ইসলামিক শিক্ষনীয় গল্প । কুরআন থেকে নেওয়া

শেয়ার করুন

ইসলামিক শিক্ষনীয় গল্প বা ঘটনা আমাদের জীবনের নানা দিকের শিক্ষা দেয়। সুরা বাকারাহ (২:৬৭-৭৩) তে বর্ণিত গাভীর গল্প এমন একটি ঘটনা যা আমাদের আল্লাহর নির্দেশ পালনের গুরুত্ব এবং তাঁর অসীম জ্ঞানের প্রতি আস্থা রাখার শিক্ষা দেয়। এই গল্পটি বনী ইসরাইলের একটি বিশেষ সময়ের ঘটনার বিবরণ দেয়, যেখানে একটি অলৌকিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি হত্যা রহস্য উন্মোচিত হয়। কুরআনের এই অংশটি শুধু একটি ঘটনাকে তুলে ধরে না, বরং তা আমাদের জীবন, আস্থা, এবং কর্তব্যের দিক থেকে গভীর শিক্ষাও প্রদান করে। চলুন, আমরা এই ঘটনা বিস্তারিতভাবে দেখি এবং এর শিক্ষাগুলি আমাদের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে তা জানি।

কুরআনে বর্ণিত গাভীর গল্প

প্রেক্ষাপট: বনী ইসরাইলের সময়ে, মুসা (আ.) তাদের নবী ছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের চেষ্টা করতেন। তবে বনী ইসরাইলের লোকেরা প্রায়ই অবাধ্যতা ও সন্দেহের কারণে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হতো। এই গল্পটি সুরা বাকারাহ (২:৬৭-৭৩) এ উল্লেখিত হয়েছে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট গাভী জবাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

ঘটনা: বনী ইসরাইলের মধ্যে এক লোককে হত্যা করা হয়েছিল, কিন্তু কেউ জানত না হত্যাকারী কে। এই ঘটনার সুরাহ আনতে তারা মুসা (আ.) এর কাছে গেল এবং আল্লাহর কাছে সমাধান চাইলো। তখন আল্লাহ মুসা (আ.) কে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন একটি গাভী জবাই করে এবং তার এক অংশ দিয়ে মৃত ব্যক্তির দেহ স্পর্শ করে। এই কাজের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলবে।

প্রথমে, বনী ইসরাইলের লোকেরা এই নির্দেশে অবিশ্বাস ও সন্দেহ প্রকাশ করে এবং মুসা (আ.) কে বারবার গাভীর সঠিক ধরন ও বর্ণনা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তারা জানতে চাইল, গাভীটি কেমন হতে হবে—কি তার রং, বয়স, এবং কাজ। আল্লাহ বারবার তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেন, কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা একটি নতুন প্রশ্ন নিয়ে আসে, যেন তারা আল্লাহর নির্দেশকে এড়িয়ে যেতে পারে।

অবশেষে, আল্লাহর বর্ণনা অনুসারে তারা একটি গাভী খুঁজে পায়—যা মাঝবয়সী, উজ্জ্বল হলুদ রঙের, এবং চাষাবাদে ব্যবহার না হওয়া। গাভীটি তারা কিনে এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জবাই করে।

এরপর, মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে গাভীর এক টুকরো মাংস মৃত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করান, এবং অলৌকিকভাবে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে উঠে এবং নিজের হত্যাকারীর নাম বলে। এই অলৌকিক ঘটনা আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার একটি প্রমাণস্বরূপ ছিল, যা বনী ইসরাইলের সামনে প্রমাণিত হলো।

শিক্ষা: এই গল্প থেকে আমরা শিখি যে, আল্লাহর নির্দেশনায় কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা না রেখে তাঁর আদেশ পালন করা উচিত। বনী ইসরাইলের লোকেরা যেমন অবাধ্যতা ও সন্দেহ দেখিয়েছিল, তেমনটি করা উচিত নয়, কারণ আল্লাহ সবকিছুর ওপর পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখা ও তাঁর নির্দেশ মানা আমাদের জন্য অপরিহার্য।

রেফারেন্স: কুরআন, সুরা বাকারাহ (২:৬৭-৭৩)।

ইসলামিক শিক্ষনীয় গল্প । উমর (রাঃ) এর রাতের বেলা ঘুরে প্রজাদের খবর রাখা

উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ), ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, ছিলেন এমন একজন শাসক যিনি ন্যায়বিচার এবং দায়িত্ববোধের জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি সবসময় তাঁর প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এমনকি যদি তা তাকে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করে।

এক রাতে, উমর (রাঃ) তার সামান্য সহচর আসলামের সাথে মদিনার চারপাশে হাঁটছিলেন। শীতল রাতের নিস্তব্ধতায়, তিনি একটি বাড়ি থেকে ক্ষীণ কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। উমর (রাঃ) সেদিকে এগিয়ে গেলেন এবং দেখলেন যে, একটি দরিদ্র মহিলা তার ছোট শিশুদের নিয়ে বসে আছেন। আগুনের উপর একটি হাঁড়ি রেখে তিনি কিছু রান্না করার ভান করছিলেন, যেন তাদের ক্ষুধা কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু হাঁড়িতে আসলে কিছুই ছিল না—এটি ছিল শুধু পানি, যা অনবরত ফোঁটানো হচ্ছিল।

উমর (রাঃ) মর্মাহত হলেন এবং মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কেন এভাবে শিশুদের ধোঁকা দিচ্ছো?”

মহিলা জবাব দিলেন, “আমাদের কাছে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। আমি হাঁড়িতে পানি দিয়ে রাখছি, যেন শিশুদের মনে হয় কিছু রান্না হচ্ছে এবং তারা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের কেউ খোঁজ নেয় না, এমনকি খলিফাও আমাদের জন্য কিছু করে না।”

মহিলার কথা শুনে উমর (রাঃ) এর অন্তর কেঁদে উঠলো। তিনি নিজেকে প্রজাদের কল্যাণের জন্য দায়িত্বশীল মনে করতেন এবং এই অবস্থায় তিনি অপরাধবোধে আক্রান্ত হলেন। তিনি সাথে সাথে আসলামকে নিয়ে খাদ্য সরবরাহের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।

খলিফা নিজেই খাদ্য ভর্তি বস্তা কাঁধে তুলে নিলেন। আসলাম তাঁকে সাহায্য করতে চাইলে উমর (রাঃ) বললেন, “কিয়ামতের দিন আমার বোঝা কে বহন করবে? আজ আমাকে আমার দায়িত্ব নিজেই পালন করতে দাও।”

মহিলার ঘরে ফিরে এসে তিনি নিজ হাতে খাবার রান্না করে দিলেন এবং শিশুদের খাবার খাওয়ালেন। শিশুরা তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, উমর (রাঃ) সন্তুষ্টচিত্তে ফিরে গেলেন, কিন্তু মহিলাকে বললেন না যে, তিনিই ছিলেন মুসলিম বিশ্বের মহান খলিফা।

শিক্ষা: এই ঘটনা উমর (রাঃ) এর প্রজাদের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ এবং ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক। তিনি শাসক ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর প্রজাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে কখনো পিছপা হননি। তাঁর শাসনামল প্রমাণ করে যে, একজন সঠিক শাসক কেবল আইন দ্বারা শাসন করেন না, বরং নিজের অন্তর দিয়ে তার প্রজাদের মঙ্গল নিশ্চিত করেন।

রেফারেন্স: ইবনে কাসির, “আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া,” এবং অন্যান্য ইসলামী ঐতিহাসিক গ্রন্থে উমর (রাঃ) এর জীবনী।

আরো কিছু ইসলামিক শিক্ষনীয় গল্প পড়তে পারেন।


শেয়ার করুন

Leave a Comment