রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া আমাদের সবার জীবনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কখনো কোনো দুঃস্বপ্নের কারণে, কখনো কোনো অজানা কারণে, আবার কখনো কোনো শারীরিক বা মানসিক অস্থিরতার কারণে আমাদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। ইসলাম এই সময়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ঘুম ভেঙে গেলে দোয়া ও জিকির করার প্রতি আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের শিখিয়েছেন, যদি কেউ রাতে ঘুম ভেঙে যায়, তবে সে যেন আল্লাহর স্মরণ করে এবং বিশেষ কিছু দোয়া পড়ে। কেননা, রাতের শেষ অংশ দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং তাঁর বান্দাদের ডাকতে থাকেন—
“কেউ কি আছে যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আর আমি তাকে ক্ষমা করব? কেউ কি আছে যে কিছু চাইবে, আর আমি তাকে তা দিয়ে দেব?” (সহিহ বুখারি: ১১৪৫, সহিহ মুসলিম: ৭৫৮)
এ সময়ের দোয়া ও জিকির মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, গুনাহ মাফের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়। তাই যদি রাতে ঘুম ভেঙে যায়, তবে অযথা দুশ্চিন্তা না করে বরং আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত, যেন তিনি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতকে সুন্দর করে দেন।
📌 এই ব্লগে আমরা আলোচনা করবো:
✅ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কী করা উচিত?
✅ রাসূল ﷺ আমাদের কোন দোয়া শিখিয়েছেন?
✅ এই দোয়া পড়ার ফজিলত কী?
👉 চলুন, বিস্তারিত জানি!
রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দোয়া । বাংলা ও আরবি
আরবি:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، الْحَمْدُ لِلَّهِ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ
বাংলা উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুওয়া ‘আলা কুল্লি শাই’ইন ক্বাদীর। আলহামদুলিল্লাহি, সুবহানাল্লাহি, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়ালা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। সার্বভৌম ক্ষমতা ও সমস্ত প্রশংসা তাঁরই, এবং তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, সমস্ত পবিত্রতা আল্লাহর, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, আল্লাহ মহান। এবং আল্লাহ ব্যতীত কোনো শক্তি ও সামর্থ্য নেই।

মূল হাদিস (আরবি):
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ تَعَارَّ مِنَ اللَّيْلِ، فَقَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ، ثُمَّ قَالَ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي، أَوْ دَعَا، اسْتُجِيبَ لَهُ، فَإِنْ تَوَضَّأَ وَصَلَّى قُبِلَتْ صَلَاتُهُ
বাংলা অনুবাদ: উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি রাতের কোনো সময়ে জাগ্রত হয়ে বলে:
‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। সার্বভৌম ক্ষমতা ও সমস্ত প্রশংসা তাঁরই, এবং তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ তারপর বলে: ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়ালা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’ তারপর যদি সে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তার জন্য ক্ষমা করা হয়। আর যদি সে ওজু করে ও নামাজ পড়ে, তাহলে তার নামাজ কবুল হয়।”
হাদিসের সূত্র:
- সহিহ বুখারি: (সংখ্যা: ১১৫৪)
রাতে এই দোয়া পড়ার ফজিলত
রাতে ঘুম ভেঙে গেলে উপরোক্ত দোয়া পড়ার অনেক ফজিলত রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে,
✅ দোয়া কবুল হয় – যে ব্যক্তি এই দোয়া পড়ে এবং আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চায়, তার দোয়া কবুল করা হয়।
✅ গুনাহ মাফ হয়ে যায় – যদি কেউ এই দোয়া পড়ে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।
✅ নামাজ কবুল হয় – কেউ যদি এই দোয়া পড়ার পর ওজু করে এবং নামাজ পড়ে, তাহলে তার নামাজ কবুল হয়।
✅ রাতের শেষ অংশে দোয়া কবুলের বিশেষ সুযোগ – আল্লাহ তা‘আলা শেষ রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে তাঁর বান্দাদের ডাকেন, তাই এ সময় দোয়া করা খুবই ফজিলতপূর্ণ।
এটা ছাড়া অন্য কোনো দোয়া পড়া যাবে কি?
হ্যাঁ, রাতে ঘুম ভেঙে গেলে অন্যান্য কিছু দোয়া ও জিকির করা যায়। যেমন:
📌 ১. রাতের নফল ইবাদতের দোয়া
اللَّهُمَّ رَبَّ جِبْرِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِك فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ، اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ، إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা রাব্বা জিবরাইল, ওয়া মিকা’ইল, ওয়া ইস্রাফিল, ফাতিরাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ, ‘আলিমাল গাইবি ওয়াশ্ শাহাদাহ, আনতা তাহকুমু বাইনা ইবাদিকা ফিমা কানো ফিহি ইয়াখ্তালিফুন, ইহ্দিনি লিমা ইখ্তুলিফা ফিহি মিনাল হাক্কি বি ইজনিকা, ইন্নাকা তাহ্দি মান তাশাউ ইলা সিরাতিন মুস্তাকিম।
📖 সূত্র: সহিহ মুসলিম (৭৭০)
📌 ২. তাহাজ্জুদের সময় রাসূল ﷺ-এর পড়া দোয়া
اللَّهُمَّ لَكَ الحَمْدُ، أَنْتَ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَن فِيهِنَّ، وَلَكَ الحَمْدُ، أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَن فِيهِنَّ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লাকা আল-হামদ, আন্তা নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়ামান ফিহিন্না, ওয়ালাকা আল-হামদ, আন্তা ক্বাইয়্যিমুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়ামান ফিহিন্না।
📖 সূত্র: সহিহ বুখারি (১১২০)
📌 ৩. রাতের ক্বিরাতের দোয়া
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ
উচ্চারণ: ইয়া হাইয়ু, ইয়া ক্বাইয়্যুম, বিরাহমাতিকা আসতাগীস।
📖 সূত্র: তিরমিজি (৩৫২৪)
এ সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কোন জিকির করা যায়?
উত্তর: রাতে ঘুম ভেঙে গেলে নিম্নলিখিত জিকিরগুলো করা যেতে পারে—
- সুবহানাল্লাহ (আল্লাহ পবিত্র)
- আলহামদুলিল্লাহ (সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য)
- আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান)
- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই)
- লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে শক্তি ও সামর্থ্য নেই)
✅ প্রশ্ন: রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কোন দোয়া পড়লে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
উত্তর: যদি রাতে ঘুম ভেঙে দুঃস্বপ্ন দেখেন বা কোনো অশুভ অনুভূতি হয়, তবে এই দোয়া পড়া উত্তম—
আরবি:
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ
বাংলা উচ্চারণ: আউযু বিখালিমাতিল্লাহিত্ তাম্মাতি মিন গাদ্বাবিহি ওয়া ইক্বাবিহি ওয়া শার্রি ইবাদিহি ওয়া মিন হামাজাতিশ্ শাইয়াত্বীনি ওয়া আই ইয়াহদুরুন।
📖 সূত্র: তিরমিজি (৩৫২৮)
✅ প্রশ্ন: রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কি আবার ঘুমানোর আগে ওজু করা উচিত?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূল ﷺ বলেছেন, রাতে ঘুমানোর আগে এবং ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর ওজু করা উত্তম। এটি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে এবং ইবাদত করার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
📖 সূত্র: সহিহ মুসলিম (২৭৬৩)
✅ প্রশ্ন : রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কি সাথে সাথে নামাজ পড়া উচিত?
উত্তর:যদি সম্ভব হয়, তাহলে ওজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া উত্তম। বিশেষত, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার এটি একটি উপযুক্ত সময়।
📖 সূত্র: সহিহ মুসলিম (৭৫৭)
✅ প্রশ্ন ৭: রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কুরআন পড়া যাবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি খুবই ভালো একটি অভ্যাস। বিশেষ করে, সূরা আল-ইখলাস, সূরা আল-ফালাক, সূরা আন-নাস, আয়াতুল কুরসি ইত্যাদি তিলাওয়াত করা উত্তম।
📖 সূত্র: সহিহ মুসলিম (৮০৮)
✅ প্রশ্ন ৮: রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কী করলে শান্তি পাওয়া যাবে?
উত্তর:
- দোয়া ও জিকির করা
- আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা
- কুরআন তিলাওয়াত করা
- যদি সম্ভব হয়, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া