ইসলাম একটি প্রাকৃতিক ধর্ম যেখানে মানব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ধর্মের অনুসারীরা সবসময় নিজেদের পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখার জন্য অনেক নিয়ম মেনে চলে। এর মধ্যে নাভির নিচের লোম কাটার বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এই নিবন্ধে আমরা নাভির নিচের লোম কাটার বিধান, কতটুকু কাটতে হবে, না কাটলে নামাজের অবস্থান, কাটার সময়ের নির্দেশিকা এবং সংশ্লিষ্ট হাদিস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
নাভির নিচের লোম কাটার বিধান
ইসলামে নাভির নিচের লোম কাটার বিধানটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আদেশ নয়, বরং একটি সুস্থ-মনস্ক ব্যক্তির বিবেকের চাহিদাও মেটায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, নিয়মিত নাভির নিচের লোম কাটা একজন মুসলিমের জন্য সুন্নত। এটি সপ্তাহে একবার কাটার সুপারিশ করা হয়েছে, তবে কেউ যদি সপ্তাহে না কাটতে পারে তবে পনের দিন পরপর কাটতে বলা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
عَشرٌ مِنَ الفِطرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وإِعفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ، واسْتِنشَاقُ الماءِ، وقَصُّ الأَظفَارِ، وغَسلُ البَرَاجِمِ، وَنَتفُ الإِبطِ، وَحلقُ العانَة، وانتِقاصُ المَاءِ
অনুবাদ: “দশটি স্বভাবজাত বিষয় হলো: গোঁফ ছোট করা, দাড়ি রাখা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি নেওয়া, নখ কাটা, আঙ্গুলের গাঁট পরিষ্কার করা, বগলের লোম তোলা, নাভির নিচের লোম শেভ করা, পানির সাথে ইস্তিনজা করা।” (বুখারি, মুসলিম, মেশকাত: ৪৪২০)
নাভির নিচের লোম কতটুকু কাটবে
এই নাভির নিচের লোম কাটার ক্ষেত্রে সঠিক সীমা নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনাকাঙ্ক্ষিত লোমের সীমানা নাভির নিচের থেকে চার-পাঁচ আঙুল নিচে পর্যন্ত শুরু হয়। এটি থেকে পায়ের ভিতরের দিকের থাই পর্যন্ত, যৌনাঙ্গের চারপাশে এবং প্রয়োজনে পায়ুপথের চারপাশের লোমও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এই লোমগুলি নিয়মিত কাটা স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
নাভির নিচের লোম না কাটলে কি নামাজ হবে
কিছু মানুষ মনে করেন, নাভির নিচের লোম না কাটলে ৪০ দিনের মধ্যে নামাজ কবুল হবে না। তবে এটি একটি ভুল ধারণা। অনেক কারণে মানুষ ভুলে যেতে পারে বা ব্যস্ত থাকতে পারে। সুতরাং, যদি কেউ ভুলে যায়, তবে তার ইবাদত বাতিল হবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে এই সময়সীমা অতিক্রম করা গুনাহ হবে, কারণ হাদিসে এই বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নাভির নিচের লোম কাটলে কি গোসল ফরজ হয়
অনেকেই জানতে চান যে, নাভির নিচের লোম কাটলে কি গোসল ফরজ হয় কিনা। না, নাভির নিচের লোম কাটলে গোসল ফরজ হয় না। গোসল ফরজ হওয়ার সাথে লোম কাটার সম্পর্ক নেই। এছাড়া রোজা রেখেও এই কাজ করা যাবে এবং এতে কোনো বাধা নেই।
নাভির নিচের লোম কাটার হাদিস
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمِ الأَظْفَارِ، وَنَتْفِ الإِبِطِ، وَحَلْقِ الْعَانَةِ، أَنْ لاَ نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ يَوْماً
অনুবাদ: “আমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যে, আমরা যেন গোঁফ ছোট রাখা, নখ কাটা, বগলের লোম তোলা এবং নাভির নিচের লোম শেভ করা ৪০ দিনের বেশি বিলম্বিত না করি।” (মুসলিম ২৫৬)
কত দিন পর পর নাভির নিচের লোম কাটতে হবে?
ইসলামী পণ্ডিতরা বলেছেন যে, নাভির নিচের লোম ৪০ দিনের মধ্যে একবার কাটতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হল প্রতি সপ্তাহে একবার বা পনের দিনে একবার কাটা।
গোপনাঙ্গের লোম কাটার পদ্ধতি
নাভির নিচের লোম কাটার পদ্ধতি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে। ইসলামিক বিধান অনুযায়ী, ব্লেড, রেজার বা কাঁচি দিয়ে পুরুষ এবং মহিলারা লোম কাটতে পারেন। এছাড়া, কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে পরিষ্কার করাও অনুমোদিত। তবে, পুরুষদের জন্য লোম টেনে পরিষ্কার করা এবং মহিলাদের জন্য টেনে পরিষ্কার করা মুস্তাহাব।
নাভির নিচের লোম কাটার উপকার: স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা
স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার উপকারিতা
১. জীবাণু মুক্ত থাকা: নাভির নিচের লোম কাটার মাধ্যমে জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করা যায়। লোমের নিচে ময়লা জমতে পারে যা সংক্রমণ এবং ত্বকের সমস্যার কারণ হতে পারে। নিয়মিত লোম কাটার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
২. শরীরের দুর্গন্ধ দূর করা: নাভির নিচের লোম জমে থাকা ঘাম এবং ময়লা দুর্গন্ধের সৃষ্টি করতে পারে। লোম কাটার ফলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং শরীরের দুর্গন্ধ কমে যায়।
৩. আরামদায়ক অনুভূতি: লম্বা বা অগোছালো লোম শারীরিক অস্বস্তি এবং চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। লোম কাটার মাধ্যমে এই অস্বস্তি দূর হয় এবং শরীরকে আরও আরামদায়ক রাখা যায়।
৪. ত্বকের স্বাস্থ্য: নিয়মিত লোম কাটার ফলে ত্বক আরও সুস্থ এবং পরিস্কার থাকে। ত্বকের ছিদ্রগুলি খোলা থাকে যা ত্বকের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াকে বজায় রাখতে সহায়ক।
ধর্মীয় উপকারিতা
১. সুন্নতের অনুসরণ: রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নত পালন করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাভির নিচের লোম কাটা সুন্নতের অংশ এবং এটি পালন করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
২. ইবাদতের শুদ্ধতা: ইসলামে ইবাদতের পূর্বে পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি। নাভির নিচের লোম কাটার ফলে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে যা ইবাদতের শুদ্ধতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক উপকারিতা
১. ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা: নিয়মিত নাভির নিচের লোম কাটার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মধ্যে শৃঙ্খলা এবং স্ব-পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এটি ব্যক্তি জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে সহায়ক।
২. মানসিক প্রশান্তি: শারীরিক পরিচ্ছন্নতা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিয়মিত লোম কাটার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও স্বস্তি পাওয়া যায়।
সারাংশ
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যের জন্য নাভির নিচের লোম কাটা ইসলামিক নির্দেশনার একটি অংশ। এটি সুন্নত হলেও ফরজ নয়। তাই, মুসলমানদের উচিত নিয়মিতভাবে এই লোম কাটার মাধ্যমে নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখা এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নত পালন করা। এছাড়া, এর মাধ্যমে নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অংশ।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
কোন ইসলামিক শিক্ষায় নাভির নিচের লোম কাটার বিষয়টি উল্লেখ আছে?
ইসলামে তহারাহ (পরিচ্ছন্নতা) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কুরআনে সরাসরি উল্লেখ নেই, তবে হাদিসে এটির গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
নাভির নিচের লোম কাটার নির্দিষ্ট নির্দেশিকা কি আছে?
হ্যাঁ, ইসলামে নাভির নিচের লোম কাটার নির্দিষ্ট নির্দেশিকা আছে। মুসলমানদের নিয়মিতভাবে লোম কাটা উচিত তবে পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এই বিষয়ে কি ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো মতভেদ আছে?
না, নাভির নিচের লোম কাটার প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই।
স্বাস্থ্যগত কারণে কেউ যদি লোম না কাটতে পারেন তাহলে কি করবেন?
স্বাস্থ্যগত প্রয়োজন বা অসুবিধার কারণে ইসলাম সাধারণত ধর্মীয় প্র্যাকটিসে নমনীয়তা প্রদান করে। এজন্য এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা যেতে পারে।
এই বিষয়ে আরও তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে?
স্থানীয় ইমাম বা কোনো মুফতি সাহেবের সাথে পরামর্শ করুন বা প্রামাণিক ইসলামী ওয়েবসাইট থেকে আরও বিস্তারিত নির্দেশিকা গ্রহণ করুন।