রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা । সম্পূর্ণ দোয়া । অর্থ, তাৎপর্য ও গুরুত্ব

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামের প্রতিটি দোয়া গভীর অর্থ ও তাৎপর্যে পরিপূর্ণ। এর মধ্যে একটি অনন্য দোয়া হল “رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا” – রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা । এ দোয়াটি আমাদের জীবন ও পরকালীন সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা । অর্থ ও উচ্চারণ

আরবি:

رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

উচ্চারণ: রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা ওয়াগফির লানা, ইন্নাকা আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির।

অর্থ: হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য আমাদের আলো পূর্ণ করে দিন। এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।

উৎস ও প্রেক্ষাপট

এই দোয়াটি কুরআনুল কারিমের সূরা তাহরীমের ৮ নম্বর আয়াতের অংশ। সম্পূর্ণ আয়াতটি হলো:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَىٰ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

বাংলা অনুবাদ: “হে মুমিনগণ! তওবা কর আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচ দিয়ে নহর প্রবাহিত হয়। সেদিন আল্লাহ রাসূলকে এবং তাঁর সাথীদের অপমানিত করবেন না। তাদের নূর (আলো) তাদের সামনে ও ডানদিকে দ্রুত গতিতে চলবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য আমাদের আলো পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।’” (সূরা তাহরীম: ৮)

অর্থ ও ব্যাখ্যা

এই দোয়াটি মূলত কিয়ামতের দিন মুমিনদের নূর বা আলো বৃদ্ধির জন্য। মুমিনরা সেদিন তাদের ঈমান ও আমলের ভিত্তিতে আলো পাবেন, যা তাদের সামনে ও ডানদিকে চলবে। কিন্তু পথের অন্ধকার ও কঠিন পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন – যেন তাঁদের আলো পূর্ণ করা হয় এবং নিরাপদে জান্নাতে পৌঁছাতে পারেন।

রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা  আরবি ও বাংলা
রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা আরবি ও বাংলা

আরো পড়ুন:

এই দোয়ার তাৎপর্য

১. হিদায়াতের জন্য প্রার্থনা: এই দোয়াটি এমন এক নূরের কথা বলে, যা শুধু দুনিয়ার আলো নয়, বরং আখিরাতের পথপ্রদর্শক।
২. গুনাহ মাফের আবেদন: আলো পূর্ণ করার সাথে সাথে ক্ষমা প্রার্থনাও এর অন্তর্ভুক্ত। এটি আমাদের তওবা ও ক্ষমার প্রতি গুরুত্বারোপ করে।
৩. আল্লাহর উপর নির্ভরতা: এই দোয়া মানুষকে আল্লাহর নিকট সর্বদা আশ্রয় প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।

জীবনে প্রয়োগ ও উপকারিতা

  • আত্মশুদ্ধি ও তওবার প্রেরণা: এই দোয়া পাঠ আমাদের আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য তওবার প্রতি মনোযোগী করে।
  • আখিরাতের প্রস্তুতি: এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আখিরাতের সফলতা শুধুমাত্র আল্লাহর করুণা ও হিদায়াতে নির্ভরশীল।
  • আত্মবিশ্বাস ও স্থিরতা: জীবনের সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই দোয়া আমাদেরকে মানসিকভাবে শক্তিশালী ও স্থির থাকতে সাহায্য করে।

কখন ও কিভাবে পড়বেন?

  • নামাজের সিজদায়: বিশেষত তাহাজ্জুদ নামাজের সিজদায় এই দোয়া পড়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
  • জিকির ও তওবার পর: তওবা ও ইস্তেগফারের পর এই দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে হিদায়াত ও ক্ষমা পাওয়ার অন্যতম উপায়।
  • কিয়ামতের দিন স্মরণ করে: আখিরাতের কথা স্মরণ করে এই দোয়া পড়লে ইমানের গভীরতা বৃদ্ধি পায়।

এই দোয়ার ফজিলত

  • আলো বৃদ্ধি ও ক্ষমা প্রাপ্তি: কিয়ামতের দিন আলো বৃদ্ধি ও গুনাহ মাফের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া।
  • হিদায়াত ও ঈমানের স্থিরতা: দুনিয়াতে সঠিক পথে চলার জন্য আল্লাহর হিদায়াত প্রার্থনা করা হয় এই দোয়ার মাধ্যমে।
  • কষ্ট ও বিপদ থেকে মুক্তি: জীবনের বিভিন্ন সংকট ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই দোয়া অত্যন্ত কার্যকরী।

প্রাসঙ্গিক হাদিস

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“কিয়ামতের দিন মুমিনদের নূর তাদের ঈমান ও আমলের উপর নির্ভর করবে। কেউ কারও আলো থেকে উপকৃত হতে পারবে না।” (সহীহ মুসলিম)

দুনিয়ায় যে আমল করলে কিয়ামতে নূর পাওয়া যাবে

কিয়ামতের দিন মুমিনদের জন্য নূর (আলো) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা তাদের জান্নাতের পথে সঠিকভাবে পরিচালিত করবে। কুরআন ও হাদিসে এমন অনেক আমলের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলো দুনিয়াতে করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা নূরের মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। আসুন জেনে নেই সেই গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো:

১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

“নামাজ কেয়ামতের দিন মুমিনের জন্য নূর হবে।” (সহীহ মুসলিম)

নামাজ হচ্ছে ঈমানের প্রমাণ এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যম। যারা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আলোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

২. অন্ধকারে মসজিদে যাওয়া

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

“যারা অন্ধকারে (ফজর ও ঈশার সময়) মসজিদে আসে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূর দেয়া হবে।”
(তিরমিজি)

বিশেষত ফজর ও ঈশার নামাজ মসজিদে জামাতে আদায় করলে কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূর লাভ করা যাবে।

৩. কুরআন তিলাওয়াত করা

কুরআনুল কারিম হলো হিদায়াত ও আলো। যারা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করে, তাদের অন্তরে আলোর সঞ্চার হয়, যা কিয়ামতের দিনও নূর হিসেবে প্রকাশিত হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

“এই কিতাব, আমরা তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসো।” (সূরা ইবরাহিম: ১)

৪. সাদকা ও দান করা

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“সাদকা কিয়ামতের দিন দানকারীর জন্য নূরের কারণ হবে।” (সহীহ মুসলিম)

গোপনে ও প্রকাশ্যে সাদকা ও দান করা মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করে এবং আখিরাতে নূরের মাধ্যমে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।

৫. ভালো আচরণ ও চরিত্র গঠন

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

“সদাচরণ কিয়ামতের দিন নূরের মতো আলো ছড়াবে।” (তিরমিজি)

যারা ভালো ব্যবহার, নম্রতা ও সহানুভূতির সাথে মানুষদের সাথে মিশে, তারা কিয়ামতের দিন নূর পাবে।

৬. আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া অবলম্বন করা

আল্লাহ তাআলা বলেন:

“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো।” (সূরা তাওবা: ১১৯)

যারা দুনিয়াতে আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য কিয়ামতের দিন নূর বর্ষিত হবে।

৭. ইস্তিগফার ও তওবা করা

কুরআনে বলা হয়েছে:

“তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সূরা নূর: ৩১)

গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করা মানুষের হৃদয়কে পবিত্র করে এবং কিয়ামতের দিন আলোর উৎস হিসেবে কাজ করবে।

৮. দুঃখী ও অসহায়দের সাহায্য করা

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কষ্ট দূর করে, আল্লাহ তার কষ্ট দূর করবেন এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য নূরের ব্যবস্থা করবেন।” (সহীহ বুখারি)

অসহায়, দরিদ্র এবং বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে নূর প্রদান করবেন।

৯. দুআ “রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা” পড়া

কুরআনের সূরা তাহরীমের ৮ নম্বর আয়াতে এই দুআর উল্লেখ রয়েছে:

“رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ”

অর্থ: হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য আমাদের আলো পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।

নিয়মিত এই দুআ পড়লে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা নূরের বরকত দান করবেন।

কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

১. রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা কোন সূরার অংশ?

এটি সূরা তাহরীমের ৮ নম্বর আয়াতের অংশ।

২. এই দোয়া কখন পড়া উচিত?

এই দোয়া নামাজের সিজদায়, তাহাজ্জুদের সময়, জিকিরের পর এবং তওবার পর পড়া উত্তম।

৩. এই দোয়ার মূল শিক্ষা কী?

এই দোয়া আমাদেরকে আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে এবং আল্লাহর হিদায়াত ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।

৪. কীভাবে এই দোয়া জীবনে প্রয়োগ করবো?

দুঃসময়ে, সিদ্ধান্তহীনতার সময়, গুনাহ থেকে বাঁচতে এবং আখিরাতের সফলতার জন্য নিয়মিত এই দোয়া পড়ুন।

উপসংহার

“রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা” একটি শক্তিশালী ও অর্থবহ দোয়া, যা আমাদের জীবনে হিদায়াত, আখিরাতের সফলতা এবং আল্লাহর রহমত অর্জনের জন্য অপরিহার্য। প্রতিদিন এই দোয়া পড়ার অভ্যাস আমাদের ঈমানকে দৃঢ় করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোর পথ দেখাবে।

আল্লাহ আমাদের সকলের জন্য এই নূর পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন!


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x