এবং তার প্রজারা সূর্যপূজা করেন।
  • চিঠি পাঠানো: হযরত সুলাইমান (আঃ) রাণী বিলকিসকে একটি চিঠি পাঠান, যাতে তাকে একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করতে এবং আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়।
  • রাণী বিলকিসের প্রতিক্রিয়া: তিনি প্রথমে তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং পরে সুলাইমান (আঃ)-এর প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
  • প্রাসাদের ঘটনা: রাণী বিলকিস যখন সুলাইমান (আঃ)-এর দরবারে পৌঁছান, তখন তিনি তার প্রজ্ঞা এবং আল্লাহর শক্তি দেখে মুগ্ধ হন। বিশেষ করে সুলাইমান (আঃ) তার সিংহাসন অলৌকিকভাবে তার কাছে নিয়ে আসেন, যা তাকে আরও প্রভাবিত করে।

ঐতিহাসিক এবং তাফসীরের ব্যাখ্যা

তাফসীর ও ঐতিহাসিক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে রাণী বিলকিস হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব এবং আল্লাহর প্রতি নিবেদন দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি ইসলামে দীক্ষিত হন এবং হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

শিক্ষণীয় বিষয়

এই ঘটনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে:

  • আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে শিক্ষা: এই কাহিনী আল্লাহর অদ্বিতীয় শক্তি ও প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটায়।
  • প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক দক্ষতা: হযরত সুলাইমান (আঃ) রাণী বিলকিসের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি নজির স্থাপন করেন।
  • সত্য গ্রহণের উদাহরণ: রাণী বিলকিস সত্য উপলব্ধি করে ইসলামে দীক্ষিত হন, যা একজন নেতার নম্রতা এবং বিচক্ষণতার প্রতীক।

হযরত সুলাইমান আঃ এর অন্যান্য বিবাহ ও স্ত্রীদের সংখ্যা

হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম)-এর স্ত্রীদের সংখ্যা সহীহ হাদিস থেকে জানা যায়। সহীহ আল-বুখারী (৫২৪২) এবং মুসলিম (১৬৫৪)-এ তাঁর স্ত্রীদের সংখ্যার বয়ান রয়েছে।

সহীহ হাদিসে উল্লিখিত ঘটনা

হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) একবার বলেছিলেন:

“আমি আজ রাতে আমার একশত স্ত্রীদের কাছে যাব, এবং প্রত্যেক স্ত্রী একটি করে সন্তান জন্ম দেবে, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধে অংশ নেবে।” তখন একজন ফেরেশতা তাকে বলেছিলেন: ‘ইন শা আল্লাহ’ বলুন। কিন্তু সুলাইমান (আঃ) তা বলতে ভুলে যান। তারপর তিনি স্ত্রীয়েদের কাছে গেলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ছাড়া কেউ সন্তান জন্ম দেননি, এবং সেই সন্তানও ছিল অসম্পূর্ণ বা অপূর্ণাঙ্গ।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন: “যদি তিনি ‘ইন শা আল্লাহ’ বলতেন, তাহলে তার কথা সত্য হত এবং তার চাওয়া পূর্ণ হত।” (মুসলিম : ১৬৫৪)

স্ত্রীদের সংখ্যার বিভিন্ন বর্ণনা

  • কিছু হাদিসে স্ত্রীদের সংখ্যা ৯০ বলা হয়েছে।
  • অন্য কিছু বর্ণনায় সংখ্যা ৯৯ উল্লেখ করা হয়েছে।
  • এক হাদিসে ১০০ স্ত্রীর কথা বলা হয়েছে।

ইমাম ইবনে হাজর (রহঃ) তার ফতহুল বারি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সংখ্যার এই বৈচিত্র্যের কারণ হতে পারে:

  • সংখ্যার পূর্ণতা যোগ করা: ৯৯ বা ৯০ কে পূর্ণ সংখ্যা হিসেবে ১০০ বলা হয়েছে।
  • ভিন্ন সূত্র: বর্ণনাকারীদের মধ্যে বিভিন্নতার কারণে সংখ্যা ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ হয়েছে।

ইসরাঈলী বর্ণনার তথ্য

ইবনে কাসির তার গ্রন্থ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-তে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর স্ত্রীর সংখ্যা ইসরাঈলী বর্ণনা অনুসারে ১,০০০ জন ছিল। এই সংখ্যা নির্ভর করে ইসরাঈলীদের ঐতিহ্যিক কাহিনির উপর, যা আমরা নিশ্চিতভাবে সত্য বলি না, আবার মিথ্যাও বলি না।

এই সংখ্যার পেছনের কারণ

আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তার অবাধ কৃপায় যা ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহর নির্দেশনায় হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে এক বিশাল সাম্রাজ্য ও প্রচণ্ড ক্ষমতা দান করা হয়েছিল, যা অন্য কারো ছিল না। তার এই বিপুল সংখ্যক স্ত্রী থাকা আল্লাহ প্রদত্ত সেই ক্ষমতার একটি অংশ।

হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর এই ক্ষমতা বা নারীদের সংখ্যা তার জন্য কোনো নিন্দার বিষয় নয়। বরং এটি তার রাজত্বের পূর্ণতা এবং শক্তির পরিচায়ক। তার ইচ্ছা ছিল এই স্ত্রীয়েদের মাধ্যমে এমন বীর সন্তান জন্ম দেওয়া, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে।

শিক্ষা ও দৃষ্টান্ত

১. ন্যায়পরায়ণতা: বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা জরুরি। সুলাইমান (আঃ) এর জীবন থেকে আমরা শিখি যে, স্ত্রীদের অধিকার রক্ষা করা একজন মুসলিম পুরুষের দায়িত্ব।

২. পরিবারের গুরুত্ব: হযরত সুলাইমান (আঃ) দেখিয়েছেন যে, পরিবার একটি সমাজের ভিত্তি। পরিবারে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখলে সমাজেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

৩. আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা: প্রতিটি কাজে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর করা উচিত। সুলাইমান (আঃ)-এর ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই সফল হয় না।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x