আমরা প্রতিদিন নানা রকম নেয়ামতে ডুবে থাকি—জীবন, স্বাস্থ্য, রিজিক, নিরাপত্তা, পরিবার, ভালোবাসা, জ্ঞান, এমনকি নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো মৌলিক কিছু নিয়েও। কিন্তু আমরা কতবার এই নেয়ামতগুলোর জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি? “ধন্যবাদ”, “থ্যাংক ইউ”, বা “শুকরান”—এই শব্দগুলো অনেকের কাছে কেবল সৌজন্যবোধের প্রকাশমাত্র। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে ‘শুকরান’ এর অর্থ ও গুরুত্ব এর চেয়েও অনেক গভীর ও বিস্তৃত।
‘শুকরান’ শব্দটি আরবি, যার মূল অর্থ হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তবে শুধু মুখের শব্দে নয়, বরং অন্তর, জবান ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই প্রকৃত ‘শুকর’ বা ‘শুকরান’। এই একটি গুণ মুসলমানকে বানিয়ে তোলে ইতিবাচক, দৃঢ়চেতা এবং আল্লাহমুখী একজন আশাবাদী মানুষ।
এই ব্লগপোস্টে আমরা জানব—‘শুকরান’ শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ, ইসলামে এর গুরুত্ব, আল-কুরআনের আলোকে কৃতজ্ঞতার ব্যাখ্যা, এবং দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে প্রকৃত কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে ওঠা যায়।
🕌 শুকরান অর্থ কী? ইসলামি দৃষ্টিকোণে কৃতজ্ঞতার মানে ও গুরুত্ব
১. শব্দগত অর্থ ও ব্যুৎপত্তি
‘শুকরান (شُكْرًا)’ শব্দটি আরবি ‘شُكْر’ (শুকর) ধাতু থেকে উৎপন্ন। এর মূল অর্থ—কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা, এবং কোনো উপকারের স্বীকৃতি দেওয়া।
আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরব’-এ বলা হয়েছে:
الشُّكرُ هو الثناءُ على المُنْعِمِ عندَ النِّعمة
অর্থ: কোনো অনুগ্রহ বা নেয়ামতের পর অনুগ্রহকারীর প্রশংসা করাই হলো শুকর।
সাধারণভাবে “শুকরান” বলতে বোঝানো হয় – “ধন্যবাদ”, “আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ” ইত্যাদি। এটি একটি আদবপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যা মুসলিমদের মাঝে আন্তরিকতার পরিচায়ক।
২. ইসলামে শুকরের (কৃতজ্ঞতার) গুরুত্ব
ইসলামে ‘শুকর’ কেবল একটি সামাজিক সৌজন্য নয়; বরং এটি একটি ইবাদত। কৃতজ্ঞতা এমন একটি গুণ, যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত বাড়ে এবং নেয়ামত অব্যাহত থাকে।
🔹 কুরআনের আলোকে:
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ
“যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে অবশ্যই আমি তোমাদের আরও বেশি দেব।” — (সূরা ইব্রাহিম, ১৪:৭)
🔸 এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের শেখাচ্ছেন—শুকর আদায় করলে নেয়ামত বাড়ে, আর অকৃতজ্ঞতা করলে নেয়ামত উঠিয়ে নেওয়া হয়।
৩. রাসূল ﷺ কিভাবে শুকর আদায় করতেন?
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর প্রতিটি অবস্থায় শুকরের চর্চা করতেন। এমনকি রাতের গভীর ঘুম থেকে উঠে দীর্ঘ সালাত আদায় করতেন, পা ফেটে যেতো। তখন সাহাবা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন:
“أفلا أكون عبدًا شكورًا؟”
“তবে কি আমি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?” — (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
🔸 এ থেকে বোঝা যায়, শুকর শুধু কথার মাধ্যমে নয়, বরং আমলের মাধ্যমেও আদায় করতে হয়।
৪. কৃতজ্ঞতার তিনটি স্তর
- অন্তরের শুকর: আল্লাহর নেয়ামতের স্বীকৃতি অন্তরে অনুভব করা।
- জবানের শুকর: “আলহামদুলিল্লাহ”, “শুকরান”, “জাযাকাল্লাহু খাইরান” বলা।
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুকর: আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে তাঁরই পথে ব্যবহার করা।
🔹 যেমন: চোখের শুকর হচ্ছে হারাম দেখা থেকে বিরত থাকা।
🔹 রিজিকের শুকর হচ্ছে হালাল উপায়ে উপার্জন ও ব্যয় করা।
৫. ‘শুকরান’ বলার সুন্নতি বিকল্প
যখন কেউ আমাদের উপকার করে, তখন কেবল “শুকরান” নয়, বরং হাদিস মোতাবেক বলা উত্তম:
“جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا”
অর্থ: “আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।” — (তিরমিজি, হাদিস ২০৩৫)
🔸 রাসূল ﷺ বলেছেন, কেউ যখন “জাযাকাল্লাহু খাইরান” বলে, তখন সে পূর্ণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। (তিরমিজি)
৬. কেন কৃতজ্ঞতা জরুরি?
- কৃতজ্ঞতা মানুষের আত্মা শুদ্ধ করে।
- এটি হিংসা ও অভিযোগ থেকে দূরে রাখে।
- জীবনে ছোট-বড় প্রতিটি নেয়ামতের কদর করতে শেখায়।
- আল্লাহর প্রতি আস্থাবান ও ইতিবাচক বান্দা বানায়।
৭. আজকের বাস্তবতায় ‘শুকর’ হারাচ্ছি কেন?
দুঃখজনকভাবে, আধুনিক জীবনের ভোগবাদী সংস্কৃতিতে মানুষ ‘শুকর’ ভুলে যাচ্ছে।
আমরা যা পাই, তা নিয়ে সন্তুষ্ট নই—আর যা নেই, সেটাই মনে হয় আমাদের প্রাপ্য ছিল।
এমন মনোভাব একদিকে আল্লাহর অকৃতজ্ঞতা, অন্যদিকে অন্তরের অশান্তির মূল।
৮. কীভাবে কৃতজ্ঞ হতে শিখব?
- প্রতিদিন অন্তত একবার বলুন: “আলহামদুলিল্লাহ”
- দিন শেষে ভাবুন, আজকের কোন নেয়ামত সবচেয়ে বড় ছিল
- প্রতিদিন দোয়া করুন: اللّهُمّ اجعلني لكَ شَكُورًا
“হে আল্লাহ! আমাকে কৃতজ্ঞ বান্দা বানিয়ে দিন।”
📌 উপসংহার
‘শুকরান’ বলা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ইসলামি আদবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অন্তরে স্বীকৃতি, মুখে প্রশংসা এবং কাজে প্রমাণ।
আসুন, আমরা শুধু মানুষ নয়, বরং আল্লাহর প্রতিও প্রকৃত অর্থে কৃতজ্ঞ হতে শিখি।
আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ হয়। — (সূরা সাবা, ৩৪:১৩)
📖 আল-কুরআনে শুকরের উদাহরণসমূহ
আল্লাহ তাআলা কুরআনে অনেক নবী-রাসূল ও নেককার বান্দাদের ‘শুকরগুজার’ (কৃতজ্ঞ) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নিচে কুরআনের কয়েকটি বিশিষ্ট উদাহরণ তুলে ধরা হলো—
১. হযরত নূহ (আ.) — “তিনি ছিলেন কৃতজ্ঞ বান্দা”
🔹 আয়াত:
ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ ۚ إِنَّهُ كَانَ عَبْدًا شَكُورًا
“তোমরা নূহের সঙ্গে যাদের নৌকায় উঠিয়েছিলাম, তাদের সন্তান। নিশ্চয়ই সে ছিল কৃতজ্ঞ বান্দা।” — সূরা ইসরা, ১৭:৩
🔸 ব্যাখ্যা: নূহ (আ.) ৯৫০ বছর দাওয়াত দিয়েছেন, কঠিন সময় পেরিয়েছেন, অথচ কখনো অভিযোগ করেননি। বরং ধৈর্য ও শুকরের সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এজন্য আল্লাহ তাঁকে “আব্দান শুকুরা”—কৃতজ্ঞ বান্দা—বলে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন।
২. হযরত ইবরাহিম (আ.) — “প্রতি নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা”
🔹 আয়াত:
إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِّلَّهِ حَنِيفًا ۖ وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ – شَاكِرًا لِّأَنْعُمِهِ
“নিশ্চয়ই ইবরাহিম ছিল একা একটি জাতি, আল্লাহর অনুগত ও একনিষ্ঠ এবং কৃতজ্ঞ ছিল তাঁর নেয়ামতগুলোর প্রতি।” — সূরা নাহল, ১৬:১২০-১২১
🔸 ব্যাখ্যা: ইবরাহিম (আ.) জীবনের প্রতিটি ধাপে—শৈশব, কাবাঘর নির্মাণ, সন্তান কুরবানি—সবকিছুতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। এজন্য তিনি আল্লাহর বিশেষ প্রিয় হয়ে ওঠেন।
৩. হযরত সুলাইমান (আ.) — নেয়ামতের স্বীকৃতি ও শুকর
🔹 আয়াত:
هَٰذَا مِن فَضْلِ رَبِّي لِيَبْلُوَنِي أَأَشْكُرُ أَمْ أَكْفُرُ
“এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, তিনি আমাকে পরীক্ষা করছেন – আমি শুকর করি, না অকৃতজ্ঞ হই।”
— সূরা নমল, ২৭:৪০
🔸 ব্যাখ্যা: সুলাইমান (আ.)-এর ছিল অসাধারণ ক্ষমতা – জিন, পাখি, বায়ু নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু তিনি তা অহংকার করেননি, বরং আল্লাহর শুকর আদায় করেছেন।
৪. হযরত লুকমান (আ.) — পিতার উপদেশে শুকরের শিক্ষা
🔹 আয়াত:
وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنِ اشْكُرْ لِلَّهِ ۚ وَمَن يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ
“আমি লুকমানকে হিকমত দিয়েছিলাম—তুমি আল্লাহর প্রতি শুকর করো। যে শুকর করে, সে নিজেরই উপকার করে।” — সূরা লুকমান, ৩১:১২
🔸 ব্যাখ্যা: লুকমান (আ.) নিজেও ছিলেন কৃতজ্ঞ এবং তাঁর সন্তানকেও তা শিক্ষা দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা এখানে হিকমতের অংশ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
আর পড়ুন:
⚠️ অকৃতজ্ঞতার পরিণতি
আল্লাহ তাআলা মানুষকে অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু মানুষ যখন এ নিয়ামতের স্বীকৃতি না দিয়ে অভিযোগ, অহংকার বা গাফেলতির মধ্যে জীবন কাটায়—তখন তা অকৃতজ্ঞতার শামিল হয়। কুরআন ও হাদিসে এমন অকৃতজ্ঞ আচরণের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে বারবার সতর্ক করা হয়েছে।
১. কুরআনে অকৃতজ্ঞতার ভয়াবহ পরিণতি
🔸 (১) নেয়ামত কেড়ে নেওয়া হয়
ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
“আল্লাহ কোনো জাতিকে দান করা নেয়ামত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” — সূরা আনফাল, ৮:৫৩
🔸 ব্যাখ্যা: যখন মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়, তখন আল্লাহ সেই নেয়ামত সরিয়ে নিতে পারেন।
🔸 (২) আল্লাহর শাস্তি কঠিন হয়ে পড়ে
وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিঃসন্দেহে আমার শাস্তি কঠিন।” — সূরা ইব্রাহিম, ১৪:৭
🔸 ব্যাখ্যা: শুধু নেয়ামত হারানোই নয়, অকৃতজ্ঞতা আল্লাহর গজব ও কঠোর শাস্তির কারণও হতে পারে।
🔸 (৩) অধিকাংশ মানুষ অকৃতজ্ঞ – এটাই শয়তানের ফাঁদ
وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ
“আমার বান্দাদের মধ্যে কৃতজ্ঞ খুবই অল্প।” — সূরা সাবা, ৩৪:১৩
وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
“তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না।” — সূরা আরাফ, ৭:১৭
🔸 ব্যাখ্যা: শয়তান প্রতিজ্ঞা করেছে যে, সে মানুষকে অকৃতজ্ঞ করে তুলবে। অধিকাংশ মানুষ সে ফাঁদেই পড়ে।
২. হাদিসে অকৃতজ্ঞতার সতর্কতা
🔸 (১) মানুষের শুকর না করলে, আল্লাহর শুকর হয় না
«مَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللهَ»
“যে মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানায় না, সে আল্লাহকেও কৃতজ্ঞতা জানায় না।” — তিরমিজি: ১৯৫৪
🔸 ব্যাখ্যা: কারও উপকার পেয়ে ‘ধন্যবাদ’ না বলা, কোনো উপহারকে তুচ্ছ বলা—এসব অকৃতজ্ঞতার নিদর্শন। আল্লাহ তা অপছন্দ করেন।