তাহারাত অর্থ কি? কত প্রকার ও কী কী? গুরুত্ব ও ফজিলত

পোস্টটি শেয়ার করুন

পবিত্রতা—একজন মুমিনের জীবনের শুদ্ধতা ও সৌন্দর্যের পরিচয়। এটি তার আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, এমনকি চিন্তা ও চেতনায় প্রতিফলিত হয়। তাহারাত একজন বিশ্বাসীর অন্তরকে আল্লাহর স্মরণে কোমল করে। তার দেহকে করে ইবাদতের উপযুক্ত, এবং আত্মাকে করে আকাশছোঁয়া।

কুরআন বলেছে, “আল্লাহ পবিত্রদের ভালোবাসেন।”
রাসূল ﷺ বলেছেন, “পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।”

তাহারাত শুধু শারীরিক পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং আত্মিক উদারতা, নফসের সংযম, ও জীবনের সৌন্দর্য। এটি ঈমানের অর্ধেক—সরাসরি জান্নাতের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রথম ধাপ। এই আলোচনায় আমরা দেখব, কীভাবে তাহারাত একজন মুমিনকে পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও পরিশুদ্ধ করে তোলে— কুরআন ও হাদীসের আলোকচ্ছটায়।

তাহারাত শব্দের অর্থ কি?

ভাষাগত সংজ্ঞা: ( طهارة) তাহারাত শব্দের অর্থ হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এই শব্দটি দৃষ্টিগোচর অপবিত্রতা যেমন, পেশাব ইত্যাদি আবার অদৃশ্য অপবিত্রতা যেমন, দোষত্রুটি ও গোনাহ ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকার অর্থ প্রদান করে।

শারঈ পরিভাষায় তাহারাতের সংজ্ঞা:

النظافة من النجاسة: حقيقية كانت وهي الخَبَث، أو حُكمية وهي الحَدَث

‘তাহারাত অর্থ অপবিত্রতা থেকে পরিষ্কার হওয়া। সেটা বাস্তবিক অপবিত্রতা হোক, যাকে বলা হয় খাবাস, অথবা হুকুমী অপবিত্রতা, যাকে বলা হয় হাদাস।’ ( আল-লুবাব শরহুল কিতাব : ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০; আদ্-দুররুল মুখতার : ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৯)

খাবাস হলো:

عين مستقذرة شرعاً

‘এমন বস্তু শরিয়াহ যেটিকে স্বয়ং বস্তু হিসেবেই নোংরা ও ঘৃণিত মনে করে।’

হাদাস হলো:

وصف شرعي يحل في الأعضاء يزيل الطهارة

‘একটি শরয়ি অবস্থা, দেহের অঙ্গসমূহে উপনীত হয়ে পবিত্রতা দূর করে দেয়।’

তাহারাতের প্রকারভেদ

তাহারাতের প্রকারভেদ: তাহারাতের সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে, তাহারাত দুই প্রকার:

১. খাবাস থেকে তাহারাত, যা দেহ, কাপড় ও স্থানের সাথে সম্পর্কিত।
২. হাদাস থেকে তাহারাত, যা দেহের সাথে সম্পর্কিত।

হাদাস থেকে পবিত্রতা অর্জনের উপায় হলো ৩ টি

  • বড় হাদাসের জন্য: গোসল
  • ছোট হাদাসের জন্য: ওজু
  • উভয়ের বিকল্প, যদি পানি ব্যবহার সম্ভব না হয়: তায়াম্মুম

খবস বা অপবিত্র বস্তু দূর করার পদ্ধতি হলো ৩ টি

  • ধোয়া
  • মুছা
  • ছিটানো

সুতরাং, তাহারাতের অন্তর্ভুক্ত হলো: ওজু, গোসল, অপবিত্রতা দূরীকরণ, তায়াম্মুম এবং এগুলোর সাথে সম্পর্কিত সব বিষয়ে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি।

পবিত্রতার গুরুত্ব ও ফজিলত

ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর। পবিত্রতা দুই প্রকার— একটি বাস্তবিক পবিত্রতা, যা কাপড়, শরীর এবং নামাযের স্থানকে অপবিত্রতা থেকে পরিশুদ্ধ রাখাকে বোঝায়;

অন্যটি হলো শারঈ বা হুকুমি পবিত্রতা, যা অজুর মাধ্যমে অঙ্গসমূহকে হালকা অপবিত্রতা (حدث) থেকে, আর গোসলের মাধ্যমে সমস্ত বাহ্যিক অঙ্গকে বড় অপবিত্রতা (جنابة) থেকে শুদ্ধ করাকে বোঝায়। এই পবিত্রতা নামাযের জন্য অপরিহার্য শর্ত।

পবিত্র অবস্থায় নামায আদায় করা মানেই আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। যদিও হুকমি অপবিত্রতা দৃশ্যমান নয়, তবুও এগুলো এক প্রকার আত্মিক বা মানসিক নাপাক।

এ অবস্থায় নামায পড়া আল্লাহর মহত্ব ও গরিমার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, আর ইসলামের পরিচ্ছন্নতার মূলনীতি বিরোধী।

পবিত্রতা মানুষকে শুধু বাহ্যিকভাবেই নয়, বরং আত্মিকভাবেও পরিচ্ছন্ন করে তোলে। ইসলাম এই দ্বিমাত্রিক পবিত্রতার প্রতি যে গুরুত্ব দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে ইসলাম একজন মুসলিমকে সম্পূর্ণরূপে নির্মল ও বিশুদ্ধ দেখতে চায়—চেহারায়, শরীরে, পোশাকে, পরিবেশে এবং আচরণে।

এছাড়া, পরিচ্ছন্নতা স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম উপায়। শরীরের যে অঙ্গগুলো নিয়মিত ধুলা-ময়লা ও জীবাণুর সংস্পর্শে আসে, সেগুলোর প্রতিদিন ধোয়া এবং জানাবাতের পর গোসল করা—এসবই শারীরিক সুস্থতার নিশ্চয়তা দেয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলে—পরিচ্ছন্নতা হলো রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম মাধ্যম, এবং “প্রতিরোধই হলো উত্তম চিকিৎসা।”

আল্লাহ তাআলা এই পবিত্রতাপ্রিয় মানুষদের প্রশংসা করেছেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালোবাসেন” — (সূরা বাকারা, ২:২২২)

এবং কুবার অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেন:

“তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা পবিত্রতা ভালোবাসে, আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন” — (সূরা তাওবা, ৯:১০৮)

তাই একজন মুসলিমের উচিত সমাজে পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে ওঠা—চেহারা, পোশাক, আচরণ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ একদল সাহাবিকে বলেছিলেন:

“তোমরা তোমাদের ভাইদের কাছে যাচ্ছো, তোমাদের বাহনগুলো ও পোশাকগুলো ঠিকঠাক করে নাও, যাতে তোমরা মানুষের মাঝে একটি সৌন্দর্যময় দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠো; নিশ্চয়ই আল্লাহ অশ্লীলতা ও অশালীনতা পছন্দ করেন না।”

🌿 তাহারাত (পবিত্রতা) ওয়াজিব হওয়ার ১০টি শর্ত

১. ইসলাম গ্রহণ করা

  • অধিকাংশ ওলামার মতে, কাফেরদের উপর তাহারাত ওয়াজিব নয়।
  • তবে অনেকে বলেন, যদি ইসলাম পৌঁছে যায়, তাহলেও তাদের উপর শারঈ বিধান প্রযোজ্য হয় (কিয়ামতের দিনে বিচারের জন্য)।
  • তবে দুনিয়াতে কাফেরদের নামাজ-তাহারাত শুদ্ধ নয়।

২. আক্‌ল থাকা (বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া)

  • পাগল ও অজ্ঞান ব্যক্তির উপর তাহারাত ফরজ নয়।
  • তবে মাতাল ব্যক্তি দোষমুক্ত নয়; তার ওপর তাহারাত ওয়াজিব।

৩. বালেগ হওয়া (সাবালক হওয়া)

  • বালেগ হওয়ার লক্ষণ: স্বপ্নদোষ, লজ্জাস্থানে চুল ওঠা, হায়েয, গর্ভধারণ, বয়স (১৫/১৭/১৮ বছর মতভেদ)।
  • শিশুর ওপর ফরজ নয়, তবে ৭ বছর বয়সে তাহারাতের আদেশ, ১০ বছর হলে প্রয়োজনে শাসন করতে বলা হয়েছে।

৪. হায়েয বা নেফাস বন্ধ হওয়া:

  • যখন রক্ত বন্ধ হয়, তখন তাহারাত ওয়াজিব হয়।

৫. নামাযের সময় প্রবেশ:

  • নামাযের সময় প্রবেশ করলে তাহারাত ওয়াজিব হয়।

৬. ঘুম না থাকা:

  • ঘুমন্ত ব্যক্তি নামাজে তাহারাত থেকে বিরত থাকে, তবে পরে তা আদায় করতে হয়।

৭. ভুলে না যাওয়া:

  • কেউ ভুলে গেলে পরে তা আদায় করতে হবে।

৮. ইচ্ছার বিরুদ্ধে না হওয়া (ইকরাহ না থাকা):

  • জোরপূর্বক যদি কেউ কোনো কাজ করতে বাধ্য হয়, তাহলেও তা পরে আদায় করতে হয় (ইজমা অনুযায়ী)।

৯. পবিত্র পানি বা পবিত্র মাটি পাওয়া:

  • যদি উভয়ই অনুপস্থিত হয়, তবে মতভেদ আছে:
  • কেউ বলেন: তাহারাতবিহীন নামাজ পড়বে এবং পরে কাজা করবে।
  • কেউ বলেন: নামায পড়বে না, কেবল পরে কাজা করবে।

বিস্তারিত আলোচনা তায়াম্মুম অধ্যায়ে আসবে।

১০. সক্ষমতা থাকা (যতটা সম্ভব)

  • যিনি শারীরিকভাবে অক্ষম নন, তার ওপর তাহারাত ওয়াজিব।
  • সক্ষমতার পরিমাণ অনুযায়ী যেটুকু সম্ভব, সেটুকুই ওয়াজিব হয়।

তাহারাত এর লক্ষ্য

১. অজু (উজু)

অজু হল নামাজের শুদ্ধতার জন্য একটি আবশ্যিক শর্ত। অজু ছাড়া নামাজ বৈধ নয়। তবে অজু থাকা সত্ত্বেও নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক নয়; নামাজ না পড়লেও একজন মুসলিম অজু করতে পারেন।

অজুর ধরন

ফরজ অজু: আবশ্যিক ইবাদতের জন্য যেমন ফরজ নামাজ এবং ফরজ তাওয়াফ।

সুন্নত বা মুস্তাহাব অজু: নফল ইবাদতের জন্য যেমন দোয়া, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, নফল তাওয়াফ এবং নফল নামাজ।

২. গোসল

গোসল বলতে বুঝায় পবিত্র পানি দ্বারা সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করা এবং এ উদ্দেশ্যে নিয়ত করা। গোসল ফরজ হওয়ার কিছু কারণ:

  • সহবাস।
  • বীর্যপাত।
  • ঋতু বন্ধ হওয়া।
  • সন্তান জন্ম দেওয়ার পর নেফাস।
    গোসল শুধু ফরজ নয়, এটি সুন্নতও হতে পারে, যেমন: জুমার দিনে নামাজের আগে গোসল করা।

৩. তায়াম্মুম

যখন পানি পাওয়া যায় না, অথবা পানি ব্যবহার করা সম্ভব নয় (রোগ বা ভ্রমণের কারণে), তখন তায়াম্মুম করা যায়। কুরআন, হাদিস ও আলেমদের ঐকমত্যে তায়াম্মুমের অনুমোদন প্রমাণিত।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

“আর যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা ভ্রমণরত থাকো, কিংবা কারও পায়খানা থেকে আসার প্রয়োজন হয় অথবা তোমরা স্ত্রীদের স্পর্শ কর এবং পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো এবং মুখমণ্ডল ও হাত মুছে নাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আন-নিসা: ৪৩)

তায়াম্মুম গোসল ও অজুর বিকল্প হিসেবে নির্ধারিত। তবে এটি নির্দিষ্ট শর্তের আওতায় কার্যকর।

উপসংহার

তাহারাত ইসলামের একটি মৌলিক অংশ। এটি শুধুমাত্র বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং এটি আত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। পবিত্রতা ছাড়া ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত তাহারাত বজায় রাখা এবং কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ করা।

সচরাচর জিজ্ঞাসা

প্রশ্ন ১: তাহারাত কি শুধুমাত্র নামাজের জন্য প্রয়োজন?

উত্তর: না, তাহারাত শুধু নামাজের জন্য নয়, বরং সব ধরনের ইবাদতের জন্য অপরিহার্য।

প্রশ্ন ২: ছোট অপবিত্রতা এবং বড় অপবিত্রতার মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তর: ছোট অপবিত্রতা দূর করতে অজু যথেষ্ট, তবে বড় অপবিত্রতার জন্য গোসল করা আবশ্যক।

প্রশ্ন ৩: অপবিত্রতা দূর করার সঠিক পদ্ধতি কী?

উত্তর: কাপড় বা দেহে অপবিত্রতা থাকলে তা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত। অপবিত্র স্থানে নামাজ পড়ার আগে সেই স্থানও পবিত্র করতে হবে।


পোস্টটি শেয়ার করুন