মুরাবাহা কি? অর্থ । সংজ্ঞা । প্রকার । পদ্ধতি । বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

পোস্টটি শেয়ার করুন

মুরাবাহা অর্থ: মুরাবাহা (আরবি: مرابحة) শব্দটি “রিবহ” (ربح) থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ লাভ বা প্রফিট। এটি এমন একটি পদ্ধতি যা ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে পণ্য বা সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মুরাবাহার মূল ধারণাটি হলো একটি স্বচ্ছ চুক্তি, যেখানে বিক্রেতা ক্রেতাকে জানিয়ে দেয় যে পণ্যের ক্রয়মূল্য কত এবং কতটুকু লাভ নেওয়া হচ্ছে।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে লাভ এবং ন্যায্য বাণিজ্যের গুরুত্ব অসীম। যেমন, কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৫)

হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“সৎ ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিনে নবী, সত্যবাদী এবং শহীদদের সঙ্গে থাকবে।” (তিরমিজি)


মুরাবাহা কি? এর পারিভাষিক সংজ্ঞা

মুরাবাহার সংজ্ঞায় ফুকাহায়ে কেরাম বলেন:

”بيع ما ملكه بما قام عليه وبفضل أو هو: بيع السلعة بالثمن الذي اشتراها به وزيادة ربح معلوم لهما“

‘এটা এমন ক্রয়-বিক্রয়, যেখানে যে মূল্য দিয়ে মাল ক্রয় করা হয়েছে (সেই মূল্য উল্লেখ্য করে) তার সাথে আরো অতিরিক্ত কিছু লাভ গ্রহণ করে পণ্যের মালিকানা রদবদল করা হয়। অথবা অন্য ভাবে বলা যায়, যেখানে পণ্যের ক্রয়মূল্য (উল্লেখ করে দিয়ে) তার সাথে নির্দিষ্ট একটি লাভ গ্রহণ করে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন করা হয়।’(আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়িতিয়্যাহ, খ. ৯, পৃ. ৪৯)

মুরাবাহা হল একটি বাণিজ্যিক চুক্তি যেখানে বিক্রেতা ক্রেতার কাছে পণ্যের ক্রয়মূল্য এবং একটি নির্ধারিত লাভ স্পষ্টভাবে জানিয়ে পণ্যটি বিক্রি করে। এই পদ্ধতিটি ন্যায্যতা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে এটি একটি সাধারণ অর্থায়নের মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মুরাবাহা কত প্রকার ও কী কী?

  • সাধারণ মুরাবাহা: সরাসরি ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে সম্পন্ন হওয়া চুক্তি।
  • ব্যাংকিং মুরাবাহা: ইসলামী ব্যাংক পণ্যটি সরাসরি ক্রয় করে এবং গ্রাহকের কাছে নির্দিষ্ট লাভসহ বিক্রি করে। এটি আধুনিক অর্থনীতিতে বেশি প্রচলিত। উদাহরণ: একজন ব্যক্তি যদি একটি গাড়ি কিনতে চায়, তবে ব্যাংক সেই গাড়িটি ক্রয় করে মালিকানা লাভ করবে এবং পরে গ্রাহকের সঙ্গে মুরাবাহা চুক্তি করবে।
  • বাকি বা নগদ মুরাবাহা: বিক্রেতা একই পণ্য নগদে কম দামে এবং বাকিতে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। এটি শরীয়াহর আওতাধীন বৈধ, যদি উভয় পক্ষের সম্মতি থাকে এবং কোনো অস্পষ্টতা না থাকে। উদাহরণ: একজন গ্রাহক যদি ফার্নিচার কিনতে চায়, তবে বিক্রেতা নগদ মূল্য ৫০,০০০ টাকা বা বাকি মূল্য ৫৫,০০০ টাকায় একটি চুক্তি করতে পারে। এখানে চুক্তি স্বচ্ছ হলে এটি বৈধ।

মুরাবাহা কি জায়েজ? শরীয়াহ অনুযায়ী এটি কতটা গ্রহণযোগ্য?

হ্যা, মুরাবাহা জায়েজ। মুরাবাহা একটি বৈধ বাণিজ্যিক চুক্তি, তবে এটি কিছু শর্তসাপেক্ষে বৈধ। শরীয়াহর নির্দেশনা মেনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে:

১. পণ্যের মালিকানা: বিক্রেতা বা ব্যাংক অবশ্যই পণ্যটি ক্রয়ের পর মালিকানা লাভ করবে।

২. স্বচ্ছ চুক্তি: ক্রয়মূল্য এবং লাভের হার স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

৩. সুদমুক্ত পদ্ধতি: চুক্তির মধ্যে সুদের কোনো ধরণের অস্তিত্ব থাকতে পারবে না।

কুরআনের নির্দেশনায় বলা হয়েছে:

“তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে একে অপরের মধ্যে গ্রাস করো না; তবে ব্যবসা হওয়া চাই পরস্পরের সম্মতিতে।” (সূরা আন-নিসা: ২৯)

মুরাবাহার শর্তাবলি

এক: রা’সুল মাল (প্রথমবার বস্তুটি ক্রয়ের সময় পরিশোধিত মূল্য) এমন হতে হবে যার মিসিল বা অনুরূপ বিদ্যমান রয়েছে। তা পরিমাণ বা পরিমাপ বা গণনা হিসেবে প্রচলিত। যেমন টাকা, ধান, গম, তেল ইত্যাদি। তাই রা’সুল মাল যদি বস্তু সামগ্রী হয় যেমন চেয়ার টেবিল গরু ছাগল ইত্যাদি দ্বারা কোনো বস্তু ক্রয় করা হয়েছে তাহলে এই বস্তুটি মুরাবাহা হিসাবে বিক্রয় করা যাবে না।

কেননা মুরাবাহা হলো প্রথম ক্রয়মূল থেকে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার পণ্যটি বিক্রয় করে দেওয়া। কিন্তু পণ্যটি যদি বস্তু সামগ্রীর বিনিময়ে ক্রয় করা হয় তাহলে তার ক্রয় মূল্য সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা যাবে না।

দুই: দ্বিতীয় ক্রেতা প্রথম বিক্রয়ের মূল্য সম্পর্কে অবগত থাকা। কেননা মুরাবাহা হতে হলে প্রথম ক্রয়ের মূল্য জেনে তার অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা পাওয়া যেতে হবে। আর তা সম্ভব হবে কেবল প্রথম বিক্রয়ের মূল্য জানার পর।

তিন: দ্বিতীয় বিক্রয়ের সময় লভ্যাংশ জানা থাকা। মুরাবাহা যেহেতু প্রথম বিক্রয়ের চেয়ে কিছু অতিরিক্ত লাভ গ্রহণ করে বিক্রয়ের নাম তাই সেই লাভের পরিমাণ কতোকুটু তা জানা থাকা জরুরী।

চার: প্রথম ক্রয় বিক্রয় – যার দ্বারা মুরাবিহ মালের মালিক হয়েছে তা শুদ্ধ হওয়া। যদি প্রথম চুক্তি ফাসিদ হয় তাহলে মুরাবাহা বৈধ নয়। কেননা মুরাবাহা হলো এমন চুক্তি যেখানে প্রথম চুক্তির মূল্য উল্লেখ পূর্বক তার উপর নির্দিষ্ট কিছু লাভ ধরা হয়। কাজেই প্রথম চুক্তি যদি ফাসিদ হয় তাহলে তার মূল্যের ভিত্তিতে লাভ ধরা শুদ্ধ হবে না। (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু : ৪/৪৯৩-৪৯৪)

কুরআন ও হাদিসে মুরাবাহার ভিত্তি

কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:

“তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে একে অপরের মধ্যে গ্রাস করো না; তবে ব্যবসা হওয়া চাই পরস্পরের সম্মতিতে।” (সূরা আন-নিসা: ২৯)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যবসাকে ভালোবাসেন যেখানে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট থাকে।” (মুসনাদে আহমাদ)

মুরাবাহা এই শিক্ষার একটি বাস্তব রূপ, যা বিশ্বাস এবং আস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।

মুরাবাহা পদ্ধতি: ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ

মুরাবাহার একটি সুস্পষ্ট পদ্ধতি রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

  • গ্রাহকের অনুরোধ: গ্রাহক ব্যাংক বা বিক্রেতাকে একটি নির্দিষ্ট পণ্য ক্রয়ের অনুরোধ জানায়।
  • পণ্য ক্রয়: বিক্রেতা বা ব্যাংক পণ্যটি সরাসরি বাজার থেকে ক্রয় করে।
  • মালিকানা স্থানান্তর: বিক্রেতা পণ্যটির মালিকানা লাভ করার পর তা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে।
  • বিক্রয় চুক্তি: বিক্রয়মূল্য, লাভ এবং পরিশোধের পদ্ধতি নির্ধারণ করে চুক্তি সম্পন্ন হয়।
  • পরিশোধ: গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে কিস্তিতে বা এককালীন পরিশোধ করে।

উদাহরণ: একটি ফার্নিচার কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে মুরাবাহা ভিত্তিতে ফার্নিচার কেনার চুক্তি করতে পারে। ব্যাংক প্রথমে ফার্নিচার ক্রয় করে এবং পরে গ্রাহকের কাছে লাভসহ বিক্রি করে।

মুরাবাহার বৈশিষ্ট্য: কেন এটি বিশেষ?

  • স্বচ্ছতা: চুক্তিতে কোনো অজানা বিষয় থাকে না।
  • সুদমুক্ত: এটি সম্পূর্ণ শরীয়াহ-সম্মত এবং সুদবিহীন।
  • ঝুঁকির দায়িত্ব: পণ্যটির মালিকানা এবং দায়ভার বিক্রেতার উপর থাকে।

আরো পড়ুন।

প্রশ্ন উত্তর

১. মুরাবাহা কি সব ধরনের পণ্যের জন্য প্রযোজ্য?

হ্যাঁ, তবে পণ্যটি হালাল হতে হবে এবং শরীয়াহর নির্দেশনা মেনে হতে হবে।

২. মুরাবাহা কি শুধুমাত্র ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যবহৃত হয়?

না, এটি সাধারণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। তবে ব্যাংকিংয়ে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

৩. মুরাবাহার মাধ্যমে কি বাড়ি কেনা সম্ভব?

হ্যাঁ, অনেক ইসলামী ব্যাংক বাড়ি ক্রয়ের জন্য মুরাবাহা চুক্তি প্রদান করে।

৪. মুরাবাহা কি সুদের বিকল্প?

হ্যাঁ, এটি সুদমুক্ত একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি। তবে লাভ নির্ধারণের ভিত্তিতে এটি পরিচালিত হয়।

৫. মুরাবাহা চুক্তি না মানলে কী হয়?

যদি কোনো পক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করে, তবে শরীয়াহর আলোকে সমস্যা সমাধান করা হয়।


পোস্টটি শেয়ার করুন