তালাক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি ইসলামে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিবেচিত। এক তালাকের পর দাম্পত্য জীবন পুনরায় শুরু করার পদ্ধতি সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এটি কেবল একটি আইনি বিষয় নয়, বরং এতে গভীর পারিবারিক, সামাজিক প্রভাব রয়েছে। তাই, এক তালাক দেওয়ার পর সংসার করার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তালাক: সংজ্ঞা ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামে তালাক এমন একটি ব্যবস্থা যা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে চূড়ান্ত সম্পর্কচ্ছেদের পদ্ধতি। তবে, এটি ইসলামি বিধানের সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। কুরআনে বলা হয়েছে:
“তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। আর তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেবে। তবে উভয়ে যদি আশঙ্কা করে যে, আল্লাহর সীমারেখায় তারা অবস্থান করতে পারবে না। সুতরাং তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে না তাহলে স্ত্রী যা দিয়ে নিজকে মুক্ত করে নেবে তাতে কোন সমস্যা নেই। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যে আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই যালিম।” (সূরা আল-বাকারা: ২২৯)
তালাকের পর সংসার করার ব্যাপারে ইসলামে স্পষ্ট নীতি রয়েছে, যা পরিবার ও সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এক তালাকের পর সংসার করার উপায়
এক তালাক দেওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলনের সুযোগ রয়েছে, যা নিম্নলিখিত পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভব:
১. ইদ্দতের সময়কাল
ইদ্দত হল তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্য একটি নির্ধারিত সময়কাল। এটি তিন মাসিক চক্র বা স্ত্রীর গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়ে:
- স্বামী পুনরায় স্ত্রীকে গ্রহণ ( রুজু ) করতে পারে।
- ( রুজু ) পুনর্মিলন হলে নতুন বিবাহের প্রয়োজন নেই।
ইদ্দতের সময় স্বামীর ভূমিকা সম্পর্কে কুরআনে যা বলা হয়েছে:
یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ اِذَا طَلَّقۡتُمُ النِّسَآءَ فَطَلِّقُوۡهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَ اَحۡصُوا الۡعِدَّۃَ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ رَبَّكُمۡ ۚ لَا تُخۡرِجُوۡهُنَّ مِنۡۢ بُیُوۡتِهِنَّ وَ لَا یَخۡرُجۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّاۡتِیۡنَ بِفَاحِشَۃٍ مُّبَیِّنَۃٍ ؕ وَ تِلۡكَ حُدُوۡدُ اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَعَدَّ حُدُوۡدَ اللّٰهِ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهٗ ؕ لَا تَدۡرِیۡ لَعَلَّ اللّٰهَ یُحۡدِثُ بَعۡدَ ذٰلِكَ اَمۡرًا
“হে নবী, (বল), তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দত অনুসারে তাদের তালাক দাও এবং ‘ইদ্দত হিসাব করে রাখবে এবং তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা তাদেরকে তোমাদের বাড়ী-ঘর থেকে বের করে দিয়ো না এবং তারাও বের হবে না। যদি না তারা কোন স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। আর যে আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমারেখাসমূহ অতিক্রম করে সে অবশ্যই তার নিজের ওপর যুলম করে। তুমি জান না, হয়তো এর পর আল্লাহ, (ফিরে আসার) কোন পথ তৈরী করে দিবেন। আল-বায়ান।” (সূরা আত-তালাক: ১)
২. রুজুর পদ্ধতি
রুজু মানে স্বামী যদি তালাকের পরে পুনরায় স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চান, তবে তিনি মৌখিক বা শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে তা করতে পারেন। এর জন্য কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। তবে, স্বামীকে উচিত হলো আন্তরিক মনোভাব ও দায়িত্ববোধ নিয়ে রুজু করা।
৩. নতুন বিবাহ
ইদ্দতের সময় অতিক্রান্ত হলে, পুনর্মিলনের জন্য তাদের পুনরায় বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে। এতে স্ত্রী নতুন মোহর গ্রহণের অধিকারী হবেন।
কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা
কুরআনের আলোকে:
কুরআনে তালাক ও পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তালাকের প্রক্রিয়া:
“তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। ।” (সূরা আল-বাকারা: ২২৯)
রুজু করার সুযোগ:
“আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছে যাবে তখন হয়তো বিধি মোতাবেক তাদেরকে রেখে দেবে অথবা বিধি মোতাবেক তাদেরকে ছেড়ে দেবে। তবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আটকে রেখো না।।” (সূরা আল-বাকারা: ২৩১)
হাদিসের আলোকে
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) তালাক ও পুনর্মিলনের বিষয়ে বেশ কয়েকটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
“তালাক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল কাজ।” (আবু দাউদ, হাদিস: ২১৭৮)
“তোমাদের কেউ যদি স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে যেন তার প্রতি ন্যায়বিচার করে এবং তার অধিকার দেয়।” (তিরমিজি, হাদিস: ১১৮৭)
হানাফি মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি
হানাফি মাযহাব অনুযায়ী, এক তালাক দেওয়ার পর পুনরায় সংসার করার ক্ষেত্রে রুজু এবং পুনর্বিবাহের বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
১. রুজুর নিয়ম:
হানাফি ফিকহ মতে, ইদ্দতের সময় মৌখিক বা শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে রুজু করা যায়। রুজুর জন্য কোনো সাক্ষীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়, তবে উত্তম।
২. নতুন বিবাহ:
ইদ্দত শেষে যদি পুনরায় বিবাহ করতে হয়, তবে এটি সম্পূর্ণ নতুন চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। স্ত্রীর সম্মতি এবং নতুন মোহর নির্ধারণ করা আবশ্যক।
৩. তিন তালাকের বিধান:
হানাফি মাযহাব অনুযায়ী, যদি তিন তালাক সম্পন্ন হয়ে যায়, তবে পুনর্মিলন বৈধ নয় যতক্ষণ না স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ সম্পন্ন করে এবং সেই বিবাহ কোনো কারণে বিচ্ছেদ ঘটে।
৪. ইদ্দতের সময় নারীর অধিকার:
হানাফি মাযহাবে স্বামীকে ইদ্দতের সময় স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইদ্দতের সময় স্ত্রীকে একই ঘরে থাকতে দেওয়া এবং তার প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
তালাকের পর সংসার পুনর্গঠন: কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক
১. আত্মসমালোচনা ও পরামর্শ গ্রহণ
তালাকের পেছনে যে কারণই থাকুক, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উচিত নিজেদের ভুল বুঝতে চেষ্টা করা। প্রয়োজনে ইসলামিক পণ্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
২. আর্থিক ও মানসিক সমর্থন
তালাকের পর সংসার পুনর্গঠন করতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব হলো একে অপরকে আর্থিক ও মানসিক সমর্থন প্রদান করা। এটি তাদের পুনর্মিলনকে সহজ করে তুলবে।
৩. নতুন করে শুরু করার মানসিকতা
পুনর্মিলনের পর দাম্পত্য জীবনে পূর্বের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে দাম্পত্য সম্পর্ক মজবুত করা জরুরি।
কিছু প্রশ্ন
১. এক তালাকের পর কি পুনরায় বিবাহ করা বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, ইদ্দতের মধ্যে রুজু করলে পুনরায় বিবাহের প্রয়োজন নেই। তবে, ইদ্দতের সময় পার হয়ে গেলে নতুন বিবাহ প্রয়োজন।
২. তালাকের পর রুজুর জন্য সাক্ষী কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, রুজুর জন্য সাক্ষী বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি উত্তম।
৩. তিন তালাক দেওয়ার পর পুনর্মিলন সম্ভব কি?
উত্তর: না, তিন তালাকের পর স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ না করলে পুনর্মিলন সম্ভব নয়। একে হালালা বলা হয়, যা ইসলামে নির্দিষ্ট শর্তের অধীন।
৪. তালাকের সময় কীভাবে স্ত্রীকে ন্যায্য অধিকার দেওয়া হয়?
উত্তর: স্ত্রীকে মোহর, ভরণপোষণ ও ইদ্দতের সময় থাকার জায়গা প্রদান করা স্বামীর দায়িত্ব।
৫. তালাকের জন্য কি কোনো লিখিত ডকুমেন্ট প্রয়োজন?
উত্তর: ইসলামি আইন অনুযায়ী মৌখিক তালাক বৈধ, তবে আইনগত সমস্যার জন্য লিখিত ডকুমেন্ট রাখা উচিত।
উপসংহার
এক তালাক দেওয়ার পর পুনরায় সংসার করার সুযোগ ইসলামিক পরিবার ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও নমনীয়তা প্রকাশ করে। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা মেনে চললে এটি পরিবারে শান্তি ও স্থিতি আনতে পারে। হানাফি মাযহাবের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী, তালাকের পরে পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং সুনির্দিষ্ট। তালাক কোনো পরিবার ভাঙার উদ্দেশ্যে নয়, বরং সমস্যা সমাধানের একটি উপায়। তাই, এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা এবং আল্লাহর নির্দেশনার প্রতি অনুগত থাকা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য।