প্রশ্নঃ ইয়াজুজ মাজুজ কারা? তার কি বাস্তবে আছে? যদি থাকে তাহলে তাদের অবস্থান কোথায়? আর যুইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীর কোথায় ? আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের এই যুগে ইয়াজুজ মাজুজ ও যুল কারনাইনের সেই প্রাচীরের সন্ধান পায়নি ? বিস্তারিত জানতে চাই।
ইয়াজুজ মাজুজ কারা?
ইয়াজুজ মাজুজ মানব সম্প্রদায়ের ভয়ঙ্কর দু’টি জাতি। তারা আদম আলাইহিস সালাম এর বংশধর। ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও অনেক সহিহ হাদিসে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তাই কোনো মুমিনের জন্য তাদের বাস্তবতা অস্বীকার করার ন্যূনতম অবকাশ নেই। এভাবে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের সুস্পষ্ট অর্থকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে অন্য অর্থে প্রবাহিত করারও সুযোগ নেই।
অন্যদিকে ইয়াজুজ মাজুজের অস্তিত্ব স্বীকার করে তাদের বাস্তব অবয়বকে অতিরঞ্জিত করাও যাবে না। উভয়দিক থেকে তাদেরকে সেই অবস্থানে রাখতে হবে যে অবস্থানকে কোরআন ও হাদিস সমর্থন করে। এই বিষয়টি মুখ্য রেখে আমরা মূল আলোচনায় এগুচ্ছি।
ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে রেওয়ায়াত করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
”يقول الله عز و جل يوم القيامة يا آدم يقول لبيك ربنا وسعديك فينادى بصوت إن الله يأمرك أن تخرج من ذريتك بعثا إلى النار قال يارب وما بعث النار ؟ قال من كل ألف – أراه قال – تسعمائة وتسعة وتسعين فحينئذ تضع الحامل حملها ويشيب الوليد وترى الناس سكارى وما هم بسكارى ولكن عذاب الله شديد. فشق ذلك على الناس حتى تغيرت وجوههم( فقال النبي صلى الله عليه و سلم :من يأجوج ومأجوج تسعمائة وتسعة وتسعين ومنكم واحد“…..
‘আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন হে আদম, (আদম উত্তরে বলবেন) আমি আপনার ডাকে সব সময় হাজির, হে আমাদের প্রতিপালক, আমি আপনার আনুগ্যত্যে চির সৌভাগ্যবান, তখন উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করা হবে- তোমার বংশধর থেকে জাহান্নামিদের বের করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদম বলবেন, হে আমার প্রতিপালক, জাহান্নামি কারা ? তিনি বলবেন প্রত্যেক এক হাজার থেকে নয়শত নিরানব্বইজন। এটাই সেই সময় যখন অন্তঃসত্তা নারী তার গর্ভপাত করে দিবে। ছোট বাচ্ছার চুল পেকে যাবে। আর তখন তুমি লোকদের দেখবে উন্মাদ অথচ বাস্তবে তারা উন্মাদ নয়। কিন্তু আল্লাহর শাস্তি খুবই ভয়াবহ।’
(রাবি বলেন) উপস্থিত মানুষদের উপর এই কথাটি কষ্টদায়ক হয়ে গেলো,‘যার ফলে তাদের চেহারা পরির্বতন হয়ে ওঠে। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘(সেই) নয়শত নিরানব্বইজন হবে ইয়াজুজ মাজুজদের মধ্যে থেকে আর (জান্নাতি) একজন হবে তোমাদের মধ্য থেকে।’
নোট: এই হাদিসটিতে ইয়াজুজ মাজুজদের আদম আলাইহিস সালাম এর বংশধর বলা হয়েছ। কাজেই ইয়াজুজ মাজুজ মানুষের শ্রেণিভুক্ত।
ইয়াজুজ মাজুজের পরিচয় সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস
পবিত্র কোরআনে নুহ আলাইহিস সালাম এর যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে সেটাও প্রমাণ করে ইয়াজুজ মাজুজ মানুষের শ্রেণিভুক্ত। যেমন এক আয়তে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
” وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِين “
‘আর আমি কেবল তাঁর (নুহের) বংশধরকে বাকি রেখেছি।’
এই আয়াতটির তাফসিরে ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে একটি আসার উল্লেখ করেন যেখানে তিনি বলেছেন,
”لم تبق إلا ذرية نوح عليه السلام“
‘(নুহের যুগে মহাপ্লাবনের পর) নুহ আলাইহি সালাম এর সন্তানাদি ছাড়া কেউই বাকি (জীবিত) ছিলো না।’
এরপর বিশিষ্ট তাবিয়ি কাতাদা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত আরেকটি আসারে আছে, তিনি বলেছেন,
”الناس كلهم من ذرية نوح عليه السلام “
‘সকল মানুষ নুহ আলাইহিস সালাম এর বংশধর।’
ইয়াজুজ মাজুজ কার সন্তান?
আদম আলাইহিস সালাম এর সন্তান। মুসতাদরাকে হাকিমে সামুরা ইবনে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
”ولد نوح ثلاثة سام و حام و يافث أبو الروم“
‘নুহের তিন সন্তান ছিলোহাম, সাম, ইয়াফিস আবুর রোম।’
সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলতেন,
”ولد نوح عليه الصلاة و السلام ثلاثة : سام و حام و يافث فولد سام العرب و فارس و الروم و في كل هؤلاء خير و ولد حام السودان و البربر و القبط و ولد يافث الترك و الصقالبة و يأجوج و مأجوج“
‘নুহ আলাইহিস সালাম এর তিন সন্তান ছিলো সাম, হাম, ইয়াফিস। আর সামের বংশধর হলো আরব, ফারিস ও রোম তারা প্রত্যেকের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। হামের বংশধর হলো, সুদান, বরবর ও কিবত। ইয়াফিসের বংশধর হলো তুরক, সাকালিবা ও ইয়াজুজ মাজুজ।
উল্লিখিত আয়াত, হাদিস ও অসার সমূহ প্রমাণ করে ইয়াজুজ মাজুজ মানুষের শ্রেণিভুক্ত। তারা আদম ও নুহ আলাইহিমাস সামাম এর সন্তান ও বংশধর।
ইয়াজুজ মাজুজের জন্ম । বিভ্রান্তি নিরসন
সে সব কথা বার্তা একদম অসার ও ভিত্তিহীন যেখানে বলা হয় ইয়াজুজ মাজুজ এমন দৈত্য প্রজাতি, যাদের জন্ম হয়েছে আদম আলাইহিস সালাম ঘুমের সময় স্বপ্নদোষ হওয়ার ফলে মাটিতে পড়ে যাওয়া বীর্য থেকে। আর তারা এমন বিশাল আকৃতির হবে যে, তারা তাদের এক কান মাঠিতে বিছিয়ে তোশকের কাজ সেরে নেয় এবং অন্য কান শরীরের উপরে মেলে লেপ বানিয়ে নেয়। ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে এরকম আরো বহু কথা আছে। সব কথাই বানোয়াট মনগড়া কিস্সা কাহিনী।
ইয়াজুজ মাজুজ দেখতে কেমন?
ইয়াজুজ মাজুজ যেহেতু আদম আলাইহিস সালাম এর সন্তান ও মানুষের দলভুক্ত, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের আকার ও অবয়ব হবে মানুষের মতো।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন,
”خلق الله آدم على صورته طوله ستون ذراعا فلما خلقه قال اذهب فسلم على أولئك نفر من الملائكة جلوس فاستمع ما يحيونك فإنها تحيتك وتحية ذريتك فقال السلام عليكم فقالوا السلام عليك ورحمة الله فزادوه ورحمة الله فكل من يدخل الجنة على صورة آدم فلم يزل الخلق ينقص بعد حتى الآن “
‘আল্লাহ তায়ালা আদমকে ষাট হাত লম্বা আকৃতিতে সৃষ্টি করেন। অতপর তাকে সৃষ্টি সম্পন্ন করার পর বলেন, তুমি এই উপবিষ্ট ফেরেস্তাদের জামাতকে সালাম দাও এবং ভালো করে শুনো তারা তোমার সালামের জবাবে কী বলে। কেননা এটাই হবে তুমি ও তোমার পরবর্তী বংশধরদের সালামের প্রতিউত্তর। অতপর আদম (ফেরেস্তাদের কাছে গিয়ে) বললেন আসসালামু আলাইকুম।
ফেরেস্তারা জবাবে বললো ওয়া আলাইকুমস সলাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তাঁরা রাহমুতুল্লাহ বৃদ্ধি করলো। যেই জান্নাতে প্রবেশ করবে সে আদমের আকৃতিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আদমকে সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত সৃষ্টি আকৃতি ছোট হয়ে আসছে।’
এই হাদিসটি প্রমাণ করছে আদম আলাইহিস সালাম সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর বংশধরদের আকৃতি ছোট হয়ে আসছে। আর ইয়াজুজ মাজুজ যেহেতু তাঁর বংশধর তাই তাদের আকৃতিও দিনেদিনে ছোট হচ্ছে। এ জন্যই ইয়াজুজ মাজুজ দেখতে মানুষের মতোই হবে। হয়তো একটু কম বেশ হবে।
তাদের স্বভাব হবে হিংস্র রাক্ষুসে নির্দয় ও ভয়ঙ্কর। তারা অত্যাচারের বন্যা নিয়ে আবির্ভূত হবে। এমনকি তাদের অত্যাচারে ঈসা নবি পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করবেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে তাদের এমন স্বভাব সম্পর্কে পর্যাপ্ত দালায়িল রয়েছে।
কিন্তু তারপরও তারা মানুষ। এই হিংস্র স্বভাব তারা মানুষ হওয়া থেকে দূরে রাাখবে না। ইতিহাসে চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনী সম্পর্কে খুবই ভয়ঙ্কর তত্ত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনী মানুষ ছিলো। এভাবে ইয়াজুজ মাজুজরা যদি চেঙ্গিস খান থেকে কয়েকগুণ বেশি হিংস্র হয় তবুও তারা মানুষই থাকবে।
কুরআনে ইয়াজুজ মাজুজ
নাস্তিকগুষ্টি মনে করে ইয়াজুজ মাজুজ বলেতে বাস্তবে কেউ নেই। এমনিভাবে কিছু মুসলিম দাবি করেন ইয়াজুজ মাজুজ বলতে আলাদা কোনো সম্প্রদায় নয় বরং দুনিয়ার সকল কাফির ও জাহান্নামিরা হলো ইয়াজুজ মাজুজ। কিন্তু তাদের এই দাবি কোরআন হাদিস ও সালাফের বক্তব্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। আমরা নিম্নে কোরআন হাদিস সালাফের উদ্ধৃতি ও যুক্তির আলোকে তাদের দাবিকে খন্ডন করছি।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
” حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا (৯৩) قَالُوا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا (৯৪) قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا (৯৫) آَتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انْفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آَتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا (৯৬) فَمَا اسْطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا (৯৭) قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا (৯৮ “
‘অবশেষে সে যখন দু পাহাড়ের মধ্যখানে পৌঁছুলো, তখন সেখানে এক জাতির সাক্ষাত পেলো। যারা খুব কমই কোনো কথা বুঝতে পারতো। তারা বললো, হে যুল কারনাইন! ইয়াজুজ মাজুজ এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। আমরা কি তোমাকে এ কাজের জন্য কর দেবো যে, তুমি আমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেবে। সে বললো, আমার রব আমাকে যা কিছু দিয়ে রেখেছেন তাই যথেষ্ট। তোমরা শুধু শ্রম দিয়ে আমাকে সাহয্য করো। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যখানে প্রাচীর নির্মাণ করে দিচ্ছি। আমাকে লোহার পাত এনে দাও।
তারপর যখন দু পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা সে পূর্ণ করে দিলো, তখন লোকদের বললো এবার আগুন জ্বালাও, অবশেষে (লোহার গুলো) পুরোপুরি আগুনের মতো লাল করার পর সে বললো, আনো! এবার আমি এর উপর গলিত তামা ঢেলে দেবো। (এ প্রাচীর এমন ছিলো যে) ইয়াজুজ মাজুজ এটা অতিক্রম করে আসতে পারতো না আবার এতে সুড়ঙ্গ করতেও সক্ষম ছিলো না। যুল কারনাইন বললো এ আমার রবের অনুগ্রহ। কিন্তু যখন আমার রবের প্রতিশ্রুতির নির্দিষ্ট সময় আসবে তখন তিনি একে ধূলিস্মাত করে দিবেন। আর আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য।’
অপর আয়াতে বলেন,
”حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ (৯৬) وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ ৃ “
‘এমনকি যখন ইয়াজুজ মাজুজকে খুলে দেওয়া হবে, প্রতি উচ্চ ভূমি থেকে তারা ছুটে আসবে। এবং সত্য ওয়াদা বাস্তবায়িত হওয়ার সময় কাছে এসে যাবে।’
ইয়াজুজ মাজুজ কখন আসবে?
ইয়াজুজ মাজুজ কখন আসবে সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য নেই। পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত দু’জায়গায় ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। আর এই দু’জায়াগায়ই একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাদের আবির্ভাবের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সুরা আম্বিয়ার সাতানব্বই নাম্বার আয়াতটিতে ‘সত্য ওয়াদা বাস্তবায়িত হওয়ার সময় কাছে এসে যাবে’ বলে যে ওয়াদার কথা বলা হয়েছে তা কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাওয়ার ওয়াদা বলে মুফাস্সিরিনে কেরাম অবহিত করেছেন। অর্থাৎ সেই সময় ইয়াজুজ মাজুজ আত্মপ্রকাশ করবে যখন কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে যাবে।
নোট : পবিত্র কুরআনে আয়াত ও হাদিস সমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে ইয়াজুজ মাজুজ কিয়ামতের পূর্বে আত্মপ্রকাশ করবে। তারা কিয়ামতের বড় দশটি নির্দশনের মধ্যে থেকে একটি। এ কথার উপরই যুগযুগ থেকে চলে আসা সালাফের মতামত। তাই যারা বলে ইয়জুজ মাজুজ বলতে আলাদা কোনো প্রজাতি নয় বরং দুনিয়ার সকল কাফিরই হলো ইয়াজুজ মাজুজ বা ইয়াজুজ মাজুজ বর্তমানে সভ্য মানুষ হয়ে বসবাস করছে কিয়ামতের আগ মুহূর্তে তারা তাদের মূল অবস্থায় ফিরে যাবে। তাদের কথা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্টভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাদের প্রাচীর ধ্বংস করার ওয়াদা করেছেন। যদি তারা এসেই গেছে তাহলে হাদিসের মধ্যে ঈসা নবি আগমনের পরে তাদের আবির্ভাব, ‘বুহাইরা তাবারিয়্যাহ’র সকল পানি পান, প্রতিদিন সুড়ঙ্গ করা, নাগাফে আক্রান্ত হয়ে একই আত্মার মতো মৃত্যু হওয়া ইত্যাদি কথা কেন বলা হলো?
ইয়াজুজ মাজুজ কিভাবে ধ্বংস হবে?
আল্লাহ তায়ালা ইয়াজুজ মাজুজের শরীরে নাগাফ (বিশেষ এক ধরণের পোঁকা) ছড়িয়ে দিবেন। এর ফলে তারা সকলে একই আত্মার মতো মৃত্যু বরণ করবে। এভাবেই তারা ধ্বংস হবে।
হুজাইফা ইবনে আসিদ আলগিফারি থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
”اطلع النبى -صلى الله عليه وسلم- علينا ونحن نتذاكر فقال )ما تذاكرون(. قالوا نذكر الساعة. قال ) إنها لن تقوم حتى ترون قبلها عشر آيات(. فذكر الدخان والدجال والدابة وطلوع الشمس من مغربها ونزول عيسى ابن مريم -صلى الله عليه وسلم- ويأجوج ومأجوج وثلاثة خسوف خسف بالمشرق وخسف بالمغرب وخسف بجزيرة العرب وآخر ذلك نار تخرج من اليمن تطرد الناس إلى محشرهم “
‘নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দিকে তাকালেন তখন আমরা পরস্পর আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছো? তারা বললো, আমরা কিয়ামত নিয়ে আলোচনা করছি। তিনি বললেন, দশটি নিদর্শন দেখার আগ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।
অতপর তিনি সেই দশটি নিদর্শন উল্লেখ করলেনঃ ধোঁয়া, দাজ্জাল, দাব্বা, পশ্চিমদিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া, ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম এর অবতরণ, ইয়াজুজ মাজুজের আত্মপ্রকাশ, তিনটি ভূমিধ্বস একটি হবে পূর্বদিকে, একটি হবে পশ্চিমদিকে আর অন্যটি হবে জাযিরাতুল আরবে। আর সবশেষে আগুন যা ইয়ামান থেকে উঠে মানুষকে তাদের সমবেত হওয়ার স্থানের দিকে নিয়ে যাবে।’
সহিহ মুসলিম শরিফে কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে বর্ণিত বেশ লম্বা একটি হাদিসের একাংশে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
”ثم يأتى عيسى ابن مريم قوم قد عصمهم الله منه فيمسح عن وجوههم ويحدثهم بدرجاتهم فى الجنة فبينما هو كذلك إذ أوحى الله إلى عيسى إنى قد أخرجت عبادا لى لا يدان لأحد بقتالهم فحرز عبادى إلى الطور ويبعث الله يأجوج ومأجوج وهم من كل حدب ينسلون فيمر أوائلهم على بحيرة طبرية فيشربون ما فيها ويمر آخرهم فيقولون لقد كان بهذه مرة ماء. ويحصر نبى الله عيسى وأصحابه حتى يكون رأس الثور لأحدهم خيرا من مائة دينار لأحدكم اليوم فيرغب نبى الله عيسى وأصحابه فيرسل الله عليهم النغف فى رقابهم فيصبحون فرسى كموت نفس واحدة “
‘অতপর ঈসা আলাইহিস সালাম এর কাছে এক জামাত মানুষ আসবে যাদেরকে আল্লাহ দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি তাদের চেহারা মুছে দেবেন এবং তাদের জান্নাতের স্থান বর্ণনা করবেন। এই অবস্থায় থাকাকালে আল্লাহ তায়ালা ঈসা আলাইহিস সালাম কে ওহির মাধ্যমে জানাবেন, আমি আমার এমন একদল বান্দাকে বের করছি যাদেরকে হত্যা করার মতো শক্তি কারো নেই।
তাই তুমি আমার (মুসলিম) বান্দাদের নিয়ে তুর পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করো। অতপর আল্লাহ তা’য়ালা ইয়াজুজ মাজুজ প্রেরণ করবেন। প্রতি উচ্চ ভূমি থেকে তারা ছুটে আসবে। তাদের প্রথম দল বুহাইরা তাবারিয়্যাহ অতিক্রম করার সময় সেখানের সমস্থ পানি পান করে ফেলবে। অতপর তাদের অন্য দল এই স্থান অতিক্রম করার সময় বলবে এখানে অবশ্যই কোনো এক বার পানি ছিলো। আর আল্লাহর নবি ঈসা ও তাঁর সাথীরা তখন পাহাড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়বেন। এমনকি তাদের একেক জনের কাছে আজকের দিনের একশত দিনারের থেকে পাহাড়ের চূড়া অধিক উত্তম হবে। অতপর আল্লাহর নবি ঈসা ও তাঁর সাথীরা আল্লাহ তা’য়ালার দিকে মনোনিবেশ করবেন। এরপর আল্লাহ তা’য়ালা তাদের শরীরে নাগাফ (বিশেষ এক ধরণের পোঁকা) ছড়িয়ে দিবেন। এর ফলে তারা সকলে একই আত্মার মতো মৃত্যু বরণ করবে।’
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
”يأجوج ومأجوج يحفرون كل يوم حتى إذا كادوا يرون شعاع الشمس قال الذي عليهم ارجعوا فسنحفره غدا فيعيده الله أشد ماكان حتى إذا بلغت مدتهم وأراد الله أن يبعيهم على الناس حفروا. حتى إذا كادوا يرون شعاع الشمس قال الذي عليهم ارجعوا فستحفرونه غدا إن شاء الله تعالى. واستثنوا فيعودون إليه وهو كهيئته حين تركوه. فيحفرونه ويخرجون على الناس “
‘ইয়াজুজ মাজুজরা প্রতিদিন সুড়ঙ্গ করে যখন সূর্যেও কিরণ দেখার নিকটবর্তী হয়ে যায় তখন তাদের সর্দার বলে আজ ফিরে চলো আগামীকাল এসে আবার শুরু করবো। অতপর আল্লাহ তা’য়ালা সেই স্থানকে আগের থেকেও কঠিন করে দেন। এভাবে চলতে চলতে যখন তাদের সময় শেষ হয়ে আসবে আর আল্লাহ তা’য়ালা চাইবেন তারা মানুষের উপর বিস্তার করুক তখন তারা সুড়ঙ্গ করতে সক্ষম হয়ে যাবে। সে সময় তারা সূর্যের আলো দেখার নিকটবর্তী হওয়ার পর তাদের সর্দার বলবে আজ ফিরে চলো আগামীকাল ইন শা আল্লাহ আমরা তা সম্পন্ন করে নিবো। তারা ইন শা আল্লাহ পড়ে নিবে। এর পরদিন এসে আগের অবস্থায় পাবে। অতপর তারা মানুষের দিকে বেরিয়ে আসবে।’
ইয়াজুজ মাজুজ এর প্রাচীর । দেয়াল
এখন প্রশ্ন বাকি থাকে, বর্তমান জ্ঞান বিজ্ঞান এতো উন্নত হয়েছে যে মানুষ এখানে বসে সমস্ত গ্রহ উপগ্রহের খবর জানতে পারছে কিন্তু পৃথিবীর এক কোণায় পড়ে থাকা যুল কারনাইনের প্রাচির ও ইয়াজুজ মাজুজের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না কেন ?
প্রশ্নটির সহজ উত্তর হলো পৃথিবীতে যতো রহস্য আছে তার সব কি উদঘাটন করা শেষ হয়ে গেছে? আজ পর্যন্ত কেউ কি দাবি করেছে পৃথিবীর সকল অজানা জানা হয়ে গেছে? না এমন দাবি কেউ্ই করেনি। বরং প্রতিনিয়ত পৃথিবীর নিত্যনতুন রহস্য উন্মোচন হচ্ছে। মানুষ অজানা নানান কিছু নতুন করে জানছে।
তাই ইয়াজুজ মাজুজ ও তাদের প্রাচীরকে পৃথিবীর সে সব রহস্য হিসাবে রাখা যায় যা এখনো অজানা। যখন সময় আসবে সবাই তা জানতে পারবে। উদহরণ হিসাবে বলা যায় ময়দানে ‘তিহের’ কথা। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর অপার শক্তিবলে সেই স্থানটিতে বনি ইসরাইলকে চল্লিশ বছর পযর্ন্ত অবদ্ধ করে রেখে দিয়েছেন। কেউই তাদের দেখতে পায়নি।
কারণ আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সেই স্থানকে সবার দৃষ্টির আড়াল করে রেখে দিয়েছিলেন। তাই কেউ সে স্থানটি দেখতে পায়নি। যদি দেখতে পতো তাহলে তারা ওখানে চল্লিশ বছর ঘুরপাক খাওয়ার কথা ছিলো না। এভাবে ইয়াজুজ মাজুজের স্থানটিও আল্লাহ তা’য়ালা অদৃশ্য করে রেখে দিয়েছেন। তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগে কেউই সেই স্থানটির সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়।