হায়েজ কি। হায়েজ কত দিন থাকে । হায়েজ অবস্থায় কি কি করা যাবে না

পোস্টটি শেয়ার করুন

হায়েজ বা ঋতুস্রাব নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক প্রক্রিয়া। এটি একটি স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়া যা শরীরের হরমোনজনিত পরিবর্তনের ফলস্বরূপ ঘটে। তবে মুসলিম নারীদের জন্য হায়েজ চলাকালীন সময়ে কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে। এই পোস্টে আমরা – হায়েজ কি? হায়েয কত দিন থাকে? হায়েজ অবস্থায় কি কি করা যাবে না? এ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন ও বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

হায়েজ কি?

হায়েজের ভাষাগত অর্থ ও তা সম্পর্কে ইসলামী ব্যাখ্যা:

হায়েজ (الحيض) শব্দটি আরবিতে “সিলান” বা “প্রবাহ” অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বলা হয়: “حَاضَ الوَادِي” (হাদ ওয়াদি), অর্থাৎ, “ওয়াদি প্রবাহিত হয়েছিল”। এবং হায়েজের রক্তকে এমন নামকরণ করা হয়েছে কারণ এটি প্রবাহিত হয় বা সিলান ঘটে।

বিদ্বানরা হায়েজের রক্তকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন: “হায়েজের রক্ত হল সেই রক্ত যা মহিলার জরায়ু থেকে বের হয়, যখন সে পূর্ণবয়স্ক হয় এবং এটি তার মাসিক চক্রের অংশ হিসেবে নিয়মিতভাবে ঘটে।”

অর্থাৎ, যখন একটি মেয়ে পূর্ণবয়স্ক হয়, তখন তার শরীর থেকে প্রায়শই প্রতি মাসে এই রক্ত বের হয়, যা সাধারণত ৬ দিন, ৭ দিন, বা তার থেকে কম বা বেশি হতে পারে, মহিলা অনুযায়ী তার নির্দিষ্ট সময়সীমা অনুসারে।

হায়েজের রক্তের রঙ সাধারণত কালো হয় এবং এর সঙ্গে একটি অস্বস্তিকর গন্ধ থাকে, এবং এটি প্রাথমিকভাবে কিছু ব্যথা ও অস্বস্তি নিয়ে আসে। এই রক্তই হায়েজের রক্ত, এবং যা কিছু রক্ত বের হয়, যা হায়েজের নিয়মিত সময়ের বাইরে বা নির্ধারিত সময়ের পর আসে, তাকে “ইস্তাহাদা” (استحاضة) বলা হয়।

ইস্তাহাদার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইসলামী স্কলাররা: “ইস্তাহাদা হল, এমন রক্তস্রাব যা স্বাভাবিক সময়ের বাইরে ঘটে।”

মহিলার উপর নামাজ, রোজা বা যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকার বিধান শুধুমাত্র হায়েজ বা নফাস (জন্মপরবর্তী রক্তপাত) সম্পর্কিত। অন্যান্য যেকোনো রক্তস্রাব, যেমন ইস্তাহাদা, নামাজ, রোজা, এবং যৌন সম্পর্কের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে না।

অতএব, ইস্তাহাদা বা অন্য যেকোনো অস্বাভাবিক রক্তস্রাব থাকা অবস্থায় মহিলাকে “পবিত্র” হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং সে তার নামাজ, রোজা পালন করতে পারে এবং তার স্বামীও তার সঙ্গে সহবাস করতে পারেন।

হায়েজের মেয়াদ বা হায়েজ কত দিন থাকে?

হায়েজ সাধারণত ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যে স্থায়ী হয়।

  • সর্বনিম্ন সময়: ৩ দিন (৭২ ঘণ্টা)।
  • সর্বাধিক সময়: ১০ দিন (২৪০ ঘণ্টা)।

১০ দিনের বেশি রক্তক্ষরণ হলে তা ইস্তিহাযা (অসামান্য রক্তপাত) হিসেবে গণ্য হবে। হানাফি ফিকহ অনুযায়ী, হায়েজের দিন নির্ধারণে পূর্ববর্তী অভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

হায়েজ নিয়ে বিস্তারিত
হায়েজ নিয়ে বিস্তারিত

বিভিন্ন মাযহাবে হায়েজের সর্বনিম্ন ও সর্বাধিক সময়

ইসলামী ফিকাহে হায়েজের সময়কাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। এখানে আমরা সর্বনিম্ন এবং সর্বাধিক হায়েজের সময় নিয়ে আলোচনা করব, যেটি উল্লিখিত কিছু প্রধান মাযহাবের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

হায়েজের সর্বনিম্ন সময়

হায়েজের সর্বনিম্ন সময় সাধারণত এক দিন ও এক রাত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মতামত শাফি’ই ও হাম্বলি মাযহাব অনুসরণকারী علماءদের মতে সঠিক। অর্থাৎ, যদি কোনো নারী একদিন ও এক রাতের কম সময় রক্তপাত অনুভব করেন, তবে সেটি হায়েজ হিসেবে গণ্য হবে না। এর ফলে, ঐ মহিলাকে নামাজ এবং রোজা রাখতে হবে এবং কোনো নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না।

শাফি’ই ও হাম্বলি মাযহাবের মতে:

  • অন্তত একদিন ও এক রাত (২৪ ঘণ্টা) রক্তপাত হলে তা হায়েজ হিসেবে গণ্য হবে।
  • এরচেয়ে কম রক্তপাত হলে সেটি ইস্তাহাদা (অস্বাভাবিক রক্তস্রাব) হিসেবে গণ্য হবে এবং নামাজ-রোজার উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না।

হায়েজের সর্বাধিক সময়

হায়েজের সর্বাধিক সময় ১৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে, যা গণনা অনুযায়ী মাযহাবের অধিকাংশ পণ্ডিতরা গ্রহণ করেছেন। এই সময়সীমার পর রক্তপাত যদি অব্যাহত থাকে, তবে সেটি ইস্তাহাদা হিসেবে বিবেচিত হবে।

জমহুর আলেমদের মতে:

  • হায়েজের সর্বাধিক সময় হল ১৫ দিন (এবং এর চেয়ে বেশি সময় ধরে চললে তা ইস্তাহাদা হিসেবে গণ্য হবে)।
  • এ বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম শাফি (রহ.), এবং ইমাম আহমদ ইবন হানবল (রহ.) -এর মতামত একমত।

রেফারেন্স:

  • ইমাম ইবন কুদামা (রহ.) বলেন: “এটি শরিয়ত দ্বারা নির্ধারিত না হওয়া সত্ত্বেও, হায়েজের সবচেয়ে বেশি সময় হচ্ছে ১৫ দিন।” (المغني, ১/২২৫)
  • শায়খ ইবন উসাইমিন (রহ.) বলেন: “প্রথমে হায়েজের সময় নির্ধারণ করা হয়নি, তবে পরবর্তী সময়ে ১৫ দিনকে সর্বাধিক সময় হিসেবে গৃহীত হয়েছে।” (الشرح الممتع, ১/৪৭১) বিস্তারিত পড়ুন এখান থেকে

হায়েজের মধ্যে যদি রক্ত ১৫ দিন বেশি থাকে, তবে তা ইস্তাহাদা হিসাবে গণ্য হবে:

ইমাম ইবন উথাইমিন (রহ.) আরও বলেন: “যদি কোনো মহিলার রক্ত ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকে, তবে এটি ইস্তাহাদা হিসেবে গণ্য হবে এবং ঐ মহিলা নামাজ, রোজা, এবং যৌন সম্পর্ক রাখতে সক্ষম হবে।”

মাযহাবের ভিন্নতা

মালিকি মাযহাব: এখানে হায়েজের সর্বনিম্ন সময় সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই, তবে ঐ মহিলার রক্তপাত যদি ১৫ দিন বা তার বেশি হয়, তবে সেটি ইস্তাহাদা হিসেবে গণ্য হবে।

হানাফি মাযহাব: হায়েজের সর্বনিম্ন সময় ৩ দিন ও রাত (কিছু রিপোর্টে ২ দিনও বলা হয়েছে) এবং সর্বাধিক সময় ১৫ দিন। এর চেয়ে কম বা বেশি রক্তপাত ইস্তাহাদা হিসেবে গণ্য হবে।

হায়েজ অবস্থায় কি কি করা যাবে না?

হায়েজের সময় নারীদের জন্য কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। এগুলো ইসলামের শিষ্টাচার এবং পবিত্রতার বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত।

নামাজ ও রোযা

  • এই সময়ে নামাজ পড়া এবং রোযা রাখা নিষিদ্ধ।
  • তবে রোযাগুলি পরবর্তীতে কাযা করতে হবে, কিন্তু নামাজের কাযা নেই।

মসজিদে প্রবেশ

  • মসজিদে প্রবেশ করা বা সেখানে অবস্থান করা যাবে না।

তাওয়াফ

  • কাবা শরীফের তাওয়াফ করা যাবে না।

কুরআন স্পর্শ ও তিলাওয়াত

  • কুরআন স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। তিলাওয়াতও নিষিদ্ধ, তবে প্রয়োজনীয় দোয়া বা যিকির পড়া যাবে।

যৌন সম্পর্ক

  • স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হারাম। তবে অন্যান্য ঘনিষ্ঠতা অনুমোদিত।

আল-মাবসূতের ব্যাখ্যা

ইমাম সারাখসী বলেন, “হায়েজ অবস্থায় স্বামীর জন্য স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তবে শরীরের ওপরের অংশে ঘনিষ্ঠতা অনুমোদিত।” (আল-মাবসূত, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬০)

বাদায়েউস সানায়ের ব্যাখ্যা

ইমাম কাসানী বলেন, “হায়েজ অবস্থায় নামাজ ও রোযা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। তবে তাওবা ও ইস্তিগফার করা, যিকির পাঠ করা এবং ইলম অর্জনে কোন বাধা নেই।” (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪২)

হায়েজ অবস্থায় করণীয় কাজসমূহ

যদিও হায়েজ অবস্থায় কিছু কাজ নিষিদ্ধ, তবুও এই সময়ে নারীরা বিভিন্ন ইবাদত ও আমল করতে পারেন। যেমন:

  • দোয়া ও যিকির করা।
  • ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা।
  • তাফসির বা হাদিস অধ্যয়ন করা।

কুরআন ও হাদিসে হায়েজের নির্দেশনা

কুরআন ও হাদিসে হায়েজ সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কুরআনের আয়াত:

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন:

“وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيدِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيدِ وَلا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ وَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّـهُ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ التَّوَابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ”

এই আয়াতের তর্জমা: “তারা তোমাকে হায়েজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এটা অপবিত্র। সুতরাং, তোমরা হায়েজ অবস্থায় নারীদের থেকে দূরে থাকো এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে মিলিত হয়ো না।” (সূরা বাকারা: ২২২)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, হায়েজ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ।

হাদিসের রেফারেন্স

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“إِذَا حَاضَتِ الْمَرْأَةُ فَذَرُوهَا حَتَّى تَطْهُرَ فَإِذَا تَطَهَّرَتْ فَأْتُوهَا مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّـهُ”

এই হাদিসের তর্জমা: “যখন তুমি হায়েজ দেখবে, তখন নামাজ বন্ধ রাখো, আর যখন তা শেষ হবে, তখন গোসল করো এবং নামাজ শুরু করো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৯৫)

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হয় যে, হায়েজ চলাকালীন নামাজ পড়া নিষিদ্ধ, কিন্তু হায়েজ শেষ হওয়ার পর পবিত্রতা অর্জন করে ইবাদত শুরু করা উচিত।

হানাফি মাযহাবের মতামত

হানাফি মাযহাবে হায়েজ সম্পর্কিত বেশ কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:

  • রক্তের রং এবং প্রকৃতি (লাল, বাদামী, হলুদ) বিবেচনায় নেওয়া হয়।
  • ৩ দিন পূর্ণ হওয়ার আগে বা ১০ দিন অতিক্রম করলে তা হায়েজ হিসেবে গণ্য হবে না।
  • যদি কোন নারীর পূর্ববর্তী নির্ধারিত সময় থাকে, তবে তা মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রশ্নাবলী

১. হায়েজ শুরু হওয়ার আগে কী লক্ষণ থাকে?

হায়েজ শুরুর আগে অনেক নারী পেট ব্যথা, ক্লান্তি, মেজাজ পরিবর্তন ইত্যাদি অনুভব করেন।

২. যদি হায়েজ ১০ দিনের বেশি স্থায়ী হয় তবে কী করণীয়?

১০ দিনের বেশি হলে এটি ইস্তিহাযা হিসাবে বিবেচিত হবে। তখন নামাজ ও রোযা শুরু করতে হবে।

৩. হায়েজের সময় কি সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে?

হ্যাঁ, তবে তা শারীরিক ইবাদতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে না।

৪. কি করলে হায়েজ ব্যথা কমবে?

পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা গরম পানির বোতল ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যকর খাবার ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

৫. হায়েজ কি সন্তান ধারণের জন্য জরুরি?

হ্যাঁ, কারণ হায়েজ নারীর প্রজনন ক্ষমতার একটি স্বাভাবিক অংশ। তবে এটি বন্ধ হওয়া মানেই সন্তান ধারণ সম্ভব নয়, কারণ আরও অনেক বিষয় জড়িত।

উপসংহার

হায়েজ নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা ধর্মীয় ও শারীরিক উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। হানাফি মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে হায়েজের বিধি-বিধান মেনে চলা একটি ইবাদত। এই গাইডটি পড়ে আপনার যে কোন সংশয় দূর হবে এবং ইসলামী জ্ঞান সমৃদ্ধ হবে।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x