ঘোড়ার মাংস কি হালাল? ইসলাকিম স্কলারদের অভিমত

পোস্টটি শেয়ার করুন

ক্লাসে ঢুকতেই আমার এক ছাত্রী প্রশ্ন করে উঠলো – জনাব, ঘোড়ার মাংস খাওয়া কী হালাল? যদিও প্রশ্নটি করেছিলো হুট করে কিন্তু আমাকে উত্তরটি দিতে হয়েছিলো বেশ ভেবে চিন্তে। কেননা ঘোড়া একটি বিশেষ প্রাণী। সেটা হিংস্র জন্তুর মতো চিড়ে ফেড়ে খায় না। আবার গরু ছাগলের মতো গবাদি পশুও নয়। 

যুদ্ধের ময়দানে ঘোড়া পরম বন্ধুর মতো আচরণ করে। পবিত্র কুরআনে ঘোড়ার বহুমুখী প্রশংসা করা হয়েছে। তাই ঘোড়া নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। 

আমি আমার ছাত্রীটিকে বলেছিলাম আগামীকাল এসে তোমাকে উত্তর জানাবো। তার উত্তরটি জানতে করতে গিয়ে একটি আর্টিকেল তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। অতপর যখন দেখলাম গুগলে বেশ কিছু মানুষ প্রতিদিন – ঘোড়ার মাংশ কি হালাল? লিখে সার্চ করছে, তখন ভাবলাম আমার উত্তরটি একটু পরিমার্জন করে ওয়েবসাইটে পাবলিশ করে দেই। 

ঘোড়ার মাংস কি হালাল?

হ্যা, ঘোড়ার মাংস হালাল, তবে মাকরুহে তানযিহি (হালকা অপছন্দনীয়)। তবে ঘোড়ার মাংস হালাল কি না এই বিষয়ে ইসলামিক স্কলারগণ মতোবিরোধ করেছেন। কেউ বলেছেন হালাল। কেউ বলেছেন মাকরুহ। কেউ বলেছেন হারাম। 

ঘোড়ার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মালিকের আনুগত্য। যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবিচল থাকা। তাকে বাহন হিসাবে ব্যবহার করা ইত্যাদি। 

এসব দিক বিবেচনা করে ইমামগণ ঘোড়ার মাংস খাওয়ার বিষয়ে ইসলামিক ফয়সালা নির্ণয় করতে মতোবিরোধ করেছেন। 

তবে আমরা সব থেকে উত্তম ও রেফারেন্সের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য অভিমতটি সকল পাঠকের জন্য বিশ্লেষণ করে দিচ্ছি। 

ঘোড়ার মাংস সম্পর্কে ইমামদের অভিমত

  • ইমাম আবু হানিফা – রাহিমাহুল্লাহ – ঘোড়ার মাংস খাওয়া মাকরুহ তানযিহি বলে অভিমত দিয়েছেন। এটাই হানাফি মাযহাবে প্রাধান্যযুক্ত অভিমত। 
  • ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ – রাহিমাহুমাল্লাহ – ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল বলেছেন। এটাই শাফি ও হাম্বলি মাযহারের অভিমত। 
  • ইমাম মালিক – রাহিমাহুল্লাহ – এর মাযহাবের এক অভিমত অনুযায়ী হালাল। অপর মতে মাকরুহ। আর আরেক অভামত অনুসারে ঘোড়ার মাংস খাওয়া হারাম। 

এই চার মাযাহের মতোবিরোধের ভিত্তিতে প্রত্যেক যুগেযুগে উলামায়ে কেরাম ঘোড়ার মাংসের ব্যাপারে তাদের অভিমত দিয়ে আসছেন।

তবে পৃথিবীব্যাপী বর্তমানে দুটি অভিমত বেশ প্রশিদ্ধ। একটি হলো ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল। আর অপরটি হলো হারাম। 

হালাল ও তার ইভিডেন্স

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ – রাদিয়াল্লাহু – থেকে বর্ণনা করেন, 

রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – খায়বারের দিন গৃহপালিত গাধার মাংস খেতে নিষেধ করেছেন। তবে ঘোড়ার ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি – ৩৯৮২) 

আসমা বিনতে আবি বাকর – রাদিয়াল্লাহু আনহা – বর্ণনা করেন,

আমরা রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – এর যুগে একটি ঘোড়া জবাই করি অতপর তা ভক্ষন করি। (সহিহ বুখারি – ৫১৯১)

জাবির – রাদিয়াল্লাহু আনহু – থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,

আমরা রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – এর সাথে ভ্রমণ করছিলাম তখন আমরা ঘোড়ার মাংস ও দুধ পান করি। (দারাকুতনি ও বায়হাকি)

উল্লেখিত সবগুলো হাদিসই ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল প্রমাণ করছে। তাছাড়া এই হাদিসগুলো বিশুদ্ধ সূত্র ও স্পষ্ট শব্দে বর্ণিত। তা প্রশ্নাতীতভাবে ঘোড়ার মাংস হালাল করে।

ঘোড়ার মাংস মাকরুহ ও তার ইভিডেন্স

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

তোমাদের আরোহণ ও শোভা সৌন্দর্যের জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা। আর তিনি সৃষ্টি করবেন এমন অনেক বস্তু, যার ব্যাপারে তোমরা অবগত নও। (সুরা : নাহল -৮)

আয়াতটির তাফসির:  আয়াতটিতে বাহন ও সৌন্দর্যের উপকরণ হিসেবে ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ পাক মানুষের উপকার সাধনের লক্ষ্যে এগুলো সৃষ্টি করেছেন। 

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি শফি – রাহিমাহুল্লাহ – বলেন, 

‘পবিত্র কোরআনে উট, গরু ও ছাগল ইত্যাদির উপকারিতার কথা নানার স্থানে আলোচনা হয়েছে। সেসব উপকারের মধ্যে গোশত খাওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকার। 

কিন্তু আলোচিত আয়াতে ঘোড়া, গাধা ও খচ্চরের কথা আলোচনা করে তার উপকার হিসাবে আরোহণ ও শোভা বর্ধনের কথা বলা হয়েছে। ভক্ষণের কথা বলা হয়নি। 

তাছাড়া ঘোড়ার সাথে আলোচিত দুটি প্রাণী খচ্চর ও গাধার গোশত হারাম হওয়ার বিষয়ে সব ইসলামী আইনবিদ একমত। তাই ঘোড়াও অন্য দুটির মতো হবে। 

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ – রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – ঘোড়ার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন।’ ( আবু দাউদ : ২/৫৩১)। 

অভিমত পর্যালোচনা

উপরে দুটি মতের দালায়িল উল্লেখ করে এসেছি। প্রথম পক্ষের অভিমতের পক্ষে বর্ণিত হাদিসগুলো ঘোড়ার মাংস হালাল প্রমাণ করে। আর দ্বিতীয় পক্ষের হাদিসগুলো হারাম প্রমাণ করে। 

অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে হাদিসগুলো পরস্পর বিরোধী। কিন্তু  তীক্ষদৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে হাদিসগুলো পরস্পর বিরোধী নয়।

যারা ঘোড়ার মাংস ভক্ষণ হারাম বলেছেন তারা যেসব হাদিসে ঘোড়া খাওয়াকে হালাল বলা হয়েছে সে সব হাদিসের একটি ব্যাখা দিয়ে থাকেন।

তারা বলেন, মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  যুদ্ধের সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে অর্থাৎ খাবারের রসদ বাড়াতে ঘোড়ার গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। 

তবে  যারা হালাল বলেছেন তাদের পক্ষের দলিলগুলো অধীক শক্তিশালী। কেননা সেই হাদিসের মধ্যে স্পষ্পভাবে ঘোড়ার মাংস ভক্ষণের কথা এসেছে। 

যদি বলা হয় যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তাগিদে এর অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো তাহলে প্রশ্ন থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া ব্যতীত অন্য প্রাণী যেমন গাধা বা খচ্চর খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো না কেন?

যেহেতু ঘোড়ার মাংস খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাই বুঝা যায় এটি হালাল প্রাণী। 

আর কুরআনের আয়াতে ঘোড়াকে বাহন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী বলার দ্বারা এটা খাওয়া হারাম প্রমাণ হয় না। একটি প্রাণীর দ্বারা মানুষ যতে ধরণের উপকার লাভ করতে পারে তার সবকিছু একটি আয়াতে আলোচনা হওয়া আবশ্যক নয়। 

উভয় পক্ষের অভিমত ও দালায়িল আলোচনা করে আমরা দেখতে পাই ঘোড়া হালাল অভিমতটি অধিক যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য।

কিছু প্রশ্ন উত্তর

১. ইসলামিক শরিয়তে কীভাবে নির্ধারণ করা হয় কোন মাংস হালাল বা হারাম?

ইসলামে কোনো প্রাণীর মাংস হালাল বা হারাম হওয়ার নির্ধারিত বিধান কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে নির্ধারিত হয়। যদি কোনো প্রাণী সম্পর্কে স্পষ্ট অনুমতি থাকে, তবে তা হালাল। আর যদি হারামের দলিল পাওয়া যায়, তবে তা হারাম।

২. ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে কেন ঘোড়ার মাংস নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে?

মতবিরোধের মূল কারণ বিভিন্ন হাদিসের ব্যাখ্যার পার্থক্য এবং ইজতিহাদের পার্থক্য। কিছু স্কলার সহিহ হাদিসের ভিত্তিতে একে হালাল বলেছেন, আবার কিছু স্কলার নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের আলোকে একে মাকরুহ বা নিষিদ্ধ মনে করেছেন।

৩. ঘোড়ার দুধ কি হালাল?

হ্যাঁ, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোড়ার দুধ হালাল

ব্যাখ্যা:

  • খাদ্যের হালাল বা হারাম নির্ধারণ: ইসলামে সাধারণ নীতি হলো, কোনো খাদ্য হারাম হওয়ার জন্য কুরআন বা সহিহ হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকতে হবে।
  • ঘোড়া খাওয়ার বিধান: নবী করিম (সা.)-এর যুগে সাহাবিরা ঘোড়ার মাংস খেয়েছেন, এবং রাসূল (সা.) তা নিষেধ করেননি। (সহিহ বুখারি, ৫৫২০; সহিহ মুসলিম, ১৯৪২)
  • দুধের বৈধতা: যেসব প্রাণীর মাংস হালাল, তাদের দুধও সাধারণত হালাল হয়। যেহেতু ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল, তাই তার দুধও হালাল বলে গণ্য হয়।

৪. বর্তমান সময়ে কি কোনো দেশে ঘোড়ার মাংস খাওয়া প্রচলিত আছে?

হ্যাঁ, কিছু দেশে, বিশেষত মধ্য এশিয়া, মঙ্গোলিয়া, জাপান এবং ইউরোপের কিছু অংশে ঘোড়ার মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে এটি ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্কিত রয়ে গেছে।

৫. ইসলামিক ফিকহের কোন মাজহাব অনুসারে ঘোড়ার মাংস হালাল বা মাকরুহ?

  • হানাফি মাজহাব: মাকরুহ (নিষিদ্ধ নয়, তবে পরিহারযোগ্য)
  • শাফি ও হাম্বলি মাজহাব: হালাল
  • মালিকি মাজহাব: কিছু বর্ণনায় হালাল, কিছুতে মাকরুহ

৬. যদি কেউ ঘোড়ার মাংস খেতে না চায়, তবে কি এটা গুনাহ হবে?

না, এটি ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। ইসলামে নির্দিষ্ট হালাল খাবার খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়, বরং যেটি শরীরের জন্য উপকারী ও মনের জন্য স্বস্তিদায়ক, সেটি খাওয়া যেতে পারে।

৭. ইসলামে কি পশুর দুধ খাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে?

না, ইসলামে গৃহপালিত পশুর দুধ (যেমন গরু, উট, ছাগল, ভেড়া) খাওয়া অনুমোদিত। তবে খচ্চর বা গাধার দুধের ক্ষেত্রে স্কলারদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।


পোস্টটি শেয়ার করুন