মাছের পানি কি নাপাক? কখন পাক, কখন নাপাক? বিস্তারিত

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামে পবিত্রতা (তাহারাত) এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা নামাজসহ যাবতীয় ইবাদতের পূর্বশর্ত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সময় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে পবিত্রতা সংক্রান্ত ছোট ছোট বিষয় নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। তেমনি একটি প্রশ্ন হলো—মাছের পানি কি নাপাক?

অনেক সময় বাজার থেকে আনা মাছ বা জালভর্তি মাছের পানিতে কাপড় ভিজে যায়, অথবা হাত লাগে সেই পানিতে। তখন অনেকেই সন্দেহ করেন, এ পানি কি পবিত্র না অপবিত্র? এতে নামাজের জন্য অজু-গোসল বা কাপড়ের তাহারাতে কোনো প্রভাব পড়ে কি?

এই লেখায় আমরা কুরআন, সহীহ হাদীস ও হানাফি মাজহাবের ফিকহি ব্যাখ্যা আলোকে বিস্তারিতভাবে জানব—মাছের পানি আসলে শরয়ী দৃষ্টিতে কী অবস্থায় পড়ে, এবং আমাদের কী করণীয়।

🐟 মাছের পানি কি নাপাক?

মাছের বাজারে বা মাছ আনার সময় থলি বা বালতির পানি কাপড়ে বা হাতে লাগলে তা শুধু এই কারণে নাপাক নয়। যদি ওই পানিতে কোনো পাকা/পঁচা মাছের রক্ত বা নাপাকি স্পষ্টভাবে না মিশে থাকে, তাহলে সে পানি পবিত্র। নামাজের কাপড় পাল্টাতে হবে না।

মাছ আনার সময়, বাজারের থলি বা বালতিতে থাকা পানি কাপড়ে বা হাতে লাগলে অনেক সময় মানুষ দ্বিধায় পড়ে— এ পানি পবিত্র নাকি অপবিত্র? নামাজের কাপড়ে লাগলে কি পরিবর্তন করতে হবে?

🟩 ইসলামে পানির পবিত্রতার মূলনীতি

🔹 কুরআন মাজীদ

وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً لِّيُطَهِّرَكُم بِهِ

“আর তিনি তোমাদের ওপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, যাতে তিনি তোমাদের তা দ্বারা পবিত্র করেন।” — (সূরা আনফাল, আয়াত: ১১)

🔸 এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন—যে পানি তার মূল গুণাবলি (রং, গন্ধ, স্বাদ) ধরে রাখে, তা তাহারাত বা পবিত্রতার কাজে ব্যবহারযোগ্য।

🟩 হাদীস দ্বারা দলিল

🔹 ১. সামুদ্রিক পানি পবিত্র

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: “هُوَ الطَّهُورُ مَاؤُهُ، الْحِلُّ مَيْتَتُهُ”

“সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং তার মৃত মাছ হালাল।” — (সুনান আবু দাউদ: ৮৩, সহীহ)

🔸 অর্থাৎ, এমন পানিও যেটা মাছের আবাসস্থল, তা পবিত্র—যদি তাতে কোনো নাপাকি না পড়ে।

🟩 ফিকাহর আলোকে বিশ্লেষণ

🔹 হানাফি মাজহাব:

হানাফি আলেমগণ বলেন: মাছ রাখার পানির উপর নিয়ম দুটি নির্ভর করে:

১. যদি মাছের পানিতে কোনো নাপাকি না পড়ে,

যেমন:

  • মাছের বেঁচে থাকা পানি,
  • মাছ ধোয়ার পানি,
  • মাছের গায়ে লেগে থাকা পানি,

🔹 তাহলে সে পানি পবিত্র (তাহির) এবং কাপড়ে লাগলেও নামাজের জন্য অসুবিধা নেই।

❌ ২. যদি মাছের পানিতে রক্ত, পচা অংশ, বা পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ মিশে যায়,

  • যেমন মাছ পচে গেছে,
  • বা তার শরীরে নাপাক কিছু লেগে ছিল,
  • বা পানি অস্বাভাবিক রঙ, গন্ধ ও স্বাদ ধারণ করেছে,

🔸 তখন সে পানি নাপাক (নাজিস) গণ্য হবে।

🟨 ফিকাহ কিতাবসমূহ থেকে রেফারেন্স

🔸 الدر المختار (২/৩৩৮):

“والماء إذا تغير بنجاسة أو بمجاورة النجاسة وكان قليلا فإنه ينجس”

— “যদি কম পরিমাণ পানি নাপাকির দ্বারা পরিবর্তিত হয়, তবে তা নাপাক হয়।”

🔸 الفتاوى الهندية (১/৪৬):

“إذا وقع في الماء شيء نجس فتغير أحد أوصافه فهو نجس”

— “যদি কোনো নাপাক বস্তু পানিতে পড়ে এবং তার রং/গন্ধ/স্বাদ পরিবর্তিত হয়—তবে সে পানি নাপাক।”

✅ উপসংহার

অবস্থাপানি পবিত্র নাকি নাপাক?
শুধু মাছের গায়ের পানি✅ পবিত্র
বাজার থেকে আনা জীবিত বা সদ্য মারা মাছের পানি✅ পবিত্র
পানি দুর্গন্ধযুক্ত, পঁচা বা রক্ত মিশ্রিতনাপাক
পানিতে মাছ মারা গেলে এবং তা পঁচে গেলে❌ নাপাক

ℹ️ ব্যবহারিক পরামর্শ

  • বাজার থেকে আনা মাছের পানি সাধারণত নাপাক নয়, তবে সতর্কতার জন্য কাপড় পরিবর্তন উত্তম, বিশেষত যদি পানি দুর্গন্ধযুক্ত হয়।
  • কাপড়ে মাছের পানি লাগলে তা শুকিয়ে গেলে এবং কোনো দাগ বা গন্ধ না থাকে—তবে কাপড় নাপাক নয়

কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

❓ ১. যদি মাছের পানি কাপড়ে লাগে, করণীয় কী?

উত্তর: যদি পানিটা পরিষ্কার ও স্বাভাবিক গন্ধ/রঙ/স্বাদযুক্ত হয় (যেমন বাজারে বরফ দেওয়া তাজা মাছের পানি), তাহলে সেটি নাপাক নয়।

➡️ কাপড় পাল্টানো বা ধোয়া জরুরি নয়, নামাজ পড়া জায়েজ।

❓ ২. মাছের পানি লাগা কাপড় পরে মসজিদে যাওয়া যাবে কি?

উত্তর: হ্যাঁ, যাবে। যদি নিশ্চিত হওয়া যায় পানিটা নাপাক কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, তাহলে মসজিদে যাওয়া এবং নামাজ আদায় জায়েজ ও সহিহ।

❓ ৩. মাছের পানির কারণে কাপড়ে গন্ধ থাকলে কী করতে হবে?

🟡 উত্তর: গন্ধ থাকলেই কাপড় নাপাক হয় না, যতক্ষণ না তা নাপাকি দ্বারা প্রভাবিত হয় (যেমন রক্ত বা পঁচা বস্তু)। তবে

➡️ গন্ধ বিরক্তিকর বা সামাজিকভাবে অপছন্দনীয় হলে ধুয়ে নেওয়া মুস্তাহাব।
➡️ মসজিদে যাওয়ার আগে এমন গন্ধময় কাপড় পরিবর্তন করা উত্তম (আদবের খাতিরে)।

❓ ৪. সন্দেহ হলে করণীয় কী? যেমন বোঝা যাচ্ছে না পানি পবিত্র ছিল কি না।

🟡 উত্তর: শরিয়তের নিয়ম:

“اليقين لا يزول بالشك” — “নিশ্চয়তা সন্দেহ দ্বারা নষ্ট হয় না।”

📌 তাই: যদি নিশ্চিত না হও যে কাপড়ে নাপাক লেগেছে, তাহলে সেটিকে পবিত্রই গণ্য করা হবে। নামাজ আদায় জায়েজ।

❓ ৫. মাছের পানি কাপড়ে শুকিয়ে গেলে, তখন নামাজে পড়া যাবে?

উত্তর: হ্যাঁ, যাবে—যদি ওই পানিতে নাপাক উপাদান না থাকে। শুধু শুকিয়ে যাওয়া বা দাগ থেকে গেলেও কাপড় নাপাক হয় না, যতক্ষণ না রং/গন্ধ/স্বাদ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে তা নাপাক।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x